গ্রাহকের ১০৪ কোটি টাকা যেভাবে লুট হয়েছে হোমল্যান্ড লাইফে

মোস্তাফিজুর রহমান টুংকু: জমি কেনা হয়েছে অথচ জমির কোন অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্বহীন এই জমিতে আবার বালু ফেলার খরচও দেখানো হয়েছে। জমি কেনার জন্য অগ্রিম দেয়া হয়েছে অথচ সেই জমি রেজিস্ট্রি হয়নি। ফেরত দেয়নি জমি কেনা বাবদ নেয়া অগ্রিম টাকা। এখানেই শেষ নয়, কোম্পানির সার্ভিস সেন্টারে অগ্রিম কমিশন ও বেতন-ভাতা পাঠিয়ে তা আবার নগদে তুলে নেয়া হয়েছে। এভাবেই হোমল্যান্ড লাইফে গ্রাহকের জমা করা টাকা থেকে লুট করা হয়েছে ১০৪ কোটি টাকা। এ লুটপাট হয়েছে ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সালে। আর এ লুটপাটে জড়িত স্বয়ং কোম্পানির মালিকরাই।

সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি থাকার পরও গ্রাহকের টাকা উদ্ধারে পরের ১০ বছরেও কোন ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। উদ্ধার হয়নি কোন টাকাও। অপর দিকে লুটপাটের এ ক্ষত নিয়েই চলছে হোমল্যান্ড লাইফ। প্রতিনিয়তই হয়রানি, ভোগান্তির শিকার হচ্ছে গ্রাহক, মাঠ কর্মীরা। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও গ্রাহকরা পাচ্ছে না মেয়াদ শেষে বীমা দাবির টাকা।

অপরদিকে লুট হওয়া টাকা কোম্পানির তহবিলে ফেরত আনা নিয়ে পরিচালকদের মাঝে চলছে দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্ব নিরসনে কয়েক মাস আগে নিরপেক্ষ পরিচালক নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন করা হয়েছে নতুন চেয়ারম্যান। তবে এতেও সুরাহা হয়নি।

লুটপাটে জড়িত পরিচালকরা নতুন করে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ তুলছে। যাতে করে শতকোটি টাকা দুর্নীতি ধামাচাপা পড়ে -এমনটাই অভিযোগ পরিচালনকদের এক পক্ষের। তাদের মতে, গেলো ১০ বছরে কোম্পানিতে যে ফান্ড সৃষ্টি হয়েছে তা আবারও লুটপাট করতেই নতুন নকশা সাজানো হচ্ছে।

এমন অবস্থায় সংশ্লিষ্টদের দাবি অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে সঠিকভাবে তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা।

হোমল্যান্ড লাইফের গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের ঘটনা অনুসন্ধানে নামে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। অনুসন্ধান শুরু হয় ২০১০ সালে। বিগত সময়গুলোতে নানাভাবে সংগ্রহ করা হয় দুর্নীতির নথিপত্র। আলাপ করা হয় সংশ্লিষ্টদের সাথে। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র হাতে আসা নথিপত্র ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে গ্রাহকের শত কোটি টাকা লুটের তথ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রতিবেদন।

হোমল্যান্ড লাইফে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ তবে কি পূর্ব পরিকল্পিত!

হোমল্যান্ড লাইফ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯৬ সালে। বাংলাদেশের সিলেটস্থ ব্রিটিশ নাগরিক ও স্থানীয় বাংলাদেশীদের নিয়ে গঠন করা হয় কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। তবে প্রবাসী পরিচালকরা ব্রিটিশ নাগরিক হলেও কোম্পানিটিতে তারা বিনিয়োগ করেন বাংলাদেশী হিসেবেই। বিনিয়োগের এই টাকা তারা নিয়ে আসেন হুন্ডি করে। নথিপত্রে এমনটাই তথ্য মেলে।

১৯৯৬ সালে হোমল্যান্ড লাইফ প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রথম পাঁচ বছর বোর্ড সভাগুলো অনুষ্ঠিত হতো কোম্পানির মতিঝিলস্থ এল্লাল চেম্বারের প্রধান কার্যালয়ে।

২০০১ সালের ২২ এপ্রিল কোম্পানির ২৫তম বোর্ড সভাটি অনুষ্ঠিত হয় সিলেটে। সিলেটের কাজী এনাম ভবনের চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। এ ভবনের মালিক বীমা কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম। এরপর থেকে ২০০৫ সালের ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত ৪৪তম বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয় সিলেটে।

সিলেটে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভাগুলোতে ব্রিটিশ নাগরিক সিলেটের পরিচালকদের আধিপত্য ও সভাগুলো ঢাকার বাইরে হওয়ায় ঢাকার পরিচালকরা বেশিরভাগই অংশ নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অনেকেই তাদের শেয়ার অংশও তুলে নেন এ সময়ে।

এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বোর্ডে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন সিলেটের ব্রিটিশ নাগরিক পরিচালকরা। সুযোগ নেন দুর্নীতি-অনিয়মের। সিলেটের বোর্ড সভাগুলোতেই গ্রাহকের জমা করা টাকা তুলে নিতে অনুমোদন দেয়া হয় অস্তিত্বহীন জমি কেনার, অস্তিত্বহীন জমিতে মাটি ভরাটের, জমি ছাড়াই দেয়া হয় জমি কেনার অগ্রিম টাকা।

সিলেটে অনুষ্ঠিত ৩১তম বোর্ড সভায় অস্তিত্বহীন একটি জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভাতেই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এমডি সরাফত উল্লাহ ঢালি পদত্যাগ করেন। সিলেটে সর্বশেষ বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয় ২৮ মার্চ ২০০৫ সালে; কোম্পানির ৪৪তম বোর্ড সভা। এরপর চলে যায় আরো কয়েক বছর।

কোম্পানির পরিচালকদের টাকা আত্মাসাতের প্রথম অভিযোগটি ওঠে ২০০৮ সালে। এ সময়ে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এমডি সরাফত উল্লাহ ঢালি কোম্পানির পরিচালক ফয়জুল হকের বিরুদ্ধে ৩০ লাখ টাকা আত্মাসাতের অভিযোগ তুলে মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন। এই ঘটনায় হোমল্যান্ড লাইফের গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের ঘটনা বীমা খাতে আলোচনার জন্ম দেয়।

সমঝোতার মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে গঠিত বোর্ডে কোম্পানির চেয়ারম্যান করা হয় প্রবাসী পরিচালক ফয়জুল হককে। আর ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মেজর জাহাঙ্গীর। এই পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত হন মো. জুলহাস ও আবুল কাশেম। পরে মেজর জাহাঙ্গীর কোম্পানির চেয়ারম্যান হন। এ সময়ে ফয়জুল হকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালিন ২ বছরে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা আবারো সামনে আসে। এতে সিলেটের প্রবাসী পরিচালকরা ঢাকার পরিচালকদের সাথে একটি সমঝোতায় আসেন। ওই সমঝোতায় কোম্পানি সঠিকভাবে পরিচালনা সহ আত্মসাতকৃত টাকা উদ্ধারে সকলে একমত হন। এ সমঝোতায় এ সময়ে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ পান মো. আজিজুল ইসলাম তালুকদার।

২০১০ সালের পর বিশেষ নিরীক্ষা, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় শত কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য উঠে আসে। এ টাকা উদ্ধারে আত্মসাতে জড়িত পরিচালকদের বিরুদ্ধে কোম্পানির পক্ষ থেকে মামলার পাশাপাশি আত্মসাতে জড়িত যেসব পরিচালক এখনো বোর্ডে আছেন তাদের কোম্পানির তহবিলে টাকা ফেরত দেয়ার আলোচনা করা হয় বোর্ড সভাগুলোতে। একই সাথে আইনি ব্যবস্থারও উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু কোনটাই সফল হয়নি।

এরইমধ্যে গ্রাহকের দায়ের করা মামলায় হোমল্যান্ডের প্রবাসী ৭ পরিচালককে যেতে হয় মাগুরার জেল হাজতে। ঘটনাটি দেশে বিদেশে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। বীমা খাতে আবারও আলোচনায় হোমল্যান্ডের দুর্নীতি ও পরিচালকদের দ্বন্দ্ব।

৪৪টি সার্ভিসিং সেন্টারের অগ্রিম খরচ পাঠিয়ে ৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ

গ্রাহকের টাকা আত্মসাতে অভিনব পদ্ধতি চালু করা হয় ২০০৮ সালে। এ সময়ে কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন প্রবাসী পরিচালক ফয়জুল হক। টাকা আত্মসাৎ করতে প্রথমে সার্ভিস সেন্টারগুলো থেকে প্রিমিয়াম আয়ের ঘোষণা নেয়া হয়; পরিকল্পনা বা টার্গেট নয়। প্রিমিয়াম আয়ের এ ঘোষণা দেয়া হতো কখনো কাগজে-কলমে বা কখনো মৌখিক। কত টাকার প্রিমিয়াম আয়ের ঘোষণা দেয়া হবে সে বিষয়ে দিক নির্দেশনাও দেয়া হতো প্রধান কার্যালয় থেকে।

সম্ভাব্য প্রিমিয়াম আয়ের (ঘোষিত) বিপরীতে কমিশন, বেতন-ভাতা ও অফিস ভাড়া বাবদ অগ্রিম খরচের রিকুইজিশন সার্ভিস সেন্টার থেকে পাঠানো হতো প্রধান কার্যালয়ে। আর তা অনুমোদন করে এ টাকা পাঠানো হতো সার্ভিস সেন্টারের ব্যাংক একাউন্টে। সার্ভিস সেন্টারের একাউন্ট থেকে এ টাকা তুলে তা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়া হতো।

অগ্রিম টাকা পাঠানো কতটা যৌক্তিক বা আগের মাসে যে অগ্রিম টাকা দেয়া হয়েছে তার বিপরীতে কত টাকার প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয়েছে তা কখনো যাচাই-বাছাই করা হতো না। এই পদ্ধতি নিয়ে কোন কর্মকর্তা কোন বিষয় জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলে বিপদ নেমে আসত ওই কর্মকর্তার ওপর। কখনো বদলি, চাকরিচ্যুতি বা মারধরের শিকার হয়েছেন অনেকেই।

অভিনব এ পদ্ধতিতে ২০০৮-২০০৯ সালে কোম্পানির তহবিল থেকে ৪৪টি সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয় ৬১ কোটি টাকা। এ সময়ে অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে যেভাবে টাকা আত্মসাৎ করা হয় তার কিছু নথিপত্র আসে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র হাতে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, হোমল্যান্ড লাইফের নরসিংদী সার্ভিস সেন্টার থেকে ৬ লাখ টাকা খরচ বাবদ অগ্রিম চেয়ে একটি চাহিদা পত্র পাঠানো হয় ২০০৯ সালে ৩ আগস্ট। ৬ লাখ টাকার মধ্যে এজেন্ট কমিশন বাবদ ৮৬ হাজার ৮১৩ টাকা, ওভার রাইডিং (ওআর) অর্থাৎ নবায়ন প্রিমিয়ামের অগ্রিম কমিশন বাবদ ১ লাখ ১১ হাজার ৯৪৫ টাকা, ক্লোজিং ব্যালান্স ৩ হাজার ৬৬৪ টাকা। জনতা ব্যাংকের ২৫ নং একাউন্টে এই ৬ লাখ টাকা পাঠানোর আবেদন করা হয় চাহিদা পত্রে। সার্ভিস সেন্টার থেকে এই চাহিদা পত্রে স্বাক্ষর করেন সার্ভিস সেন্টারের ইনচার্জ এমডি কায়ছার আহমেদ ও আন্ডার রাইটার মরিয়ম আক্তার।

চাহিদা পত্রটি পাঠানোর ৩ দিন পর অর্থাৎ ৬ আগস্ট তা অনুমোদন করেন এমডি ও প্রধান হিসাব কর্মকর্তা। ওই দিনই ৩টি ভাউচারে চেক পেমেন্ট করা হয় ৪ লাখ টাকা। এর মধ্যমে একটি ভাউচারে (নং-১৯২৯৮) ২ লাখ টাকা। অপর ২টি ভাউচারে (নং- ১৯২৯৯ ও ১৯৩০০) পাঠানো হয় ১ লাখ টাকা করে ২ লাখ টাকা। প্রধান কার্যালয় থেকে তা অনুমোদন করেন তৎকালিন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান হিসাব কর্মকর্তা।

নরসিংদী সার্ভিস সেন্টারে ২০০৯ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর ৫ মাসে কমিশন ও অফিস ভাড়া বাবদ অগ্রিম নেয়া হয় ২৪ লাখ টাকা। অথচ ৫ মাসে নরসিংদী সার্ভিস সেন্টারে প্রিমিয়াম আয় হয় মাত্র ১ হাজার টাকা। যার মধ্যে জুলাই, আগস্ট ও নভেম্বর মাসে কোন ব্যবসাই হয়নি। সে সময়ে এ চিত্র শুধু নরসিংদীর একটি সার্ভিস সেন্টারের নয়। এ চিত্র তখন হোমল্যান্ড লাইফের ৪৪টি সার্ভিস সেন্টারের।

ফয়জুল হক চেয়ারম্যান থাকাকালে সংঘটিত আর্থিক অনিয়মের এ ঘটনা উৎঘাটন ও সমাধানের জন্য কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি একটি উপ-কমিটি গঠন করে। এ কমিটির আহবায়ক ছিলেন মোহাম্মাদ জুলহাস। অপর সদস্যরা হলেন- মো. আবদুর রব, সালেহ হোসেন, মো. আব্দুল হাই ও মোহাম্মদ শামীম আহমেদ।

ওই কমিটির কাছে তৎকালীন সার্ভিস সেন্টারে কর্মরত ব্যক্তিরা যেসব বক্তব্য দেন তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- কোম্পানির তহবিল থেকে মোটা অংকের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই অভিনব এ পদ্ধতি চালু করা হয়। এমনটাই চিত্র উঠে আসে তাদের বক্তব্যে।

২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর উপ কমিটির ৪র্থ সভায় বক্তব্য দেন মিজানুর রহমান নামে একজন কর্মকর্তা। ২০০৮-২০০৯ সালে কুমিল্লা সার্ভিস সেন্টার ইনচার্জ ছিলেন মিজানুর রহমান।

সার্ভিস সেন্টারে অগ্রিম টাকা পাঠানোর বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন, ২০০৮-২০০৯ সালে ডিক্লারেশন ব্যবসা হতো। অর্থাৎ প্রধান কার্যালয় থেকে সার্ভিস সেন্টারগুলোতে জানতে চাওয়া হতো কত টাকার ব্যবসা হবে; সার্ভিস সেন্টার থেকে ব্যবসার যে ঘোষণা দেয়া হতো তাকে বলা হতো ডিক্লারেশন ব্যবসা। সার্ভিস সেন্টার থেকে ব্যবসার যে ডিক্লারেশন দেয়া হতো সে অনুযায়ী প্রধান কার্যালয় থেকে অগ্রিম খরচের টাকা পাঠানো হতো।

এই টাকা পাঠানো হতো যৌথ একাউন্টে। পরে তা ট্রান্সফার করে একক চেকে নগদ উঠানো হত।

এই টাকা খরচ দেখানোর জন্য প্রধান কার্যালয় থেকে পেমেন্ট শীট পাঠানো হতো। প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো পেমেন্ট শীটে ২০/২৫ জন কর্মকর্তার নাম দেয়া হলেও তা রিসিভ করতেন সার্ভিস সেন্টারের এসইভিপি বা তার মনোনিত ২ /১ জন।

লিখিত ওই বক্তব্যে মিজানুর রহমান আরো উল্লেখ করেন সে সময়ে কোম্পানির উন্নয়ন ইনচার্জ জাকির হোসেন সরকার ও জিএম ওয়ালি উল্লাহ নাসির মিলে ভূয়া ব্যবসা দেখিয়ে টাকা বের করে নিতেন।

কোম্পানির উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. জলিল, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল বাশার আকন্দ, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা শফিকুর রহমান অনৈতিকভাবে বের করা টাকার ভাগ পেতেন।

মাঠ কর্মীদের চাহিদামতো টাকা পাঠাতে দেরি হওয়ায় তার আঙ্গুল ভেঙ্গে দেয়া হয় বলেও লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন মিজানুর রহমান।

নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৮-২০০৯ সালে কুমিল্লা সার্ভিস সেন্টারে কমিশন ও বেতন-ভাতার খরচ বাবদ অগ্রিম পাঠানো হয় ৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অথচ ওই ২ বছরে প্রিমিয়াম আয় হয় ২ কোটি ৩৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা।

উপ-কমিটির কাছে কোম্পানির সিনিয়র সহকারি ম্যানেজার শিব্বির আহমেদ তার লিখিত বক্তব্যে জানান, সার্ভিস সেন্টারে বেশি করে ফান্ড পাঠানোর জন্য প্রধান কার্যালয় থেকে পরামর্শ দেয়া হতো। পরে সার্ভিস সেন্টারে পাঠানো অতিরিক্ত টাকা প্রধান কার্যালয়ে ডিডি করে চিঠির মাধ্যমে পাঠানো হতো।

তিনি আরো উল্লেখ করেন, কোম্পানির এএমডি জাকির হোসেন সার্ভিস সেন্টার থেকে নগদ টাকা পাঠানোর নির্দেশ দিতেন। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ মতো টাকা না পাঠালে হুমকি-ধামকি দেয়া হতো বলেও তিনি উল্লেখ করেন লিখিত বক্তব্যে।

২০০৯ সালে সিরাজগঞ্জ সার্ভিস সেন্টারে প্রশাসনিক কর্মকর্তা আনোয়ার আহমেদ চকদার তার লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন, ২০০৮-২০০৯ সালে অবস্থাটা এমন ছিল যে, প্রধান কার্যালয় থেকে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানতে চাইতেন কত টাকা ব্যবসা হবে। সার্ভিস সেন্টারগুলো থেকে ঘোষণা দেয়া হতো ২০/ ২৫ লাখ টাকার ব্যবসা হবে। সে অনুযায়ী প্রধান কার্যালয় থেকে কমিশন ও বেতন-ভাতা বাবদ অগ্রিম টাকা পাঠানো হতো। ব্যবসা না হলে প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো ফান্ড সার্ভিস সেন্টারের যেসব কর্মকর্তা ব্যাংকের লেনদেনের স্বাক্ষরকারি ছিলেন তারা নগদ তুলে নিয়ে হস্তমজুদ করতেন। পরের মাসে আবারও অগ্রিম টাকা পাঠানো হতো। কিন্তু আগের মাসে পাঠানো খরচের সাথে ব্যবসা কি পরিমাণ হলো তার কোন হিসাব করা হতো না। পরে মাসে আবারো অগ্রিম টাকা পাঠানোর ব্যবসা পরিস্থিতি কি অবস্থায় আছে তা যাচাই-বাছাই করা হতো না।

২০০৮-২০০৯ সালের ২ বছরে  সিরাজগঞ্জ সার্ভিস সেন্টারে অগ্রিম পাঠানো হয় ৮১ লাখ টাকা। যার বিপরীতে প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয় ৪৩ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। সিরাজগঞ্জ সার্ভিস সেন্টার থেকে অগ্রিম টাকা চেয়ে পাঠানো চাহিদা পত্রে স্বাক্ষর করেন আনোয়ার হোসেন চকদার ও জয়নুল আবেদীন। প্রধান কার্যালয় থেকে তা অনুমোদন করেন কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান হিসাব কর্মকর্তা।

কমিটির অনুসন্ধানে ফয়জুল হক চেয়ারম্যান থাকাকালিন আর্থিক অনিয়মের জন্য ফয়জুল হককে এককভাবে দায়ী করেন। পরে আত্মসাৎকৃত টাকা উদ্ধারে ফয়জুল হকের সাথে কমিটির সদস্যরা আলোচনা করে সমাধান করার চেষ্টা করেন। তবে এসব আলোচনায় ফয়জুল হক টাকা আত্মসাতের বিষয় অস্বীকার করেন। কমিটি আত্মসাৎ করা টাকা উদ্ধারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তবে অদ্যবধি ফয়জুল হকের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

সার্ভিস সেন্টারে অগ্রিম পাঠিয়ে টাকা আত্মসাতের এ ঘটনা যেভাবে উৎঘাটন হয়

অভিনব কায়দায় সার্ভিস সেন্টারে অগ্রিম পাঠিয়ে টাকা আত্মসাতের এ চাঞ্চল্যকর ঘটনার তথ্য বেরিয়ে আসে ২০১২ সালে। ২০১২ সালের ৩ জানুয়ারি হোমল্যান্ড লাইফ থেকে বহিস্কার হওয়া কর্মকর্তা কামরুল আহসান কোম্পানির সে সময়ের কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন অনৈতিকভাবে ৯৬ লাখ টাকার একটি বিলে তাকে স্বাক্ষর করার চাপ সৃষ্টি করে কোম্পানির তৎকালিন কয়েকজন পরিচালক। এই চাপ সৃষ্টির জন্য পরিচালক নজরুল ইসলাম, আব্দুর শুকুর, ফারুক ও মফিজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন কামরুল হাসান।

এই অনৈতিক কাজে তিনি রাজি না হওয়ায় ২০০৯ সালের ৮ আগস্ট তাকে প্রধান কার্যালয়ের বোর্ড রুমে আটকে রাখা হয়। ওই দিন তাকে কোম্পানি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এ অভিযোগের সত্যতা খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় ২০০৯ সালে আগস্টের ২ তারিখে অনুষ্ঠিত ২৩৭তম নির্বাহী কমিটির সভার এজেন্ডা ছিল শুধু কামরুল হাসানকে বহিস্কার করা।

কামরুল হাসানের ঘটনার সত্যতা খুঁজতে গিয়ে কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো হোমল্যান্ড লাইফের তৎকালিন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে সার্ভিস সেন্টারে অগ্রিম পাঠিয়ে অভিনব কায়দায় টাকা আত্মসাতের ঘটনা।

ব্যবসা উন্নয়নের খরচ: এক ভাউচারেই আত্মসাৎ ৩০ লাখ

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্যবসা উন্নয়ন খাতে খরচের জন্য ৩০ লাখ টাকার একটি নোট শীট অনুমোদন দেয়া হয় ২০০৮ সালের ১৮ নভেম্বর। এই নোট উপস্থাপন করেন তৎকালিন কোম্পানি সচিব মোয়াজ্জেম হোসেন। নোটটি অনুমোদন করেন কোম্পানির চেয়ারম্যান ফয়জুল হক ও পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য।

ওই দিনই ২১৬তম বোর্ড সভায় এই টাকা অগ্রিম খরচের অনুমোদন দেয়া হয়। ওই বোর্ড সভায় উপস্থিত ছিলেন- ফয়জুল হক, নজরুল ইসলাম, মো. জামাল উদ্দিন, নাফিসা সুলতানা, মো. মহিউদ্দিন, আব্দুর রব, আব্দুর রাজ্জাক, কামাল মিয়া, আব্দুল আহাদ, আব্দুল হাই ও মো. মফিজ উদ্দিন।

২০০৮ সালে ২৯ নভেম্বর কোম্পানির ওরিয়েন্টাল ব্যাংক (আইসিবি) একাউন্ট থেকে নগদে তোলা হয় ২৫ লাখ টাকা ও কোম্পানির এনসিসি ব্যাংকের একাউন্ট থেকে তোলা হয় ৫ লাখ টাকা।

এ সময়ে টাকা আত্মসাতের এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে কোম্পানির সিনিয়র ইভিপি কাজী রেজাউল হক, মো. আব্দুল জলিল ও নকুল চন্দ্র মজুমদারের নামে অগ্রিম দেখিয়ে সমন্বয় করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু উর্ধ্বতন এই ৩ কর্মকর্তা এ বিষয়ে রাজি হননি।

উন্নয়ন ব্যয়ের নামে কোম্পানির তহবিল থেকে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এমডি সরাফত উল্লাহ ঢালি মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং- ২৪।

এ মামলায় সাবেক ও প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক সরাফত উল্লাহ ঢালি অভিযোগ করেন, কোম্পানির ফান্ড থেকে উন্নয়ন ব্যয়ের নামে ৩০ লাখ টাকা তুলে নেন ফয়জুল হক। পরে কয়েকজন পরিচালক মিলে তা ভাগ করে নেন।

এই টাকা অনুমোদন দেয়া হয় কোম্পানির ২১৬তম বোর্ড সভায়। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন- কোম্পানির তৎকালিন চেয়ারম্যান ফয়জুল হক, ভাইস চেয়ারম্যান, নজরুল ইসলাম, পরিচালক জামাল উদ্দিন, নাফিসা সালমা, মো. মহিউদ্দিন। সভায় পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- আব্দুর রব, আব্দুর রাজ্জাক, কামাল মিয়া, আব্দুল হাই, আব্দুল আহাদ ও মফিজ উদ্দিন।

পরে এই ৩০ লাখ টাকা কোম্পানির তহবিলে ফেরত দিতে ১৫০ টাকা নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গিকার করায় সমঝোতার ভিত্তিতে সরাফত উল্লাহ ঢালি মামলা তুলে নেন। তবে পরবর্তীতে ফয়জুল হক ও অন্যান্য সুবিধাভোগিরা এই টাকা কোম্পানির তহবিলে ফেরত দেননি।

১ম বর্ষে ইনসেনটিভ ২.৫%, আর নবায়নে ১ শতাংশ!

বীমা আইনে প্রিমিয়াম আয়ের কমিশন নির্ধারণ করা থাকলে তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় হোমল্যান্ড লাইফের ২০০৮ ও ২০০৯ সালের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। বিশেষ সুবিধা দেয়া হয় কোম্পানির তৎকালিন সহকারি ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন সরকারকে।

কোম্পানির প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের উপর ২.৫ শতাংশ নবায়ন প্রিমিয়ামের উপর ১ শতাংশ ইনসেনটিভ বা উৎসাহ বোনাস দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালিন কর্তৃপক্ষ। তবে অভিযোগ ও জাকির হোসেন সরকারকে এমন সুবিধা দেয়ার নেপথ্যে ছিল তৎকালিন চেয়ারম্যান ফয়জুল হক। জাকির হোসেনের সহযোগিতায় ইনসেনটিভের নামে এসময়ে  আত্মসাৎ করা হয় ৭৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৭৩ টাকা।

মূলত টাকা আত্মসাতের জন্য কখনো-বা ব্যবহার করা হয় সার্ভিস সেন্টারগুলোকে, কখনো জাকির হোসেন সরকারের মত কর্মকর্তাকে ইনসেনটিভ প্রদান করা হয় অথবা উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুল জলিল, নকুল কুমারের মত উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে অগ্রিম প্রদানের মত এসব ঘটনা সৃষ্টি করা হয়।

সিলেটের টুকের বাজারে জমি ক্রয়ের নামে আত্মসাৎ ১.৫১ কোটি টাকা

পরিকল্পিতভাবে টাকা আত্মসাতের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০০২ সালে। এ সময়েই অস্তিত্বহীন একটি জমি ক্রয় দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের এ পরিকল্পনা করা হয়। এই জমি ক্রয়ের প্রস্তাব করেন কোম্পানির তৎকালিন ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস শুকুর। তৎকালিন পরিচালক ফারুক তা সমর্থন করেন।

পরের জমিটি ক্রয়ের জন্য ২০০২ সালের ১৯ জুন ৬২তম নির্বাহী কমিটির সভায় ৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন- কাজী এনাম, আব্দুস শুকুর, নজরুল ইসলাম ও নাফিসা সালমা।

এই কমিটি পরের দিন-ই, ২০ জুন ৩০তম বোর্ড সভায় জমি ক্রয়ের সম্মতি জানিয়ে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে বোর্ড তা অনুমোদন করে। এক দিনের মধ্যে কোটি টাকা ব্যয়ের জমির প্রতিবেদন দেয়ায় বোঝার বাকি থাকে না কোম্পানির তহবিল থেকে টাকা বের করতেই জমি ক্রয়ের বিষয়টি সাজানো হয়।

যে জমির কোন অস্তিস্ত নেই। সেই জমি কেনার ব্যয় বাবদ অনুমোদন করা হয় ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। জনৈক তৈয়ব আলীকে সাজানো হয় জমির মালিক। জমির দাম পরিশোধ করা হয় নগদ চেক ও পে অর্ডারের মাধ্যমে, ৪ দফায়।

২০০২ সালের ১ আগস্ট পরিশোধ করা হয় ৫০ লাখ টাকা, ১২ আগস্ট পরিশোধ করা হয় ২৫ লাখ টাকা। এ বছরের ৪ সেপ্টেম্বর পরিশোধ করা হয় ২৫ লাখ টাকা এবং ১১ নভেম্বর ২০০৩ সালে পরিশোধ করা হয় ৩৫ লাখ টাকা।

অভিযোগ রয়েছে, কথিত জমির মালিক তৈয়ব আলীর পক্ষে এই টাকা গ্রহণ করেন কোম্পানির তৎকালিন পরিচালকরা।

এ জমি দেখানো হয় সিলেটের টুকের বাজারে। জমির পরিমাণ দেখানো হয় ৪৫ শতাংশ। প্রতি শতাংশের মূল্য ধরা হয় ৩.৪০ লাখ টাকা। জমিটির মোট মূল্য দেখানো হয় ১.৩৫ কোটি টাকা। রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ খরচ দেখানো হয় ১৬ লাখ টাকা। ২০০৩ সালের ১১ জানুয়ারি জমির মালিক তৈয়ব আলীর নিকট থেকে জমি রেজিস্ট্রেশনের একটি দলিলও তৈরি করা হয়।

ভূয়া জমির ক্রয় খতিয়ে দেখতে তৎকালিন কর্তৃপক্ষ ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। চার্টার্ড একাউন্টেন্ট ফার্ম এ হক এন্ড কোং এর নিরীক্ষক এ কে এম আমিনুল হক এফসিএ’কে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। এই তদন্তে জমির কোন অস্তিস্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। বোর্ডের সকল সদস্যই এ টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন বলে দাবি করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।

জমি ক্রয় দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের অনুমোদন দেয়া সিলেটে অনুষ্ঠিত সেই ৩১তম পর্ষদ সভায় সর্বমোট ২৮ জন পরিচালক উপস্থিত ছিলেন- এর মধ্যে ৫ জন ছিলেন বিকল্প পরিচালক, ১০ জন পলিসি হোল্ডার পরিচালক ও বাকি ১১ জন উদ্যোক্তা পরিচালক।  

ওই সভায় পরিচালকদের মধ্যে উপস্থিত কাজী এনাম উদ্দিন আহমদ (চেয়ারম্যান), মো. আব্দুস শুকুর, (ভাইস-চেয়ারম্যান), ফারুক আহমেদ, মো. মাজহারুল কাদের, মো. কাওসার জাহান কয়ছর, নাফিসা সালমা, রিজিয়া সুলতানা, আবদুর রাজ্জাক, নজরুল ইসলাম কামাল মিয়া ও হোসনে আরা গণি।

৫ জন বিকল্প পরিচালকের মধ্যে ছিলেন- আব্দুর রবের পক্ষে বিকল্প পরিচালক ছিলেন আবুল ফয়েজ হক, ফয়জুল হকের পক্ষে বিকল্প পরিচালক হিসেবে ছিলেন এ এইচ এম মহসিন, কাজী ফারুক উদ্দিন আহমেদের পক্ষে বিকল্প পরিচালক ছিলেন মশিউজ্জামান খাঁন, জামাল উদ্দিনের পক্ষে বিকল্প পরিচালক ছিলেন মো. আব্দুল কুদ্দুস ও বিকল্প পরিচালক মো. মফাচ্ছিল আলী (মাসুক)।

এছাড়া পরিচালনা পর্ষদের ১০ জন পলিসি হোল্ডার পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। এরা হলেন- জয়নাল আবেদীন, মো. শামীম আহমেদ, মো. আবু তাহের খাঁন, এ কে এম জাকির হোসেন, কাজী নুরজাহান খাঁন আহমদ, মো. দেলোয়ার হোসেন তপাদার, মো. সাবের আলী খাঁন, মোহাম্মদ এনামুল হাসান, আরজ আলী খাঁন, মিস মাহিমা বেগম, সামসুন নাহার ও সাদত আলী খাঁন।  

এছাড়াও কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেদায়েতুল ইসলাম খান ওই বোর্ড সভায় উপস্থিত ছিলেন।

জমি-ই নাই, সেই জমিতে মাটি ভরাট: আত্মসাৎ ৩৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা

লাইফ বীমা কোম্পানির তহবিলের সব টাকাই গ্রাহকের। সেই টাকা আত্মসাতের এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। তবে বীমা খাতে ফারইস্ট লাইফে বালু ফেলে টাকা আত্মসাতের ঘটনায় এর আগে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। অনুসন্ধানী ওই সংবাদ প্রকাশের পর থমকে যায় গোটা বীমা খাত। পরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর তদন্তে এ ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হয়।

দুর্নীতি করে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় কারাগারে যান বীমা কোম্পানিটির চেয়ারম্যানসহ ২ পরিচালক ও সাবেক মুখ্য নির্বাহী। তার আগে ভেঙ্গে দেয়া হয় ফারইস্টের পরিচালনা পর্ষদ। ফারইস্ট ইসলামী লাইফের জমিতে বালু ফেলার টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে। আর হোমল্যান্ড লাইফের পরিচালকরা এ ঘটনা ঘটায় প্রায় ২ যুগ আগে।

এবারে মাটি ভরাট ও কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার নামে টাকা আত্মাসাৎ করা হয়েছে হোমল্যান্ড লাইফ থেকে। এ ঘটনা ২০০৮ সালের। জমি নেই অথচ সেই জমিতে মাটি ভরাট ও কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয় ৩৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এজন্য জমি দেখানো হয় টুকের বাজারের সেই অস্তিত্বহীন জমি।

এই টাকা আত্মাসাতের জন্য প্রথমে মাটি ভরাট ও কাঁটারের বেড়া দেয়ার জন্য দরপত্র আহবান দেখানো হয়। পরে ওই দরপত্রের বিপরীতে কাজ দেয়া হয় নিলয় এন্টারপ্রাইজ নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মহিউদ্দিন হোমল্যান্ড লাইফের কথিত পরিচালক মফিজ উদ্দিনের আপন ভাই।

এই টাকা আত্মাসাতের জন্য বোর্ড সভার কার্যবিবরণী ও দরপত্র এবং কার্যাদেশ সংক্রান্ত নথিপত্রগুলো তৈরি করা হয় জাল-জালিয়াতি করে।

মাটি ভরাটের নামে এই ৩০ লাখ ৭০ হাজার টাকার মধ্যে হোমল্যান্ড লাইফের সিটি ব্যাংকের হিসাব থেকে নিলয় এন্টারপ্রাইজকে দেয়া হয় ২০ লাখ টাকা। এই টাকা দেয়া হয় ২০০৪ সালের ১৯ জানুয়ারি। ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেয়া হয় অগ্রণী ব্যাংক থেকে। বাকি ২ লাখ টাকা দেয়ার কোন নথিপত্র নেই।

মাটি ভরাট দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ২৭ জানুয়ারি ২০১৬ সালে একটি কমিটি গঠন করে হোমল্যান্ডের পরিচালনা পর্ষদ। এই কমিটিতে ছিলেন মেজর অব. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, মো. জুলহাস, সালেহ হোসেন ও মো. আব্দুর রব। এই কমিটির অনুসন্ধানে টাকা আত্মাসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া হোমল্যান্ড লাইফ থেকে ৮১তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্তে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এ প্রেক্ষিতে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদাভাসীর তদন্তেও আত্মাসাতের তথ্য উঠে আসে।

পরে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর টাকা ফেরত দিতে চিঠি দেয় হোমল্যান্ড লাইফ। কিন্তু মহিউদ্দিন টাকা ফেরত না দেয়ায় প্রথমে মতিঝিল থানায় জিডি করা হয়; জিডি নং ৪৯৩/১৭। পরবর্তীতে মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং- ২৮০/১৭।

হোমল্যান্ডের গ্রাহকদের টাকা আত্মসাতের জল্লাদ হয়ে ওঠে সিলেটের জল্লার পাড়

সিলেটের জল্লার পাড়ের জমি যেন হয়ে ওঠে হোমল্যান্ড লাইফের গ্রাহকদের জন্য জল্লাদ। কখনো এই এলাকার জমি ক্রয়, জমি ক্রয়ের জন্য অগ্রিম, কখনো বা জমি ক্রয়ের জন্য দালালদের কমিশন পরিশোধ দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয় কোটি কোটি টাকা। এসব খাতে দফায় দফায় কোম্পানির তহবিল থেকে কোটি কোটি টাকা বের করার অপকর্মে জড়িত কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য পরিচালক ও তাদের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন। সহজ-সরল গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের হাতিয়ার হয়ে ওঠে জল্লার পাড়ের জমি। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য  উঠে আসে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে। 

২০০৭ সালের ২৪ জুন। সিলেটের দুর্নীতি দমন কমিশনে জনৈক সচেতন একজন নাগরিক অভিযোগ করেন, ২৫ লাখ টাকার জমি হোমল্যান্ডের নামে কেনা হয়েছে কোটি ৫০ লাখ টাকায়। মাত্র মাসের ব্যবধানে ৪০ গুণ বেশি দিয়ে হোমল্যান্ড লাইফের নামে জমি ক্রয় দেখানো হয়েছে মূলত কোম্পানির তহবিল তছরূপ করতে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, সিলেটের জল্লার পাড়ের ১২ শতাংশ একটি জমি। জমির মালিক জিন্নুরিন নাহার চৌধুরী। জিন্নুরিন নাহারের কাছ থেকে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি জমিটি কিনে নেন মুরাদ খান। জমিটি কেনা হয় ২৫ লাখ টাকায়। মুরাদ খান হোমল্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনামের শ্যালক। 

এর মাত্র মাসের মাথায় এই জমি মুরাদ খান হোমল্যান্ড লাইফের কাছে বিক্রি করেন কোটি ৫৫ লাখ টাকায়। মুরাদ খান হোমল্যান্ডের কাছে এ জমি বিক্রি করেন ১৩ মে ২০০৪ সালে।

মজার বিষয় হচ্ছে, জমির মূল্য ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ধরা হলেও জমির দলিলে মূল্য দেখানো হয় কোটি টাকা। জমির দলিলে কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্য কম দেখানো হয় সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে। এমনটাই উল্লেখ করা হয়, এই জমি ক্রয় অনুমোদন দেয়া সভার কার্যবিবরণীতে।

এখানেই শেষ নয়, জমির ক্রয়ের সাব-কবলা দলিল নেয়া হয় মুরাদ খানের কাছ থেকে। অথচ জমির মূল্য বাবদ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয় জিন্নুরিন নাহারকে। আর সেই টাকা গ্রহণ করেন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম।

এই জমি ক্রয়ের এসব অনুমোদন দেয়া হয় পরিচালনা পর্ষদের ৩৪তম সভা থেকে ৩৯তম সভা পর্যন্ত এই ৬টি সভায়। এর সবগুলো সভাই অনুষ্ঠিত হয় সিলেটের জিন্দাবাজার কাজী ম্যানশন ও সিলেটে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে।

জমিটি খাস জমি হওয়ায় পরবর্তীতে তা সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়। ফলে আজও এ জমি হোমল্যান্ড লাইফ দখলে নিতে পারেনি।

এখানেই শেষ নয়, জল্লার পাড়ের এ জমি ক্রয়ের কমিশন বাবদ কোম্পানির তহবিল থেকে তুলে নেয়া হয় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর সেই জমির সোলেনামা ডিক্রি, জমির উন্নয়ন, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার কথা বলে কোম্পানির তহবিল থেকে নেয়া হয় আরো ১৫ লাখ টাকা। এ টাকা নেন কোম্পানির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল মুনিম শিপু। এ টাকার অনুমোদন দেয়া হয় কোম্পানির ৭৭তম পর্ষদ সভায়।

কিন্তু জমি দখলের নামে টাকা নিলেও দখলের কোন কাজ করেনি আব্দুল মুনিম শিপু। এতে আব্দুল মুনিম শিপুর বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে হোমল্যান্ড লাইফ। আব্দুল মুনিম শিপু কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদের নিকটাত্মীয়।

জমি ক্রয়ের নামে টাকা আত্মসাতের এ অনুসন্ধানে সিলেট ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে রেকর্ড পত্রে দেখা যায়, জমিটি হাসন রাজার পরিবারের জিন্নুরিন নাহার রাজা চৌধুরির নামে রেকর্ড করা। এ বিষয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয়, তাছাউর রাজার সাথে।

আলাপকালে তিনি বলেন, আমাদের জমি আমাদেরই আছে। তা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। কেউ ভূয়া দলিল পত্র তৈরি করে জমি বিক্রি করেছে কিনা সে বিষয়টি আমাদের জানা নেই। যেহেতু এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোন অভিযোগ নেই, আমাদের জমি বেদখল হয় নাই। তাই এ বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই।

জমি বিক্রির নামে সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে নিলেন ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা

হোমল্যান্ড লাইফের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনামের ছেলে আরাফাত কাজী। থাকেন লন্ডনে। বয়স ১৬ বা ১৭ বছর। লন্ডনে থাকা এই কাজী আরাফাতের কাছ থেকেই জমি বিক্রির প্রস্তাব এসেছে। এই প্রস্তাব অনুমোদন করা হয় ৩৮তম বোর্ড সভায়। জমি কেনার অগ্রিম বাবদ ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকার পরিশোধের অনুমোদনও করা হয় ওই সভায়।

পরে জমির মূল্য বাবদ নেয়া টাকা ফেরত দিতে কাজী আরাফাতের পক্ষ থেকে ২ কোটি ২০ লাখ টাকার একটি চেক দেয়া হয় হোমল্যান্ড লাইফকে। পরে চেকটি নগদায়ন না হওয়ায় ২০০৫ সালে কাজী আরাফাতের বিরুদ্ধে এনআই এক্ট -এ মামলা করেন হোমল্যান্ড লাইফের কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম।

মামলায় আরাফাত কাজী দোষী প্রমাণিত হওয়ায় ২ কোটি ২০ লাখ টাকা ফেরত দেয়ার আদেশসহ ১ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এই রায়ের পর আরাফাত কাজী ৬ মাস জেল খেটে জামিন নেন। পরে আবারও বিদেশে চলে যান তিনি।

ওই মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছিল, জমি বিক্রির নামে কাজী আরফাতের পিতা হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রাক্তন চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন কোম্পানি থেকে বিভিন্ন সময়ে বায়নামা বাবদ ২ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেন।

এই টাকা হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স পরিশোধ করে ২০০৪ সালের ১১ মে থেকে একই বছরের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সর্বমোট ২৮টি কিস্তিতে। কাজী আরফাতের পক্ষে এ টাকা গ্রহণ করেন তার পিতা হোমল্যান্ড লাইফের তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদ।

অভিযোগে বলা হয়, টাকা গ্রহণের প্রতিটি ভাউচারে কাজী এনামের স্বাক্ষর রয়েছে।

মামলায় আরো অভিযোগ করা হয়, কোম্পানির পক্ষ থেকে আরাফাত কাজীকে জমি রেজিস্ট্রি দেয়ার চাপ দিলে আরাফাত কাজী জমি রেজিস্ট্রি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ সময়ে কাজী এনাম উদ্দিনের মধ্যস্থতায় ৫ লাখ টাকা লাভ ধরে টাকা পরিশোধের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

আরাফাত কাজী ২০০৪ সালে ২৯ ডিসেম্বর ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের সিলেট শাখার হিসাব নং ৩৩১১৫২০৬ এর অধীনে ২ কোটি ২০ লাখ টাকার একটি চেক প্রদান করেন, যার নং- ৬৩৮০৩৩৪।

চেকটি ডিজঅনার হয় ৪ এপ্রিল ২০০৫ তারিখে। নগদায়ন না হওয়ার বিষয়টি আরাফাত কাজীকে জানানো হয় ২০০৫ সালের ৭ মে। ১১ মে ২০০৫ সালে পাঠানো হয় উকিল নোটিশ।

জল্লার পাড়ের জমি ক্রয় দেখিয়ে তহবিল আত্মসাতের ঘটনায় ১৩ এপ্রিল ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত কোম্পানির ৬৬তম বোর্ড সভায় একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন- তৎকালীন চেয়ারম্যান ফয়জুল হক, সাবেক পরিচালক মো. মোসলে উদ্দিন ঢালী এবং এ হক এন্ড কোং এর নিরীক্ষক আমিনুল হক এফসিএ।

এই কমিটি ৮ জুলাই ২০১০ সালে দাখিল করা প্রতিবেদনে জল্লার পাড়ের জমি ক্রয়ের নামে চরম আর্থিক অনিয়ম হয়েছে বলে মতামত দেন। এ প্রতিবেদন দাখিল করেন চার্টার্ড একাউন্টস এ হক এন্ড কোং এর নিরীক্ষক আমিনুল হক এফসিএ।

তবে ২০১১ সালে আরাফাত কাজীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সিলেটে তার নিজ বাড়িতে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের।

কাজী ভবনের ড্রয়িং রুমে বসে এই আলাপচারিতায় আরাফাত কাজী বলেন, হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সে যখন এ ঘটনা ঘটে তখন আমার বয়স ছিল ১৬/১৭ বছর। আমি এ সময়ে লণ্ডনে ছিলাম। এখন আপনারাই বলেন, একজন ১৬/১৭ বছরের ছেলে এতগুলো টাকা একটি লিমিটেড কোম্পানি থেকে তুলে নিবে এরকম ঘটনা কি স্বাভাবিক? আমি হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে কোন টাকা নেইনি। আমি জমিও রেজিস্ট্রি দেইনি। ২ কোটি ২০ লাখ টাকার যে চেক দেয়ার কথা বলা হয়েছে এ চেকটিও আমি দেইনি। এ চেকের স্বাক্ষর আমার নয়।

আরাফাত কাজী আরো বলেন, এ সময় আমি লন্ডনে ছিলাম। আমার বাবার অফিস রুম সেগুন বাগিচার গেস্ট হাউস থেকে এ চেকটি তারা সংগ্রহ করে থাকতে পারে? কোম্পানির নামে সেগুন বাগিচায় একটি গেস্ট হাউজ ছিল এখানে আমার বাবা এসে থাকতেন। এই গেস্ট হাউজে আমার ব্যাংকের চেক ছিল, কাগজপত্র ছিল। আমি জমি রেজিস্ট্রি দেইনি। আমার নামের জমি অন্য কেউ রেজিস্ট্রি দিয়েছে।

তিনি বলেন, এ সময় কোম্পানির লন্ডনে যেসব ডিরেক্টর আছেন এবং পরিচালনা পর্ষদে যারা ছিলেন তাদের মাঝে একটি ভালো সম্পর্ক ছিল। একারণে আমি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে এ অভিযোগ এনে আইনের আশ্রয় নেইনি।

তিনি আরো বলেন, আমাদের মধ্যে একটা আলোচনা হয়েছিল যারা এ টাকা নিয়েছে তারা কোম্পানিকে টাকাগুলো ফেরত দিবে। টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলায় তারা আমার বিরুদ্ধে মামলা করে। আমার বাবা লণ্ডনে যে সব ডিরেক্টররা আছেন তাদের চাপে এ টাকা কোম্পানি থেকে নিয়েছে। কোম্পানি থেকে এই টাকা তোলার বিষয়ে আগে থেকেই ডিরেক্টরদের মাঝে আলোচনা হয় আমার বোনের বিয়ের পর আমাদের একটি পারিবারিক পার্টিতে ৪ জুলাই ২০০৪ এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেন লন্ডনের প্রবাসী ডিরেক্টররা।

অগ্রিম বাবদ কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদের আত্মসাৎ ২.১০ কোটি টাকা

এবার জমি ক্রয় করা হবে সিলেট শহরে। এ জমি কিনে দেয়ার নাম করে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদ কোম্পানির তহবিল থেকে অগ্রিম নেন ২ কোটি ১০ লাখ টাকা। কিন্তু এ জমি আর কেনা হয়নি। অগ্রিম বাবদ নেয়া টাকাও থেকে যায় এনাম আহমেদের পকেটেই।

জমি কেনার জন্য অগ্রিম নেয়ার এ ঘটনা ধরা পরে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান একনাবিনের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। একনাবিনের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, সিলেটে জমি কেনার অগ্রিম বাবদা প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ২ কোটি ১০ লাখ টাকা অগ্রিম নিলেও কোম্পানির নামে তিনি কোন জমি রেজিস্ট্রি করে দেন নাই।

পরবর্তীতে ২০১২ সালের ১৮ জানুয়ারি কোম্পানির নির্বাহী কমিটির ২৭৯তম সভায় এ টাকা কাজী এনামের নামে অগ্রিম দেখানোর সিদ্ধান্ত হয়।

ব্যাংক হিসাবে ১৬ কোটি টাকা ঘাটতি

হোমল্যান্ড লাইফের আর্থিক অনিয়ম খতিয়ে দেখতে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ করেন হোমল্যান্ড লাইফ কর্তৃপক্ষ। এই বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ করা হয় ২০১০ সালে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ওঠে আসে ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংক হিসাবে ১৬ কোটি টাকা ঘাটতির তথ্য।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ব্যাংক বইয়ে যে টাকা জমা দেখানো হয়েছে, ব্যাংক স্টেটমেন্টে ওই পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়নি।

পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হোমল্যান্ড লাইফের নিরীক্ষা, বিনিয়োগ ও দাবি কমিটির ৭ম ও ৮ম সভায় অডিট রিপোর্ট উপস্থাপিত হলে ব্যাংক স্টেটমেন্টে এই ১৬ কোটি টাকা ঘাটতির বিষয়টিকে আত্মসাৎ বলে মনে করে সভা। একইসাথে এই টাকা আত্মসাতের সাথে কোম্পানির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ ও উর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হয়। তবে এ টাকা উদ্ধারে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয় নাই।

শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগে লোকসান ৫.১১ কোটি টাকা

২৯তম সিএমআই মিটিংয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৭ সালের ২১ মার্চ নির্বাহী কমিটির ৩৪৯তম সভায় এবং এর ধারাবাহিকতায় পর্ষদ সভায় কোম্পানির স্থায়ী আমানত নগদায়ন করে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজে ৫ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৬৪৯ টাকা বিনিয়োগ করা হয় এবং সেখানে কোম্পানির লোকসান ৩ কোটি ৮৭ লাখ ৫৬ হাজার ৬৪৯ টাকা। লংকা বাংলা সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা হয় ২ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং সেখানে ক্ষতির পরিমাণ ১ কোটি ২৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

পল্লী-পারিবারিক বীমায় অতিরিক্ত ঋণ প্রদান ৩৪.৩২ লাখ টাকা

১৯৯৮ সালের ১৯ জুলাই পর্যন্ত হোমল্যান্ড লাইফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিবের দায়িত্বে ছিলেন মোসলেহ উদ্দিন ঢালী। তিনি কোন প্রকার যাচাই-বাছাই না করে ৩৪ লাখ ৩২ হাজার ১শ’ টাকা ঋণ বিতরণ করেন, যা আদায় হয়নি।

বীমাপত্রের সারেন্ডার ভ্যালু বিবেচনায় না নিয়েই এ ঋণ দেয়া হয়। এছাড়াও ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত সময়ে তৎকালিন কোম্পানি সচিব মোসলেহ উদ্দিন ঢালী ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেই ১৪ লাখ ৬৬ হাজার ৬ টাকা ঋণ প্রদানের নামে আত্মসাৎ করেন। ঋণের নামে আর্থিক অনিয়ম করে আত্মসাতের এ তথ্য উঠে আসে হুদাভাসী চৌধুরী এন্ড কোং এর বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।

গ্রাহকের টাকায় পরিচালককে গাড়ি উপহার

আইন অনুসারে কোম্পানির চেয়ারম্যান একটি গাড়ি পান। কিন্তু হোমল্যান্ড লাইফে একটি জিপ গাড়ি (নং- ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৪-১০২৫) দেয়া হয় একজন পরিচালককে। এই গাড়িটি দেয়া হয় উপহার হিসেবে। উপহার দেয়ার এই ঘটনা ঘটে ফয়জুল হক চেয়ারম্যান থাকাকালে। গাড়ি উপহার দেয়ার এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ২৪ এপ্রিল ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত কোম্পানির ৫৫তম পর্ষদ সভায়। গাড়িটি উপহার দেয়া হয় তৎকালীন পরিচালক আবদুস শুকুরকে।

আইন ভঙ্গ করে কোম্পানির পরিচালককে গাড়ি উপহার দেয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে হুদাভাসী চৌধুরী এন্ড কোং এর বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে গাড়িটি ফেরত আনার সুপারিশ করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানির ৮৬তম পর্ষদ সভায় গাড়ি ফেরত আনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন চেয়ারম্যান সালেহ হোসেন আবদুস শুকুরের ওয়ারিশদেরকে গাড়িটি ফেরত দেয়ার জন্য চিঠি দেন। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল আবদুস শুকুরের ছেলে (বর্তমান পরিচালক) মো. শামিম আহমেদ কোম্পানির মালিকানায় গাড়িটি ফেরত দেন।

গাড়ি উদ্ধারে গঠিত পরিচালনা পর্ষদের উপ-কমিটির প্রতিবেদনে নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে অবৈধভাবে একজন পরিচালককে গাড়ি উপহার দেয়ার জন্য তৎকালীন চেয়ারম্যান ফয়জুল হক ও গাড়ি প্রদানের প্রস্তাবকারী আবদুল আহাদকে দায়ী করা হয়।

তবে ৮৫তম পর্ষদ সভায় উপহার হিসেবে গাড়ি প্রদানের বিষয়টি অস্বীকার করেন তৎকালীন চেয়ারম্যান ফয়জুল হক।

প্রবাসী পরিচালকরা বাংলাদেশি বিনিয়োগকারি নাকি প্রবাসী বিনিয়োগকারি!

হোমল্যান্ড লাইফের অধিকাংশ পরিচালকই সিলেটের লন্ডন প্রবাসী; ব্রিটিশ নাগরিক। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে হোমল্যান্ড লাইফে তাদের বিনিয়োগ নিয়ে। তারা কীভাবে এ বিনিয়োগ করেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রবাসী এসব পরিচালক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন বাংলাদেশি টাকায়। পে-অর্ডার ও নগদ চেকের মাধ্যমে তারা মূলধনের টাকা কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে জমা করেন। সর্বশেষ কোম্পানির মূলধন ১৮ কোটি টাকায় উন্নীত করার জন্য প্রবাসী পরিচালকরা তাদের নিজ নিজ অংশের টাকা কোম্পানির ফান্ডে জমা করেন।

এর মধ্যে কোম্পানির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন তার নিজ অংশের ৩৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩শ’ টাকা ২টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে কোম্পানির তহবিলে জমা করেন। ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কোম্পানির ফান্ডে জমা করেন ২০ লাখ টাকা। যমুনা ব্যাংকের পে-অর্ডার নং- ৮০৭২৯৮৫, তারিখ- ২৯ সেপ্টেম্বর- ২০১৯। বাকি ১৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩শ’ টাকা জমা করেন ১৭ নভেম্বর। যমুনা ব্যাংক, পে-অর্ডার নং- ৮০৭২৯৮৬।

প্রবাসী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক পরিশোধিত মূলধনের নিজ অংশের ৩৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩শ’ টাকার মধ্যে ১২ লাখ টাকা কোম্পানির তহবিলে জমা করেন ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর। যমুনা ব্যাংকের পে-অর্ডার নং- ৯৪৮২৩১১। বাকি ২৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩শ’ টাকা জমা করেন ২৮ জানুয়ারি ২০২০ সালে; যমুনা ব্যাংকের পে-অর্ডার নং- ৯৪৮২৩১২।

একইভাবে প্রবাসী অন্যান্য পরিচালক তাদের পরিশোধিত মূলধনের অংশ কোম্পানির তহবিলে জমা করেন পে-অর্ডারের মাধ্যমে।

অভিযোগ রয়েছে, হোমল্যান্ড লাইফের প্রবাসী এসব পরিচালক হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে টাকা নিয়ে আসেন। প্রবাসী পরিচালকদের বাংলাদেশে কোন ব্যবসা নেই। তবে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পক্ষ থেকে অভিযোগটির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে হোমল্যান্ড লাইফের পরিচালকদের সাথে মোবাইল ফোন ও হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। হোয়াটস অ্যাপে পাঠানো মেসেজ দেখার পরও তারা এ বিষয়ে কোন সাড়া দেননি।

তবে কোম্পানিটির পরিচালক শামিম আহমেদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানে ব্যস্ত আছেন উল্লেখ করে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, যেসব ঘটনার অভিযোগ আনা হয়েছে তা অনেক আগের। আমি যতদূর জানি, এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো তদন্ত করছে। তাই এসব বিষয়ে আমার মন্তব্য করার সুযোগ নেই।