চাকরি করেন অন্য প্রতিষ্ঠানে, বেতন দেয় প্রাইম ইন্স্যুরেন্স
আবদুর রহমান আবির: ফিদা তালবিয়া, বসবাস করেন রাজধানী শহর ঢাকায়। চাকরিও করেন ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে। অথচ সেই ফিদা তালবিয়াকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ শাখায়। পদবি দেয়া হয়েছে এসিসটেন্ট ভাইস-প্রেসিডেন্ট (এভিপি) । আর তার নামেই মোটা অংকের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স।
ফিদা তালবিয়া বীমা কোম্পানিটির আগ্রাবাদ শাখার ইউনিট প্রধান আয়শা বেগমের মেয়ে।
একইভাবে ওয়াকার আনান চৌধুরী নামে এক শিক্ষার্থীকেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের আগ্রাবাদ শাখায়। অথচ ওয়াকার আনান চৌধুরী থাকেন ঢাকায় এবং সেখানেই পড়ালেখা করেন। ২০২১ সালে যখন ওয়াকার আনান চৌধুরীকে কোম্পানিটির এভিপি পদে নিয়োগ দেয়া হয়, তখন তার বয়স ছিল ২২ বছর।
ওয়াকার আনান চৌধুরী প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের আগ্রাবাদ শাখার ইউনিট প্রধান আবদুল মুকিত চৌধুরীর ছেলে। এই কর্মকর্তার স্ত্রী এবং দুই মেয়েও কোম্পানিটির উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে ওই শাখায় নিযুক্ত এবং তাদের নামে মোটা অংকের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স।
শুধু ফিদা তালবিয়া বা ওয়াকার আনান চৌধুরী নয় এমন অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের আগ্রাবাদ শাখায়। যাদের বেশিরভাগই কোম্পানিটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ইউনিট প্রধানের স্বামী-স্ত্রী অথবা ছেলে-মেয়ে।এমনকি বেশ কয়েকজনের বয়স ২২ বছরের কম বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে।
আইডিআরএ’র তদন্ত দলের হিসাব অনুসারে, ২০২১ সালে চারশ’র বেশি নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয় প্রাইম ইন্স্যুরেন্সে। এর ফলে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির বেতন-ভাতা খাতে খরচ বেড়ে যায় ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই খরচ বৃদ্ধির হার ৫৩৩ শতাংশ বা ৫ গুণেরও বেশি।
এ কারণে বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য খাতে এক বছরেই প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের অতিরিক্ত ব্যয় হয় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশই খরচ হয় বেতন-ভাতা খাতে।
নন-লাইফ বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণী বিধিমালা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় করায় প্রাইম ইন্স্যুরেন্সকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করে আইডিআরএ। একইসঙ্গে নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও তাদের বেতন-ভাতার বৈধতা যাচাই করতে কোম্পানিটিতে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নন-লাইফ বীমা খাতে ৬৪ নং সার্কুলার জারির পর অবৈধ কমিশনের অর্থের উৎসহ অনেকটাই বন্ধ। এই প্রেক্ষিতে অনেকেই বিকল্প পথে অবৈধ কমিশনের যোগান দেয়ার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে তাদের বেতন-ভাতার নামে কোম্পানি থেকে টাকা বের করে নেয়া এবং এই টাকা মানিলন্ডারিসহ অবৈধ কমিশনে ব্যবহার হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করে এ ধরণের অপরাধ বন্ধ করা যাবে না। অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিমাণ বা অপরাধ অনুসারে জরিমানার মাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি এ ধরণের অপরাধের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনেও ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় নন-লাইফ বীমা খাতের অবৈধ কমিশন বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সে মোট ১৮১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল এবং তাদের মোট বেতন-ভাতা ছিল ৫৫ লাখ ৩৭ হাজার ২২৩ টাকা। এই হিসাবে ১২ মাস তথা এক বছরে কোম্পানিটির বেতন-ভাতা খাতে মোট খরচ দাঁড়ায় ৮ কোটি ৭৮ লাখ ২৭ হাজার ৬১৯ টাকা।
অথচ ২০২১ সালে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের বেতন-ভাতা খাতে প্রকৃত খরচ হয়েছে মোট ১৫ কোটি ৪২ লাখ ৭৪ হাজার ২৯৫ টাকা। অর্থাৎ ৬ কোটি ৬৪ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৬ টাকা বেশি খরচ হয়েছে। এই খরচ বৃদ্ধির হার ১৭৬ শতাংশ।
তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৮১ হলেও বছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯০ জনে। অর্থাৎ এক বছরেই কোম্পানিটির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বেড়েছে ৪০৯ জন বা ২২৬ শতাংশ।
তবে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের দেয়া তথ্য মতে, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে কোম্পানিটির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ১৮৪ জন, যা ডিসেম্বরে গিয়ে দাঁড়ায় ৬২৫ জনে। অর্থাৎ ৪৪১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নতুন করে নিয়োগ দেয়া হয়।
প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অতিরিক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেখানো হয় চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখায়। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে শাখাটিতে সর্বমোট ৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল। যা বছর শেষে বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ জনে। অর্থাৎ ১৩ গুণ বেশি দেখানো হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা।
তবে তদন্ত দলের পরিদর্শনে কোম্পানিটির আগ্রাবাদ শাখায় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মোট ১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত থাকার তথ্য উঠে আসে। বাকীদের কোন তথ্য পায়নি তদন্ত দল।
এ ছাড়াও তদন্ত দলের পক্ষ থেকে আগ্রাবাদ শাখার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হাজির করতে বলা হলে মাত্র ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্বশরীরে হাজির করতে সক্ষম হয় প্রাইম ইন্স্যুরেন্স। যাদের অনেকেই নিজের ব্যবসা সম্পর্কে তদন্ত দলের কাছে আশানুরূপ উত্তর দিতে পারেননি।
অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দেখানোর কারণে ২০২১ সালে আগ্রাবাদ শাখায় বেতন-ভাতা খাতেও খরচ বেড়ে যায় ৪৭ গুণ। বছরের শুরুতে শাখাটিতে বেতন খাতে খরচ ছিল ৭৮ হাজার ৪৭১ টাকা। যা বছর শেষে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৭ লাখ ১০ হাজার ৭৫৪ টাকায়। অর্থাৎ বেতন খাতেই খরচ বাড়ে ৩৬ লাখ ৩২ হাজার ২৮৩ টাকা।
এ বিষয়ে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল হামিদ বলেন, বীমা কোম্পানিগুলোর উন্নয়ন কর্মকর্তারা সাধারণত অফিসে থাকেন না; ফিল্ডে কাজ করেন। ক্লায়েন্টদের সাথে দেখা করতে দূর-দূরান্তেও যেতে হয় তাদের। তাই যেকোন সময় ডাকলে তাদের অফিসে আসা সম্ভব হয় না। আমাদের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। আইডিআরএ কর্মকর্তারা যেদিন তাদের সাথে দেখা করতে চেয়েছেন সেদিন অনেকেই অফিসে হাজির হতে পারেননি।
অবৈধ কমিশন দেয়ার জন্য এতো কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেখানো হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আইডিআরএ আমাদের কাছে জবাব চেয়েছে। আমাদের সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে; খুব শিগগিরই আমরা আইডিআরএ’কে এ বিষয়ে সঠিক জবাব দেব। এর আগেও আমাদের পক্ষ থেকে জবাব দেয়া হয়েছে তবে দুঃখজনকভাবে তা কর্তৃপক্ষের মনোপূত হয়নি।
নন-লাইফ বীমা খাতে অবৈধ কমিশন বন্ধে করণীয় বিষয়ে আবদুল হামিদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে মুখ্য নির্বাহীদের ফোরাম থেকে আমাদের কাছে প্রস্তাবনা চাওয়া হয়েছে। আমিও একটা প্রস্তাবনা তৈরি করেছি অবৈধ কমিশন বন্ধের বিষয়ে। তিনি বলেন, আসলে অবৈধ কমিশনের কারণে কোম্পানিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে দেশের নন-লাইফ বীমা খাতের অগ্রগতি সম্ভব নয়।