ব্যবস্থাপনা ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কায় বীমা খাত, কঠোর অবস্থানে আইডিআরএ

আবদুর রহমান আবির: ডলার সংকট, আমদানী নিয়ন্ত্রণ, মূল্যস্ফীতির কারণে প্রিমিয়াম আয় কমে গেছে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর। অপরদিকে জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে লাইফ বীমাতেও প্রিমিয়াম আয় কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যয় হার বৃদ্ধির আশঙ্কা করছে বীমা কোম্পানিগুলো।

তাদের মতে, প্রিমিয়াম আয় কমে গেলে ব্যয় বেড়ে যায়। এর কারণ কোম্পানির নির্ধারিত কিছু খরচ আছে যা ইচ্ছা করলেই কমানো যায় না। এই স্থায়ী খরচের প্রভাব পরে কোম্পানির ব্যয় হারের ওপর।

অপরদিকে অতিরিক্ত ব্যয় কমাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। সংস্থাটি ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ব্যয় হার পর্যালোচনা করে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় করা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ব্যয়ের তথ্য পাঠাতে কোম্পানিগুলোকে চিঠি দিয়েছে আইডিআরএ।

সংস্থাটি মনে করছে, অতিরিক্ত ব্যয়ের আড়ালে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের ঘটনা থাকতে পারে। লাইফ বীমা খাতে বেশ কিছু কোম্পানি ব্যয় বেশি করার কারণে গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। তাই গ্রাহক স্বার্থে ব্যয় কমাতে যেকোন ধরণের ব্যবস্থা নেবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। প্রয়োজনে অতিরিক্ত ব্যয়ের নামে টাকা আত্মসাৎ বা মানিলন্ডারিং হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে সরকারের অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমন্বয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেবে বীমা খাতের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো বলছে, চলতি বছরে ডলার সংকট, আমদানী নিয়ন্ত্রণের কারণে এলসি কমে যাওয়ায় প্রিমিয়াম আয় কমে গেছে। কিন্তু বাড়ি, ভাড়া, বেতন-ভাতা জাতীয় এমন কিছু খরচ রয়েছে যা কমবে না। ফলে তাদের ব্যয় হার বাড়বে।

লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো বলছে, দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা, জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ হাতে টাকা গচ্ছিত রাখছে। তারা বীমা পলিসির কিস্তি দিতে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে প্রিমিয়াম আয় কমে যাবে। কিন্তু নির্ধারিত খরচ থাকবে আগের মতোই। যার প্রভাব পড়বে ব্যয় হারে।

তারা মনে করেন, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্তে আসা।

লাইফ ও নন-লাইফ বীমা খাতের কয়েকটি কোম্পানির ২০২২ ও ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকের প্রিমিয়াম সংগ্রহ পর্যালোচনা করে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মিশ্র অবস্থা দেখা গেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থায় দাখিল করা কোম্পানিগুলোর ত্রৈমাসিক তথ্য দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে এই পর্যালোচনা করা হয়।

এতে দেখা যায়, ৫টি লাইফ বীমা কোম্পানির মধ্যে ২টি কোম্পানির প্রিমিয়াম সংগ্রহ প্রায় ৩২ থেকে ৪০ শতাংশ কমেছে। আর ৩টি কোম্পানির প্রিমিয়াম সংগ্রহ ৩ থেকে ৩৬ শতাংশ বেড়েছে।

অপরদিকে ৫টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির মধ্যেই ২টি কোম্পানির গ্রস প্রিমিয়াম সংগ্রহ এক থেকে ৯ শতাংশ কমেছে। তবে মেরিন প্রিমিয়াম সংগ্রহের ক্ষেত্রে ১টি কোম্পানির আয় কমেছে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। আর বেড়েছে ৪টি কোম্পানির, ৩ থেকে ৩৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ও জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, ডলার সংকটকে কেন্দ্র করে বর্তমানে দেশে কিছুটা মূল্যস্ফীতি চলছে। আবার সামনে রয়েছে জাতীয় নির্বাচন। সাধারণত নির্বাচনী বছরে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুটা কম হয়। তাছাড়া শেয়ার বাজারের পরিস্থিতিও কিছুটা অস্থিতিশীল।

এসব কারণে বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য বা মুনাফা পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে জেনারেটর বা আইপিএস ক্রয় ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত খরচের নতুন খাত তৈরি হয়েছে; যা বীমা কোম্পানিগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ব্যয় কিছুটা বৃদ্ধি করতে পারে বলেই আমাদের আশঙ্কা, বলেন এস এম নুরুজ্জামান।

তিনি আরো বলেন, নবায়ন প্রিময়াম সংগ্রহ কমে গেলে কোম্পানিগুলোর খরচের হার বেড়ে যাবে। আর খরচ বাড়লে কোম্পানিগুলো নতুন ফান্ড তৈরি করতে পারবে না। এমনকি পুরনো ফান্ড থেকে কোম্পানিগুলোর খরচ বহন করতে হতে পারে। ফলে কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধে সমস্যায় পড়তে পারে।

রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খালেদ মামুন বলেন, ডলারের মূল্য উঠা-নামা একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। ডলারের মূল্য বাড়লে আমাদের খরচ কিছুটা বৃদ্ধি পায়। আবার ব্যবসা কমে গেলেও কোম্পানির খরচের হার বেড়ে যায়; এটা স্বাভাবিক বিষয়। এর কারণটা হলো- কোম্পানিগুলো ফিক্সড কস্ট বা স্থায়ী খরচ। ব্যবসা কম হোক বা বেশি, স্থায়ী খরচ সব সময় একই থেকে যায়।

তবে আমাদের কোম্পানির (রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স) সার্বিক ব্যবসা বেড়েছে। ফলে আমাদের খরচের হার বাড়েনি। যদিও মেরিন ব্যবসা কিছুটা কমেছে। তবে এই কমে যাওয়া আমাদের কোম্পানিতে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাছাড়া আমরা কাউকে অতিরিক্ত কমিশন দেই না। তাই খরচের হার বৃদ্ধির শঙ্কাও আমাদের নেই। বরং অতিরিক্ত কমিশন না দেয়ায় আমাদের কোম্পানির প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বাড়ছে এবং এ কারণে আমাদের ব্যবসাও বাড়ছে।

সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শফিক শামীম বলেন, নন-লাইফ বীমায় ব্যবসার ধরণের ওপর ভিত্তি করে কমিশন নির্দিষ্ট করা আছে। কিন্তু বাজারে কোম্পানির সংখ্যা বেশি হওয়ায় কমিশন নিয়ে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিরাজমান আছে। এক কোম্পানি আরেক কোম্পানির ব্যবসা ধরতে গিয়ে অবৈধভাবে অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে আসছে। যার ফলে কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় এমনিতেই বেশি। তারওপর বর্তমান সময়ে নানান কারণে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর মেরিন ব্যবসা কমছে। ফলে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হার বেড়ে যাচ্ছে।

তবে ব্যবসা সংগ্রহের এই অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা বন্ধ করে কমিশন প্রদানের হার নিয়মের মধ্যে আনতে পারলে ব্যয় বৃদ্ধির চাপ অনেকটাই কমানো সম্ভব। আমার কোম্পানি (সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্স) ব্যয়সীমার অনেক নিচে খরচ করে আসছে ফলে ব্যবসা কমলে ব্যয় বৃদ্ধির যে আশঙ্কা সেটি আমাদের নেই। এভাবে সব কোম্পানি নিয়মের মধ্যে ফিরে আসলে আশা করি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম জিয়াউল হক বলেন, মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা হ্রাস পেলে বীমা কোম্পানিগুলোর পলিসি বিক্রি কমে যায় এবং পলিসি সারেন্ডার ও তামাদির হার বেড়ে যায়। বর্তমান মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এ বছর বীমা কোম্পানিগুলোর সামনে দু’টি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে- মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় নির্বাচন।

তিনি বলেন, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে বছরের প্রথম তিনটি প্রান্তিকেই কোম্পানিগুলোর ব্যবসা আহরণ প্রায় সম্পন্ন করতে হবে, বাকী তিন মাসে যা আসবে সেটাই প্রবৃদ্ধি। কারণ, সেপ্টেম্বরের পরে দেশের পরিস্থিতি কেমন হবে সেটা বোঝা কঠিন। তবে নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে নানান কারণেই ব্যবসা-বাণিজ্য কম হয়। একইসঙ্গে ব্যবস্থাপনা খরচ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে।