পদ্মা ইসলামী লাইফ বিক্রি করে দিল মালিকরা
আবদুর রহমান আবির: হাজারও গ্রাহকের বীমা দাবি না দেয়াসহ শতকোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ সুরাহা না হতেই পদ্মা ইসলামী লাইফ বিক্রি করে দিয়েছে মালিকরা। বেসরকারি লাইফ বীমা কোম্পানিটি কিনে নিয়েছে দেশের শীর্ষ স্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ।
কোম্পানির কাছে গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করতেই শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন ডিরেক্টররা- এমন তথ্য জানিয়েছেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান এএফএম ওবায়দুর রহমান।
পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান এএফএম ওবায়দুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান আবু তাহের, ডা. এবিএম জাফর উল্লাহ, এটিএম রফিক ও এবিএম তালেব আলীসহ ১২ ডিরেক্টর এবং ৬ শেয়ারহোল্ডার তাদের হাতে থাকা ১ কোটি ৭৪ লাখ ১০ হাজার ৯০০ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, আইন অনুযায়ী বীমা দাবি পরিশোধ না করায় কোম্পানিটির বিরুদ্ধে হাজারও গ্রাহকের অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে কোম্পানিটির ২০১২ থোক ২০১৪ সালের আর্থিক ব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখতে বিশেষ নিরীক্ষা চালাতে একনাবিন চার্টার্ড এ্যাকাউন্টসকে নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। নিরীক্ষার পর বেশ কিছু খাতে পদ্মা ইসলামী লাইফের শত কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করে রিপোর্ট দেয় একনাবিন।
নিরীক্ষকের এ রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল পদ্মা ইসলামী লাইফকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় আইডিআরএ।
এসব আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের কোন সুরাহা করা হয়নি।
জানা গেছে, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, সাইফুল আলমের স্ত্রী ফারজানা পারভীন ও ছেলে আহসানুল আলম এবং তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এফিনিটি অ্যাসেটস লি:, ক্রেস্ট হোল্ডিংস লি: ও প্যাভিলিয়ন ইন্টারন্যাশনাল এবং চট্টগ্রামের ইউনিটেক্স পেট্রোলিয়াম লি: ও ইউনিটেক্স এলপি গ্যাস লি: পদ্মা লাইফের এসব শেয়ার কিনে নিয়েছে।
এর মধ্যে পদ্মা ইসলামী লাইফের স্পন্সর ডিরেক্টর ড. একেএম আনোয়ারুজ্জামানের ৯ লাখ ৮০ হাজার ৪শ’টি শেয়ার কিনেছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম। মো. আবুল বাশারের ৩ লাখ ৯০ হাজার শেয়ার, এবিএম তালেব আলির ৩ লাখ ৩০ হাজার শেয়ার ও রহিমা খানমের ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৯৬০টি শেয়ার কিনেছেন মোহাম্মদ সাইফুল আলমের স্ত্রী ফারজান পারভীন। এবিএম জাফর উল্লাহর ১৮ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার কিনে নিয়েছেন মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম।
এ ছাড়াও স্পন্সর ডিরেক্টর এটিএম এনায়েত উল্লাহর ১৩ লাখ ৯০ হাজার শেয়ার, নাজমুন নাহারের ৯ লাখ ৬৬ হাজার ৪শ’ শেয়ার এবং হাজী মোহাম্মদ শাহজাহানের ৩ লাখ ৪১ হাজার ৭২০টি শেয়ার কিনেছে এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ক্রেস্ট হোল্ডিংস লি:।
স্পন্সর ডিরেক্টর ফাতেমা বেগমের ১২ লাখ ৪৪ হাজার ১৬০টি এবং নাজিম উদ্দিন আহমেদের ১১ লাখ ৪৪ হাজার ১৬০টি শেয়ার কিনেছে এফিনিটি এসেটস লি:।
ড. নাদিরা সাবেরিনের ১০ লাখ ৫১ হাজার ৫২০টি, আবদুল মুজিব চৌধুরীর ৯ লাখ ৭ হাজার ২শ’টি এবং এটিএম রফিকের ৮ লাখ ৫২ হাজার শেয়ার কিনেছে প্যাভিলিয়ন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।
ইউনিটেক্স এলপি গ্যাস লিমিটেড কিনেছে পদ্মা ইসলামী লাইফের স্পন্সর ডিরেক্টর এএফএম ওবায়দুর রহমানের ১৩ লাখ ২০ হাজার, জয়নাল আবেদিন জাফরের ১৪ লাখ ৫ হাজার ২শ’টি এবং ইউসুফ ওয়াজেদ আলী চৌধুরীর ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৪শ’টি শেয়ার।
এ ছাড়াও স্পন্সর ডিরেক্টর আবু তাহেরের ১২ লাখ ৩৪ হাজার ৬শ’টি, ফজলে আলম ভূঁইয়ার ১২ লাখ ৯৬ হাজার এবং মো. আবুল বাশারের ২ হাজার ১৮০টি শেয়ার কিনেছে ইউনিটেক্স পেট্রোলিয়াম লিমিটেড।
এ বিষয়ে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান এএফএম ওবায়দুর রহমান বলেন, আমরা ব্যবসা ভালো করতে পারিনি। তাই গ্রাহকদের দাবিও ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারিনি। এজন্য কোম্পানির যে সম্পদ আছে তা বিক্রি করে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাতেও টাকার সংস্থান হয়নি। তাই আমরা গ্রাহকদের দাবি পরিশোধ করার জন্য কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছি।
তিনি বলেন, আমাদের সমস্যা হচ্ছে নগদ টাকার। আমরা অনেক জায়গা-জমি কিনে ফেলেছি। সেগুলো বিক্রি করে নগদ টাকা সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। বাজার খারাপ। তাই নগদ টাকা সংগ্রহ করার জন্য আমরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছি।
আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে পদ্মা ইসলামী লাইফ চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের কোন আর্থিক অনিয়ম নেই। এসব বোঝার ভুল। আমরা বিশ্লেষণ করে তা স্পষ্ট করে দিয়েছি। আমরা অডিট করে দেখিয়েছি আমাদের কোন অনিয়ম নেই। কথায় কথায় মানুষ অনেক কিছুই বলে।
কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন হলেও গ্রাহকদের কোন সমস্যা নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, মূলত গ্রাহকদের দাবি-দাওয়া পরিশোধ করার জন্যই ডিরেক্টররা কোম্পানির মালিকানা ছেড়ে দিচ্ছে। কোম্পানি কেউ বিক্রি করতে পারে না। এটা পাবলিক কোম্পানি, যদি কেউ চায় যার যার শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারে।নিয়ম অনুযায়ী যে শেয়ার কিনবে সে মালিক হবে।
পদ্মা ইসলামী লাইফে নিয়োজিত মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মীদের কি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন ম্যানেজমেন্ট আসলে তারা বিষয়টি দেখবে। ম্যানেজমেন্ট চেঞ্জ হবে কিন্তু কোম্পানি তো থাকবে।
এ বিষয়ে আইডিআরএ সদস্য গকুল চাঁদ দাস বলেন, পদ্মা লাইফ একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি। সে ব্যবসা করছে। তার মালিকানা পরিবর্তন হলে কি এর গ্রাহকদের দাবি-দাওয়া গায়েব হয়ে যাবে?
মালিকানা পরিবর্তন হলে গ্রাহকদের বিষয়টা কিভাবে পরিচালনা করবে তা পদ্মা ইসলামী লাইফের কাছে জানতে চাওয়ার কথা বলেন তিনি।
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও ৫০/৬০ লাখ টাকার বেশি অভিযোগ পাওয়া যায়নি এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, শত শত কোটি টাকার অভিযোগ আপনারা বলেন, কিন্তু আমাদের কাছে তো আসে না।
তিনি বলেন, আপনারা পত্রিকাওয়ালারা প্রত্যেক দিন বলেন যে, শত শত কোটি টাকার বীমার অনাদায়ী পাওনা রয়েছে। এ তথ্য আপনারা কার কাছ থেকে পান। পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকা বীমা দাবি পাওনার অভিযোগ তো আমাদের কাছে নাই। আমাদের না বললে আমরা জানবো কোথায় থেকে। আপনাদের কাছে যদি সুস্পষ্ট কোন অভিযোগ থাকে আমাদের দেন। আমরা দেখি পদ্মা ইসলামী লাইফকে জানিয়ে তা দিতে পারি কিনা।