মালিক- কর্মকর্তাদের প্রিমিয়াম বকেয়া ১৯ কোটি

১২ লাখ টাকার গাড়ি ৩ লাখ টাকায় বিক্রি করেছে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স

বিশেষ প্রতিবেদন: এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের ২০০৭ মডেলের টয়োটা রাস গাড়ি বিক্রি করা হয়েছে ৩ লাখ টাকায়। অথচ গাড়িটির বাজার মুল্য ১২ লাখ টাকা। এছাড়া কোম্পানির আরো ৩টি গাড়ি বিক্রি করা হয় নাম মাত্র মুল্যে। গাড়িগুলো বিক্রির অনুমোদন করা হয় চলতি বছরের ১৫মে অনুষ্ঠিত ১৯৫তম এক্সিকিউটিভ কমিটির সভায়।

এছাড়া আইন লঙ্ঘন করে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পরিচালক, কর্মকর্তা, ব্রাঞ্চ ও ইউনিটগুলোর কাছে ১৮ কোটি ৮৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার প্রিমিয়াম বকেয়া রেখেছে। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, বীমা কোম্পানির গাড়ি কোম্পানির সম্পদ। বীমা কোম্পানিগুলো প্রয়োজন অনুসারে পুরনো গাড়ি বিক্রি করে দেয়। গাড়ি বিক্রির টাকা কোম্পানির তহবিলে জমা হয়। সেক্ষেত্রে বাজার দামের চেয়ে কম দামে বিক্রি করা হলে কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তবে এ ধরনের ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনা পর্ষদের কেউ বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

অপর দিকে আইনে প্রিমিয়াম বকেয়া রাখার কোনো সুযোগ নেই। তাদের মতে, প্রিমিয়াম বকেয়া দেখিয়ে কোম্পানির তহবিলের টাকা তছরুপ করা হয়েছে কিনা নিয়ন্ত্রক সংস্থার তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের ১৯৫তম এক্সিকিউটিভ সভার কার্যবিবরণীর তথ্য অনুসারে, গাড়িগুলো বিক্রির জন্য গত ৩০ মার্চ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দরপত্র আহবান করা হয়। এতে গাড়ি ক্রয়ের জন্য ১২টি দরপত্র জমা পরে। এসব গাড়ি ক্রয়ের সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে নির্বাচিত হয় মেসার্স টম কারস।

সূত্র মতে, এক্সিকিউটিভ কমিটির ওই সভায় কোম্পানির ৪টি গাড়ি বিক্রি অনুমোদন করে। এর মধ্যে ২০০৭ মডেলের সিলভার রংয়ের টয়োটা রাস গাড়িটি বিক্রির অনুমোদন করা হয় ৩ লাখ টাকায়। গাড়ির রেজিস্টেশন হয় ২০০৮ সালে। গাড়ি নাম্বার ঢাকা মেট্রো: ঘ-১১-৯৯৪৬।

বর্তমান বাজারে টয়োটা রাস গাড়ির মুল্যের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়া হয়। অনলাইনে পুরোনো গাড়ির বিক্রির ওয়েব সাইটে গিয়ে দেখা যায়, বিক্রয় ডট কম এ টয়োটা রাস ২০০৭ মডেলের একটি সিলভার রংয়ের গাড়ির দাম দেয়া হয়েছে ১২ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

বিক্রয় ডটকমে ওয়েব সাইটে দেয়া গাড়ি বিক্রেতার নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান গাড়িটি ১২ লাখ টাকায় বিক্রি করবেন।

এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের ওই সভায় ২০০৪ মডেলের টয়োটা এক্স করোলা ২টি গাড়ি বিক্রির অনুমোদন করা হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। গাড়ি নাম্বার ঢাকা মেট্রো: গ-২৩-৫৯৬২ ও ঢাকা মেট্রো: গ-১৯-৯৮২২।

বিক্রিয় ডটকমে ২০০৪ মডেলের টয়োটা এক্স করোলা গাড়িগুলোর বিক্রয় মুল্য দেয়া হয়েছে ১১ লাখ টাকা থেকে ১২ লাখ টাকার মধ্যে। আর ২০০৩ সালের মডেলের এক্স করোলা গাড়ির বিক্রয় মুল্য দেয়া হয়েছে ৯ লাখ ১১ লাখ টাকা।

প্রিমিয়াম বকেয়া ১৮ কোটি ৮৫ লাখ

আইন অনুসারে প্রিমিয়াম বকেয়া রেখে পলিসি ইস্যু করা অবৈধ। প্রিমিয়ামের টাকা নগদায়ন না হওয়া পর্যন্ত বীমা পলিসি সংক্রান্ত কোনো নথি পত্র হস্তান্তর করাও অবৈধ।

অথচ গেল অক্টোবর পর্যন্ত এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের প্রিমিয়াম বকেয়া রয়েছে ১৮ কোটি ৮৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এই তথ্য কোম্পানিটির বকেয়া প্রিমিয়ামের হিসাব বিবরণীর।

প্রিমিয়াম বকেয়ার হিসাব বিবরণী অনুসারে, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের পরিচালকদের প্রিমিয়াম বকেয়া আছে ৩ কোটি ৮০ লাখ ৩১ হাজার ১শ’৭ টাকা। এর মধ্যে কোম্পানির চেয়ারম্যান আমির হামজা সরকারের বকেয়া ৬৭ লাখ ৮২ হাজার ৭শ’৪৮ টাকা, ভাইস চেয়ারম্যান মাজাকাত হারুনের বকেয়া ৯১ লাখ ৯৫ হাজার ৩শ’৪৫ টাকা, পরিচালক আসিফুর রহমানের বকেয়া ৭৮ লাখ ১ হাজার ১শ’৩৯ টাকা, লুৎফুল বারীর বকেয়া ১ কোটি ২৮ লাখ ৮২ হাজার ২শ’৫৯ টাকা, মাহফুজা ইউনুসের বকেয়া ৮৭ হাজার ১শ’৯৭ টাকা, এবিএম কায়সারের বকেয়া ৩১ হাজার ১শ’১৮ টাকা, মরিয়ম আখতারের বকেয়া ১২ লাখ ৫১ হাজার ৩শ'১ টাকা।

উল্লেখ্য, আইন অনুসারে বীমা কোম্পানির পরিচালকরা তাদের নিজম্ব অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মোট প্রিমিয়ামের ২৫ শতাংশ নিজস্ব বীমা প্রতিষ্ঠানে বীমা করতে পারেন।

বকেয়া প্রিমিয়ামের হিসাব বিবরণী অনুসারে, কোম্পানিটিতে ৩২টি ব্রাঞ্চে প্রিমিয়াম বকেয়া রয়েছে ৯ কোটি ৫৫ লাখ ১৭ হাজার ৮শ’৩৭ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রিমিয়াম বকেয়া রয়েছে মতিঝিল ব্রাঞ্চে। এই ব্রাঞ্চের দায়িত্বে আছেন কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন। ব্রাঞ্চটির চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট বকেয়া ১ কোটি ২৭ লাখ ৭১ হাজার ২শ’৮ টাকা।

অন্যান্য ব্রাঞ্চগুলোর মধ্যে প্রগতি স্মরনী ব্রাঞ্চের বকেয়া ৮১ লাখ ৩৪ হাজার ৫৫ টাকা। দিলকুশা ব্রাঞ্চের প্রিমিয়াম বকেয়া ৫২ লাখ ২৫ হাজার ১শ’৭৬ টাকা। এই ব্রাঞ্চের ইনচার্জ এসিসটেন্ট এমডি সাইদুর রহমান। গুলশান ব্রাঞ্চের বকেয়া ৪৯ লাখ ৭ হাজার ৬শ’৫৬ টাকা।

কাকরাইল ব্রাঞ্চের বকেয়া ৪৮ লাখ ৭১ হাজার ৩শ’৫৩ টাকা। এই ব্রাঞ্চের ইনচার্জ কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বদিউজ্জামান লস্কর। রামপুরা ব্রাঞ্চে প্রিমিয়াম বকেয়া ৪৫ লাখ ৭৯ হাজার ৯শ’৮ টাকা। জুবিলি রোড ব্রাঞ্চের বকেয়া ৪৪ লাখ ৮৭ হাজার ৪শ’৮১ টাকা। এই ব্রাঞ্চের ইনচার্জ আলী সারোয়ার টিটু্।

এছাড়া বাকি অন্যান্য ব্রাঞ্চগুলোর প্রিমিয়াম বকেয়ার পরিমাণ ৩০ লাখ টাকার নিচে।

কোম্পানির ২২ টি ইউনিটের বকেয়া প্রিমিয়াম ২ কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার ২শ’২৩ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকেয়া ১৭ নং ইউনিটের। বকেয়ার পরিমাণ ৪৫ লাখ ৭ হাজার ১শ’৭১ টাকা। এই ইউনিটের দায়িত্বে আছেন কোম্পানির ইভিপি শেখ আব্দুল হালিম।

অভিযোগ রয়েছে, প্রধান কার্যালয়ে ৬টি ইউনিট পরিচালিত হয় ডামি ইনচার্জদের দিয়ে। এই ইউনিটগুলো পরিচালিত হয় কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বদিউজ্জামান লস্করের নেতৃত্বে। বকেয়া প্রিমিয়ামের হিসাব বিবরণীতে এই ৬টি ইউনিটের সাংকেতিক চিহ্ন হিসেবে “বি.এল” উল্লেখ করা হয়েছে।

এই ৬টি ইউনিটের অক্টোবর পর্যন্ত মোট বকেয়ার পরিমাণ ৪৩ লাখ ৯২ হাজার ৭শ’৪৮ টাকা। এর মধ্যে ইউনিট- ৬ এর প্রিমিয়াম বকেয়া ১৪ লাখ ৫৩ হাজার ৮শ’৯৮ টাকা। এই ইউনিটের ইনচার্জ ফাহমিদা জাহান পলি। তিনি কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (ইভিপি) ।

ইউনিট- ৯ এর বকেয়া ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৫শ’৫৩ টাকা। ইনচার্জ জিয়াউর রহমান মজুমদার তিনি কোম্পানির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসইভিপি) ।

কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট শারমিন মুসতারী দায়িত্বে আছেন ইউনিট- ১৬ এর। এই ইউনিটের বকেয়া ৬ লাখ ১৭ হাজার ১শ’১১ টাকা।

জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ রেজার ইউনিট- ২১ এর বকেয়া ৩ লাখ ২৪ হাজার ৫শ’২৪ টাকা। ইউনিট- ২২ এর বকেয়া ৮ লাখ ৫৩ হাজার ৬শ’৬২ টাকা। এই ইউনিটের ইনচার্জ কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসিরুল ইসলাম।

বকেয়া প্রিমিয়ামের হিসাব বিবরণীতে, অন্যান্য শিরোনামে ৪১ জন ব্যক্তির নামে বকেয়া প্রিমিয়াম দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ২শ’১৫ টাকা। অন্যান্য এই খাতটিতে সবচেয়ে বেশি বকেয়া কোম্পানির অতিরিক্ত পরিচালক বদিউজ্জামান লস্করের নামে বকেয়া রয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

বকেয়া প্রিমিয়ামের হিসাব বিবরণীতে, অন্যান্য শিরোনামে সানজিনা খানের নামে বকেয়া প্রিমিয়ামের পরিমাণ ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার ৩শ’১৯ টাকা। তবে এই নামের সাথে কোম্পানির ডিএমডি নাগিবুর রহমান খানের নামও ব্রাকেটে উল্লেখ রয়েছে।

এছাড়া, আবুল কালামের নামে বকেয়া ১৬ লাখ ৭৪ হাজার ২শ’১৮ টাকা। তবে আবুল কালামের নামের পাশে কোম্পানির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদীনের নাম উল্লেখ রয়েছে।

বারিধারা ব্রাঞ্চের নাজমুল হাসানের নামে বকেয়া ২০ লাখ ১৭ হাজার ৭শ’৩৮ টাকা। বাকি অন্যান্য নামে বকেয়া ১০ লাখ টাকার নিচে।

এসব বিষয়ে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা চলতি দায়িত্ব মো. আনোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোম্পানির সেক্রেটারি মো, মহিউদ্দিন খন্দকারের সাথে আলাপ করতে বলেন।

মো. মহিউদ্দিন খন্দকার এই প্রতিবেদককে বলেন, এসব বিষয় আপনার জানার প্রয়োজন কি? তা আমি বুঝতে পারছি না। আইডিআরএ এসব বিষয় জানতে চাইলে আমরা তার জবাব দিব। তিনি আরো বলেন, আমরা বাকি ব্যবসা করি না। তবে অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকরা আমাদের চেক দেয়, যা এক দুদিনের মধ্যে নগদায়ন হয়। গ্রাহকদের সাথে ব্যবসায়ীক সম্পর্কের স্বার্থে তারা হয়ত আগেই পলিসি ডকুমেন্টস দিয়ে দেয়। সব কোম্পানি যেভাবে করে আমরাও সেভাবেই করি। তিনি জানান তিনি এক বছর আগে এই কোম্পানিতে এসেছেন।