শালদহ সরদার পাড়ার প্রতি ঘরেই সানলাইফের পাওনাদার

মোস্তাফিজুর রহমান টুংকু: কুষ্টিয়া শহর থেকে হরিপুর ব্রিজ পার হয়ে ১০ মিনিটের পথ শালদহ সরদারপাড়া। গ্রামটির পাকা রাস্তার দু'ধারেই বাড়ি-ঘর। টিনশেড পাকা বাড়ি আছে। আছে কাঁচা ঘর। এ গ্রামে অনেক বীমা গ্রাহক আছেন যারা মেয়াদ শেষ হলেও অনেকদিন ধরে টাকা পাচ্ছেন না। যারা টাকা পাচ্ছেন না তাদের অবস্থাটা জানতে এখানে আসা। 

গত সোমবার সরেজমিন এসব বীমা গ্রাহকের সাথে কথা হয়।

তবে কাজটা কঠিন। অনেকের ভীড় থেকে ভুক্তভোগী গ্রাহকদের খুঁজে বের করা। সরদারপাড়ার মুখেই ছোট একটি দোকান। দোকানটিতে মালামালের মধ্যে রয়েছে বিস্কুট, চানাচুর ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। বিক্রেতা একজন মহিলা। বয়স আনুমানিক ৪৫ বছর।  তার কাছে যখন জানতে চাইলাম তিনি কোন বীমা করেছেন কি না।  ভদ্রমহিলা প্রশ্নটা বুঝতে পারলেন না।  পরে বুঝিয়ে বলতে হল।  কিস্তিতে কোথাও টাকা জমার কথা যখন বললাম, তখন তিনি বুঝলেন।

এরপর তিনি নিজেই যা বললেন, ‌‍"কইরেছি তো তিনটে, জলির মায়ের কাছে সব দ্যায়া আছে, আরো টাকা দিতে হচ্ছে, আবার নাকি ডিপিএস করতি হবি, সেই টাকা দিতে পারছি নে, ২ আড়াই হাজার টাকা, গরীব মানুষ দিতে কষ্ট, তাই টাকাও দেচ্ছে না”

বেলীর কাছে জানতে চাচ্ছিলাম প্রতিষ্ঠানটির নাম কি, যার হাতে টাকা দিয়েছে তার নাম। এসব কোন কিছুরই কোন উত্তর তিনি দিতে পারছিলেন না। কি করবেন ঠিক বুঝেও উঠতে পারছিলেন না। 

বেলীর ছোট্ট দোকানটির সামনে রাখা দু'টি বাশের বেঞ্চ। এর উপর বসে বেলির সাথে আলাপ করছিলাম। বেলি কখনো বসছেন, কখনো উঠে দাঁড়াচ্ছেন। চোখে মুখে তার কিছুটা অসস্তি, কিছুটা আতঙ্ক। অনেক কষ্টের উপার্জন। তার থেকে যে সামান্য সঞ্চয়। তা হারানোর আতঙ্কের ছাপটি ছিল তার মুখে স্পষ্ট।

আমারা যখন কথা বলছিলাম। তখন একজন আসলেন। নাম অহেদ আলী। বয়স ৫৫'র মত হবে। অহেদ আলীকে পেয়ে কিছুটা স্বস্তি যেন পেলেন বেলী। অহেদ আলী জানালেন তিনিও টাকা জমা করেছেন। তবে কোথায় তা বলতে পারেন না। তবে, অহেদ আলীর কাছে টাকা জমা দেয়ার কাগজপত্র আছে। অহেদ আলী তার কাগজপত্র আনতে গেলেন। 

বেলী জানালেন অহেদ আলী যেখানে বীমা করেছেন সেখানেই তিনি করেছেন। অহেদ আলীর বইটা আনলেই তিনি প্রতিষ্ঠানের নামটা বলতে পারবেন।

এসব নিয়েই কথা বার্তা চলছিল। এরমধ্যে আরো অনেকেই চলে আসল। বেলীর ছোট্ট দোকানটির সামনে। ইতোমধেই অহেদ আলীও চলে আসলেন। তার হাতে বেসরকারি বীমা কোম্পানি সানলাইফ ইনসিওরেন্সের গণমুখী বীমা প্রকল্পের একটি বই।

তার কাছে যখন জানতে চাওয়া হল কত টাকা জমা করেছেন? কতদিন ধরে জমা দিয়েছেন? এর কিছুই তিনি বলতে পারলেন না। শুধু বললেন বইয়ে লেখা আছে।

অহেদ আলী বেসরকারি লাইফ বীমা কোম্পানি সানলাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেডে বীমা করেছেন ২০০৯ সালের ৩০ জানুয়ারি।  বীমার টাকার পরিমাণ ২৪ হাজার। যার মেয়াদ শেষ ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ সালে।  মাসিক জমা ২০০ টাকা।  এসব তথ্য তার হাতে ধরে থাকা বইয়ে লেখা।

ইতোমধ্যেই চারদিক থেকে গ্রাহকরা আসতে শুরু করলেন। অধিকাংশই গ্রামের অশিক্ষিত খেটে খাওয়া নারী। যাদের স্বামীরা ২০ টাকার জিনিস বিক্রি করেন। বা অন্য কোনো ব্যবসা করেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা। আয় খুবই কম। দিন বা সপ্তাহে যে আয় করেছেন, তারই একটা অংশ তারা সঞ্চয়ের জন্য জমা করেছেন সানলাইফ ইনসিওরেন্সের গণমুখী নামক বীমা প্রকল্পে। আর এরা সবাই টাকা জমা দিয়েছেন জলির মায়ের কাছে।

আম্বিয়া খাতুন ১২ হাজার টাকার বীমা পলিসি করেছেন ২০০৬ সালের ১১ জুলাই। মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। অর্থাৎ ২ বছর আগে। এখনো কোনো টাকা পাননি। তবে পলিসির পুরো সময় তিনি টাকাও জমা করেননি। পুরো মেয়াদে কেন টাকা দিলেন না এমন প্রশ্নে তিনি বললেন, টাকা দিতে পরিনি। 

মদিনা বেগম ৩টি পলিসি করেছেন। এরমধ্যে একটিতে জমা করেছেন ৭ হাজার ৬শ' টাকা, ২৬শ' ও ৬শ' টাকা। বইগুলো মদিনা বেগমকে জমা দিতে বলেছেন সানলাইফের স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। কিন্তু তিনি জমা করেননি। টাকা জমা দিয়েছেন তিনি চার বছর আগে।

আসলাম কাঁচামালের ব্যবসা করেন। লেখাপড়া জানেন না। কোম্পানির নামও বলতে পারেন না। অনেক ক্ষোভ তার। কত টাকা জানতে চাইলে বলেন, অনেক টাকা। প্রথম দিকে ৩০ হাজার টাকা দিয়েছেন। লাভের টাকা। এখন আর কোনো টাকা দিচ্ছেন না। আসলামের কথা, কষ্টের টাকা জমা করেছি। লাভের আশায়। গায়ে খাটা টাকা। এ টাকা মেরে দিলে বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে দিব। তিনি জানালেন, এখানে প্রত্যেক বাড়িতে বীমা করা হয়েছে। কোন কোন ঘরে ২/৩টি করে। কারো টাকা দিচ্ছে না।

গ্রামবাসিরা জানালেন, প্রতিটি ঘরেই এমন পরিস্থিতি। তবে কেউ কেউ এর মধ্যে কিছু টাকা পেয়েছেন। কারো পাশ বই, টাকা জমার রশিদ পোকায় কেটেছে। এরপরও তা তারা সংগ্রহ করে রেখেছেন টাকা পাওয়ার আশায়।

এর মধ্যে দু'জন আসলেন চেক নিয়ে। এর মধ্যে রাজ্জাক সর্দার পেয়েছেন ১৪ হাজার টাকার একটি চেক। চেকটিতে তারিখ দেয়া হয়েছে ২৮ মার্চ ২০১৯ সালের। অর্থাৎ ২০১৯ সালে তিনি এ টাকা তুলতে পারবেন। চেকটি দেয়া হয়েছে ৩/৪ মাস আগে। চেকটি সানলাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানির গণমুখি বীমা প্রকল্পের।

সবুজ ইসলাম, পিতা আমানত ইসলামের নামে অপর একটি চেক। এই চেকটিতেও তারিখ দেয়া হয়েছে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ। ১৮ হাজার ২৩৪ টাকার এই চেকটি দিতে রওশন আরার কাছে ২ হাজার ১শ' টাকা দিয়েছেন সবুজ ইসলাম। সবুজ ইসলামের নামে নতুন একটি মানি রিসিপট দেয়া হয়েছে ২ হাজার ১শ' টাকার। সবুজ জানালেন তিনি পুস্তক ব্যবসা করেন। টাকা না দিলে চেক পাবেন না বলেই তিনি টাকা জমা দিয়ে চেক নিয়েছেন।

এবার আমারা খোঁজে নামলাম জলির মায়ের। জলির মায়ের নাম রওশন আরা। তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য একজনের সাহায্যে মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করা হল। মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে এক ব্যক্তি জানালেন তিনি বাড়িতে নেই। রওশন আরাকে আমরা আর পেলাম না।

পরে গত ১ আগস্ট দুপুরে রওশন আরার সাথে কথা হয়। রওশন আরা জানালেন, ১৪ বছর থেকে তিনি এ কোম্পানিতে আছেন। তিনি এ অঞ্চলের ব্রাঞ্চ ইনচার্জ। সব মিলিয়ে হাজার পাঁচেক গ্রাহক তার। অনেকের মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে। অনেকের হয়নি। এখনো প্রায়া ১ হাজার বই তিনি স্থানীয় কার্যালয়ে জমা করেছেন। কিন্তু কোনো টাকা পাচ্ছেন না। নতুন করে টাকা নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, কোম্পানি বলেছে বলেই তিনি গ্রাহকদের কাছ থেকে নুতন করে টাকা নিচ্ছেন।

রওশন আরা বলেন, আমি গরীব মানুষ। আগে বুঝতে পারিনি। মহিলা মানুষ আমি। আমার অনেক বয়স হয়েছে। খুব বিপদে আছি। গ্রাহকরা বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। আমার পরিবারেরই ১০টি বীমা করা আছে। এক বছর আগে মেয়াদ শেষ হয়েছে। টাকা পাচ্ছি না।

এ বিষয়ে জানতে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান প্রফেসর রুবিনা হামিদ এর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হয়। তিনি একটি মিটিং-এ আছেন উল্লেখ করে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি'কে বলেন, আমাদের বেশ কয়েকটা প্রকল্প আছে। আমরা সব গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করার চেষ্টা করছি। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে প্রকল্প পরিচালককে বলব প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।