রাজনৈতিক পটপরিবর্তন-ভয়াবহ বন্যা: ব্যবসা কমছে লাইফ বীমায়, বাড়ছে খরচ
আবদুর রহমান আবির: সম্প্রতি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ১১টি জেলায় ভয়াবহ বন্যা এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের লাইফ বীমা খাতে। এরইমধ্যে কোম্পানিগুলোর নতুন প্রিমিয়াম আয় আগের বছরের তুলনায় অনেকটাই কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হার বৃদ্ধির আশঙ্কা করছে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো।
তবে লাইফ বীমার প্রিমিয়াম আয় কতোটা কমতে পারে এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয় কী পরিমাণ বাড়তে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত কোন তথ্য দিতে পারেনি এ খাতের কোম্পানিগুলো।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লাইফ বীমা কোম্পানির ব্যবসা বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত থাকে খরচের নির্ধারিত লিমিট তথা অনুমোদিত ব্যয়সীমা। এক্ষেত্রে প্রিমিয়াম আয় কমে গেলে কোম্পানির খরচের নির্ধারিত লিমিট কমে যায়। তবে কোম্পানির স্থায়ী খরচ প্রায় সব সময় একই থাকে। এ কারণে ব্যবসা কমে গেলে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হার সাধারণত বেড়ে যায়।
ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র সাথে আলাপকালে লাইফ বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালা বদলের পর দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গণে অস্থিরতা বিরাজ করছে। শিল্প-কারখানায় দেখা দিয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও অস্থিতিশীল। তারল্য সঙ্কট চলছে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে।
এসব কারণে মানুষের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং দেশের লাইফ বীমা খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন তারা।
লাইফ বীমার মুখ্য নির্বাহীদের সাথে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক এক বৈঠক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দেশের প্রতিটি লাইফ বীমা কোম্পানির প্রথম বর্ষ তথা নতুন প্রিমিয়াম আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অর্থাৎ ২০২৩ সালের প্রথম ৮ মাসের তুলনায় ২০২৪ সালের প্রথম ৮ মাসে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমেছে।
মুখ্য নির্বাহীদের মতে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের অবস্থান কোন দিকে যাবে এ নিয়ে শঙ্কা-সংশয় দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে। এমন অবস্থায় নগদ অর্থ হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না অনেকেই। এ কারণে নতুন বীমা পলিসি বিক্রি কমেছে লাইফ বীমা খাতে। একইসঙ্গে পলিসি নবায়নের হারও কমেছে আশঙ্কাজনক হারে।
অপরদিকে কুমিল্লা ও ফেনীসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ১১টি জেলায় সাম্প্রতিক বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এসব অঞ্চলের মানুষকে। ফলে আর্থিক সংকটে থাকা এসব মানুষের পক্ষে বীমার কিস্তি পরিশাধ করা বা নতুন বীমা পলিসি কেনা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
লাইফ বীমা খাতের ব্যবস্থা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ও জেনিথ ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। অর্থ সঙ্কেটে পড়েছেন এ অঞ্চলের মানুষ।
তিনি বলেন, বন্যাদুর্গত এসব অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ করলেও গ্রাহকদের পাওনা বীমা দাবির টাকা পরিশোধ করছে না অনেক কোম্পানি। লাইফ বীমার ব্যবসা কমার জন্য গ্রাহকের বীমা দাবির টাকা না পাওয়াকে অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করেন এস এম নুরুজ্জামান।
এ ছাড়াও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে লাইফ বীমা খাতে। দেশের অস্তিতিশীল পরিস্থিতিতে নগদ অর্থ হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না অনেকেই। এ কারণে বীমার প্রিমিয়াম পরিশোধে অনাগ্রহ বা সঞ্চয় বিমুখতা দেখা যাচ্ছে তাদের মাঝে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অস্থিতিশীলতা এবং গার্মেন্টস খাতের অস্থিরতাকেও তিনি লাইফ বীমার ব্যবসা কমার জন্য দায়ী করেন।
চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম জিয়াউল হক বলেন, আমার জানা মতে এ বছর কোন কোম্পানির ব্যবসার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। বছরের বাকী সময়েও সেটা পূরণ হওয়া কঠিন। সবগুলো কোম্পানির প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় এখন পর্যন্ত নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। তিনি বলেন, ব্যবসা কমে গেলে কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হার বেড়ে যাবে।
এস এম জিয়াউল হক বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক কোম্পানি ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারছে না। কোম্পানিগুলোর নতুন বীমা পলিসি বিক্রি রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার কোম্পানিগুলোতে ল্যাপস পলিসির সংখ্যা বাড়ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে সারেন্ডার ও পেইডআপ পলিসির সংখ্যা। অপরদিকে মাঠকর্মীদের উৎসাহিত করতে কোম্পানিগুলোতে সফর সংখ্যা বাড়ছে, একইসঙ্গে বাড়ছে খরচও।
রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া বলেন, বীমা কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় কমে গেলে খরচের নির্ধারিত লিমিট তথা অনুমোদিত ব্যয়সীমা কমে যায়। তবে কোম্পানির স্থায়ী খরচ কিন্তু সব সময় একই হারে হয়। এ কারণে ব্যবসা কমে গেলে ব্যয়ের হার স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। এ কারণে তারা সঞ্চয় করতে পারছে না। ফলে নতুন পলিসি বিক্রি কমেছে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর। বন্যাদুর্গত ১১টি জেলায় কয়েক মাস ধরে কোন ব্যবসা নেই। এমনকি এসব এলাকার অনেক অফিস এখনো খুলতে পারেনি বীমা কোম্পানিগুলো।