অনুমোদন ছাড়াই ১৬ মাস ধরে মূখ্য নির্বাহী পদে মীর নাজিম

নিজস্ব প্রতিবেদক: অনুমোদন ছাড়া মূখ্য নির্বাহী পদে দায়িত্ব পালন অবৈধ। বেতন-ভাতা নেয়া মানিলন্ডারিং। এসব নির্দেশ বীমাখাত নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র। তবে কর্তৃপক্ষের এমন নির্দেশের তোয়াক্কা করেন না ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মীর নাজিম উদ্দিন। গত সাড়ে ১৬ মাস ধরে এসব নির্দেশ অমান্য করে অনুমোদন ছাড়াই মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে দায়িত্ব পালন করছেন। বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাও নিচ্ছেন।

অপর দিকে অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে মীর নাজিম উদ্দিনকে সম্প্রতি অপসারণের নির্দেশ দিলেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন এবং মূখ্য নির্বাহী হিসেবেই কোম্পানির কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। অবশ্য গণমাধ্যমে তিনি এর আগে চ্যালঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন ‘পারলে যেন আইডিআরএ তাকে বহিস্কার করে’। মীর নাজিম এই চ্যালেঞ্জের প্রমাণ রেখে চলেছেন। 

খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বীমাখাতে এ ধরণের কর্মকাণ্ড সরকারের জিরো টলারেন্স বাস্তবায়নের অন্তরায়। তাদের মতে, কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব প্রাপ্ত শীর্ষ ব্যক্তিদের সহযোগিতা ছাড়া কোনো কোম্পানির বা ব্যক্তির এভাবে নির্দেশ অমান্য করার সুযোগ নেই। অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের এমন সুবিধা দেয়া হচ্ছে কিনা তা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন তারা।

তথ্য অনুসারে, মীর নাজিম উদ্দিন ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগের অনুমোদন পান ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি। এ অনুমোদন দেয়া হয় ৩ বছরের জন্য। ২০১৯ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। এরপর কোম্পানি থেকে তার নিয়োগ নবায়নের জন্য আবেদন করা হলেও তাকে অনুমোদন দেয়া হয় নাই। এই হিসেবে চলতি ১৭ জানুয়ারি, ২০২১ পর্যন্ত ১ বছর ৪ মাস ১৬ দিন অনুমোদন ছাড়াই মূখ্য নির্বাহী পদে রয়েছেন মীর নাজিম উদ্দিন।

ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের ১৩১তম পরিচালনা পর্ষদ সভায় মীর নাজিমের নিয়োগ নবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর। এ সময় তার বেতন-ভাতা ধরা হয় ৬ লাখ টাকা। এই হিসাবে তিনি গত ষোল মাসে ৯৬ লাখ টাকা বেতন-ভাতা নিয়েছেন।

এ ছাড়াও তার বাসার ২জন পাচক, ২জন মালি, ২জন নিরাপত্তারক্ষী, ১জন সুইপার, ১জন কেয়ারটেকারের জন্য মাসে মোট ১ লাখ টাকা হিসেবে এই ১ বছর ৪ মাসে কোম্পানিটি খরচ দাঁড়ায় ১৪ লাখ টাকা।

একইসঙ্গে মীর নাজিম পেয়েছেন সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য চালকসহ দু’টি গাড়ি, যার জ্বালানি ও যাবতীয় মেরামত খরচ বহন করেছে কোম্পানি। তার বাসার টেলিফোন বিলের প্রকৃত খরচের পাশাপাশি মোবাইল বিল বাবদ পেয়েছেন মাসে আরো ৩ হাজার টাকা। অন্যান্য সুবিধাদি তো রয়েছেই।

উল্লেখ্য, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা-২০১২ এর প্রবিধি-৪ এর উপ-প্রবিধি ৫ মোতাবেক পরিচালনা পর্ষদের কোন প্রস্তাবিত ব্যক্তির নিয়োগ প্রস্তাব বা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নিয়োগ নবায়ন প্রস্তাব কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত তিনি ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে বেতন ভাতাদিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন না।

অপর দিকে, কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নং জিএডি ১৩/২০১৫ এ বলা হয়েছে, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া বা চুক্তি বাতিলপূর্বক পদত্যাগ করা বা কোম্পানি কর্তৃক অপসারণ হওয়ার কারণে পদ শূন্য হলে পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানির দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে উক্ত শূন্য পদে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত নিম্নপদে নিয়োজিত যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মকর্তাকে তার বর্তমান দায়িত্বের পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিতে পারবেন, তবে এর মেয়াদ ৩ মাসের অধিক হবে না।

অনুমোদন ব্যতীত বে-আইনিভাবে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করায় এবং বিধি মোতাবেক নিয়োগ নবায়নের আবেদন না করায় মীর নাজিম উদ্দিনের কাছে ব্যাখ্যা চায় আইডিআরএ। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠায় কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠিতে এ বিষয়ে কারণ ব্যাখ্যা এবং অপরাধ মার্জনার আবেদন জানান মীর নাজিম উদ্দিন। তবে এ বিষয়ে পরবর্তী কোন ব্যবস্থা নেয়নি আইডিআরএ। 

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর ও ৭ নভেম্বর ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয় এবং সিটি সেন্টার শাখা পরিদর্শন করে বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতি প্রমাণ পায় আইডিআরএ’র সার্ভিলেন্স টিম। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সর্বশেষ গত বছরের ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত শুনানিতে মীর নাজিমকে অপসারণসহ ইসলামী কমার্শিয়ালের বিরুদ্ধে ৮টি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।

এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়ার পর গত ১৮ নভেম্বর অর্থদণ্ড কমানো, সিটি সেন্টার শাখা বন্ধের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনাসহ চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত মূখ্য নির্বাহী মীর নাজিমকে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয়ার অনুরোধ জানান ইসলামী কমার্শিয়ালের চেয়ারম্যান সাহিদা আনোয়ার। একইদিন আরেকটি চিঠিতে দণ্ড পুনর্বিবেচনাসহ মান-সম্মানের সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের সুযোগ চেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান মীর নাজিম উদ্দিন।

তবে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার বিষয়ে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান সাহিদা আনোয়ার এবং মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদের আবেদন ‘রিভিউ এর (সময়, ফরম ও ফি) প্রবিধানমালা, ২০১৫’ অনুযায়ী যথাযথ না হওয়ায় গত ২৩ নভেম্বর তা নামঞ্জুর করেছে বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।

ফলে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ থেকে মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদকে অপসারণের সিদ্ধান্তসহ তার ব্যক্তিগত জরিমানা এবং কোম্পানি ও অন্যান্য কর্মকর্তার অর্থদণ্ড বহাল থেকে যায়। একইসঙ্গে ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখের মধ্যে অর্থদণ্ড পরিশোধ না করে থাকলে প্রতিদিনের জন্য তাদেরকে অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা হারে জরিমানা গুণতে হবে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র পক্ষ থেকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।

তবে কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. দলিল উদ্দিন বলেন, ফাইল না দেখে আমি বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে পারছি না। আপনি আমাদের এখানে (আইডিআরএ) এসে সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিতে পারেন। এ সময়ে বেতন-ভাতা ফেরত চাওয়া হবে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে কোনো উত্তর দেননি তিনি।

পরবর্তীতে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি'র পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংশ্লিষ্ট দফতরে স্বশরীরে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে বলা হয়, এ বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে তথ্য অধিকার আইন অনুসারে আবেদন করতে হবে। তাহলেই কেবল তারা কোন তথ্য দিতে পারবেন।