সুরাহা হয়নি কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম, পদত্যাগ করলেন মোহাম্মদী খানম

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণিত ২ কোটি ১০ লাখ টাকা মানি লন্ডারিং, পুনর্বীমার নামে ১২ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ, ২৬ কোটি টাকার লোকসান গোপন, অনুমোদন ছাড়াই আর্থিক সুবিধা নেয়া এবং আর্থিক প্রতিবেদনে বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপনসহ কোটি কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের কোন সুরাহা হয়নি। অথচ এরমধ্যেই গতকাল বুধবার প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন মোহাম্মদী খানম। কোম্পানিটির বিশ্বস্ত একটি সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ২২ তারিখে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের বোর্ড সভায় আর্থিক অনিয়মের জন্য চাপের মধ্যে পড়েন মোহাম্মদী খানম। এরপরই পদত্যাগ করেন মোহাম্মদী খানম। গতকাল বুধবার তিনি শেষ অফিস করেন। মূলত মানি লন্ডারিং এবং আর্থিক অনিয়মের দায় এড়াতেই পদত্যাগের এমন কৌশল নিয়েছেন। কোম্পানিটির একাধিক উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে এমনটাই জানিয়েছেন।এর আগে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স ও মোহাম্মদি খানমের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি।

উল্লেখ্য, গত ৪ জুলাই “১২ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে” সংবাদ প্রকাশ করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে পুনর্বীমার প্রিমিয়ামের নামে ১২ কোটি ১৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকা বিদেশে পাচার করেছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গুলশান ব্রাঞ্চ থেকে এই টাকা পাঠানো হয়েছে। আর পুনর্বীমার কমিশনের টাকা নিয়েছেন কোম্পানিটির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদী খানম। গত এপ্রিলে একজন বীমা কর্মকর্তার দাখিল করা এমন অভিযোগের বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ তদন্তে নেমেছে বলে জানা গেছে।

ওই অভিযোগ বলা হয়, পুনর্বীমাযোগ্য প্রিমিয়ামের ৫০ শতাংশ পুনর্বীমাকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশনে করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর ফ্যাকালটেটিভ পুনর্বীমা সাধারণ বীমা করপোরেশন গ্রহণ না করলে বিদেশী পুনর্বীমাকারীর সাথে করা যায়।

অন্যদিকে বীমা অংকের পরিমাণ অগ্নিবীমার ক্ষেত্রে ৪০০ কোটি টাকার নিচে হলে বিদেশী পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রিমিয়াম মূল্য হার (রেট) নেয়া যায় না। কিন্তু এসব আইনী বাধ্যবাধকতার কোনোটিই মানছে না প্রাইম ইন্স্যুরেন্স।

সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ১২ কোটি টাকা অর্থ পাচারের এ অভিযোগ তদন্তে ২ সদস্যের একটি তদন্ত দল গঠন করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। ইতোমধ্যে তদন্ত দল প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করেছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।

সাধারণ বীমা করপোরেশনের কাছে পুনর্বীমা দাবি বাবদ পাওনা নিয়ে আর্থিক প্রতিবেদনে ২৬ কোটি টাকার গড়মিলে হিসাব উপস্থাপন করে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স। এ বিষয়ে গত ১৭ মে অপর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইন্স্যুরেন্স নিউজবিডি। তবে এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়ার খবর জানা যায়নি।

গত ২৮ মে, প্রাইমের রিইন্স্যুরেন্স রিকভারিতে ২৬ কোটি টাকার গড়মিল শীর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি।

অনুসন্ধানী ওই প্রতিবেদনে বলা হয় সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি)’র কাছে ক্লেইম রিকভারি নিয়ে কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারছে না প্রাইম ইন্স্যুরেন্স। একদিকে এসবিসি বলছে ক্লেইম রিকভারি বাবদ কোম্পানিটির পাওনা ১১ কোটি টাকা। অন্যদিকে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের দাবি এসবিসি’র কাছে তাদের পাওনা ২৫ কোটি টাকা। অথচ আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে ৩৭ কোটি টাকা।

এসবিসির তথ্য ও কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রিইন্স্যুরেন্সের ক্লেইম বাবদ ২৬ কোটি টাকার গড়মিল, আবার কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার বক্তব্য অনুসারে গড়মিল ১৩ কোটি টাকার। তাই প্রশ্ন উঠেছে, আসলেই এসবিসি’র কাছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের পাওনা কত ?

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ম্যাক এন্টারপ্রাইজ নামের একাটি প্রতিষ্ঠানের পুনর্বীমা দাবি প্রাইম ইন্স্যুরেন্স উপস্থাপন করলেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করতে পারেনি। ফলে তা নাকচ করে দেয় এসবিসি। কিন্তু এরপরও দাবিটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

গত ২৬ জুন “মাসে সোয়া লাখ টাকা বেশি নিয়েছেন মোহাম্মদী খানম” শীরোনামে অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি।

অনুসন্ধানী এ প্রতিদেনে তুলে ধরা হয়, ২০১৪ সালের মার্চ থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত গড়ে প্রতিমাসে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেশি নিয়েছেন প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী মোহাম্মদী খানম। এ সময় অন্যান্য ভাতাদিসহ সর্বসাকুল্যে তার মাসিক বেতন ছিল ৪ লাখ টাকা।

এর বাইরে আর কোনো আর্থিক সুবিধার নেয়ার অনুমোদন ছিল না তার নিয়োগের অনুমোদন পত্রে। অথচ তিনি প্রতিমাসে বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ নিয়েছেন ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ গড়ে প্রতিমাসে বেশি নিয়েছেন ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ মোহাম্মদী খানমকে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী হিসেবে নিয়োগের অনুমোদন দেয় ২০১৪ সালের মার্চে। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে মোহাম্মদী খানমের বেতন-ভাতা নেয়ার এমন চিত্র উঠে আসে।

একই বছরে দুই বেসিকে বেতন পান প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের সিইও শিরোনামে অপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় একই বছরে ২ বেসিকে ২ ধরনের মোট বেতন নিয়েছেন প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের সিইও মোহাম্মদী খানম। বেতন নেয়ার এমন অস্বাভাবিক চিত্র উঠে এসেছে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায়। তবে এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা নেই কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে।

জানা যায়, ২০১৭ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ৩৩ নং নোট অনুসারে ২০১৭ সালে মূখ্য নির্বাহীকে সর্বসাকুল্যে বেতনভাতা দেয়া হয়েছে ৮৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আবার ২০১৮ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ৩২ নং নোটে ২০১৭ সালে অর্থাৎ ওই একই বছরে মূখ্য নির্বাহীর বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে ৯৩ লাখ ৫৬ হাজার ৪৫০ টাকা।এতে একই বছরে নেয়া মোট বেতনের পার্থক্য ৫ লাখ ৬ হাজার ৪৫০ টাকা।

আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, একই বছরে দুই বেসিকে বেতন নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর্থিক প্রতিবেদনে দুই ধরণের তথ্য দেয়ারও কোনো সুযোগ নেই ফিনান্সিয়াল রিপোটিং এ্যাক্ট অনুসারে।

এসব বিষয়ের কোন সুরাহা না করেই দায় এড়াতে পদত্যাগ করলেন মোহাম্মদী খানম। এদিকে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে বিষয়টিকে অনিষ্পত্তিই রেখে দিল। প্রশ্ন হচ্ছে, কোম্পানির এতো আর্থিক অনিয়মের দায় কার এবং জনগণের এ টাকার হিসাব মিলবে কিভাবে!