রূপালী লাইফের প্রতিদিন ভ্রমণ খরচ দেড় লাখ টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক: রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স প্রতিদিন ভ্রমণ ও পরিবহন বাবদ ব্যয় করেছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। এই ধরণের খরচকে অস্বাভাবিক বলছেন বীমা খাত সংশ্লিষ্টরা। কোম্পানিটির বিগত ৫ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখিত ভ্রমণ ও পরিবহন খাতে প্রদর্শিত ব্যয়ের হিসাব তুলনামূলক পর্যালোচনা করে খরচের এই অস্বাভাবিক চিত্র উঠে এসেছে।  

তবে কোম্পানিটিতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিয়োগকৃত নিরীক্ষকের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ৮৫টি আপত্তি উত্থাপন করা হলেও অস্বাভাবিক এই খরচের কোন তথ্য উঠে আসেনি। যদিও কর্তৃপক্ষ থেকে বিশেষ নিরিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল কোম্পানিটি যেসব খাতে ব্যয় করেছে তা আইন অনুসারে করা হচ্ছে কি না এবং কেন অতিরিক্ত খরচ করছে তা খতিয়ে দেখতে। 

রূপালী লাইফের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন থেকেই বীমা কোম্পানিটি এ খাতে বেশি ব্যয় দেখিয়ে আসছে। মূলত কোম্পানির টাকা হাতিয়ে নেয়ার কৌশল হিসেবেই ভ্রমণ ও পরিবহন খাতটি ব্যবহার করা হয়। সঠিকভাবে তদন্ত করা হলে খাতটির প্রকৃত খরচের চিত্র বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন তারা।

রুপালী লাইফের এই খাতের খরচের সাথে মোট প্রিমিয়াম আয়ের শীর্ষে থাকা দেশের ৫টি লাইফ বীমা কোম্পানির পাঁচ বছরের তুলনামূলক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই শীর্ষ ৫ কোম্পানির ভ্রমণ ও পরিবহন খাতে ব্যয় গড়ে মোট প্রিমিয়াম আয়ের ০.৫০ শতাংশ। অথচ রূপালী লাইফের ভ্রমণ ও পরিবহণ খাতে এই ব্যয় ২.৫৯ শতাংশ। টাকার অংক এবং শতাংশ উভয় দিক দিয়েই রূপালী লাইফের এই খরচ বেশি।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল এই ৫ বছরে রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ভ্রমণ ও পরিবহন খাতে সর্বমোট ব্যয় করেছে ২৭ কোটি ২৫ লাখ ৫৩ হাজার ২০৪ টাকা। যা এই সময়ে কোম্পানিটির মোট প্রিমিয়াম আয়ের (১০৫১ কোটি ১৫ লাখ ৮৩ হাজার ১৬৩ টাকা) ২.৫৯ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৮ সালে কোম্পানিটি এই খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে, যার পরিমাণ ৬ কোটি ৫ লাখ ৫১ হাজার ৯১২ টাকা বা ২.৮১ শতাংশ।

এ ছাড়াও ২০১৯ সালে কোম্পানিটি ভ্রমণ ও পরিবহন খাতে ব্যয় করেছে ৫ কোটি ৩৭ লাখ ৮০ হাজার ৮৬০ টাকা, যা মোট প্রিমিয়ামের ২.২৬ শতাংশ। এর আগে ২০১৫ সালে ৫ কোটি ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ৫২৫ টাকা বা ২.৭৯ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৪ কোটি ৭৫ লাখ ৪০ হাজার ৪৮ টাকা বা ২.৩৫ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ৫ কোটি ৭৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৫৯ টাকা বা ২.৮১ শতাংশ ভ্রমণ ও পরিবহন খাতে খরচ করেছে রূপালী লাইফ।

এই হিসাব অনুসারে, রুপালী লাইফ প্রতিদিন ভ্রমণ ও পরিবহন বাবদ ব্যয় করেছে গড়ে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৩৪৪ টাকা। অথচ দেশের যেকোন অঞ্চলে বিমানে যাতায়াত করা হলেও কোন কর্মকর্তার যাওয়ার খরচ চার হাজার টাকার বেশি হয় না। এছাড়া হোটেলে থাকা-খাওয়ার খরচ যুক্ত করলেও ১৫ হাজার টাকা হওয়ার কথা নয়।

এই হিসাব ধরা হলেও প্রতিদিন শীর্ষ স্থানীয় ১০ জন কর্মকর্তা দেশের যেকোন অঞ্চলে ভ্রমণ করতে পারে। কিন্তু বীমা খাতের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, কোন কোম্পানির ১০ জন কর্মকর্তা ভ্রমণে থাকা অস্বাভাবিক, এটা হতে পারে না। তারা জানিয়েছেন, প্রতিদিন গড়ে ৫ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভ্রমণও যেকোন লাইফ বীমা কোম্পানির জন্য বেশি।

এদিকে ভ্রমণ ও পরিবহন খাতে অস্বাভাবিক খরচের বিষয়ে কোন তথ্য না থাকলেও এই খাত সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়ে আপত্তি তুলে ধরেছেন বিশেষ নিরীক্ষক। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ১১ নং আপত্তিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার যাতায়াত খরচের ১ লাখ ৫ হাজার ৬২৯ টাকার চারটি বিল উক্ত বছরে না দেখিয়ে পরবর্তী বছরে দেখানো হয়েছে।

মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার এই বিলের বিষয়সহ বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের আপত্তিগুলো নিয়ে রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে কারণ দর্শানোর নোটশ করেছিল বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। ওই নোটিশের জবাবে এই বিলের বিষয়ে বীমা কোম্পানিটি জানিয়েছে, ‘কয়েকটি বিল ভুলবশত থেকে যাওয়ায় সেগুলো পরিশোধে বিলম্ব হয়েছে’।

এ ছাড়াও রূপালী লাইফের এজেন্টদের নিয়োগকর্তাকে টিএ/ডিএ বোনাস প্রদানের বিষয়ে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ৬ নং আপত্তিতে বলা হয়েছে, ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে কোম্পানিটি এজেন্ট নিয়োগকর্তাদের ৪ কোটি ১৮ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯০ টাকা টিএ/ডিএ বোনাস প্রদান করেছে। আইডিআরএ’র সার্কুলার নং লাইফ-০৩(খ)/২০১২ অনুসারে এই টিএ/ডিএ দিয়ে আসছে। তবে এই সার্কুলার অনুসারে এজেন্টদের নিয়োগকর্তারা টিএ/ডিএ বোনাস পাওয়া অধিকার নয়। এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করেছে।

ভ্রমণ ও পরিবহন খাতে অস্বাভাবিক খরচের বিষয়ে জানতে রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. গোলাম কিবারিয়ার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটা পরিসংখ্যান দেখে বলতে হবে। এটা মুখস্ত বলা যাবে না। আপনি কোন তথ্য জানতে চাইলে আমাদের অফিসে আসেন, সিএফও’র সাথে আলাপ করেন।

বীমা কোম্পানিটির সিএফও মোহাম্মদ শিব্বির হোসেন বলেন, এই খরচ ঠিক আছে। কারণ, লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় সারাদেশে আমাদের কর্মীরা বিভিন্ন অফিসে যাতায়াত করে। এতে তাদের একটা খরচ আছে। এই খরচটা আমাদের দিতে হয়। এই খাতে আমাদের খরচের পরিমাণ বেশি মনে হওয়ার কারণ হলো- ভ্রমণ কেন্দ্রিক সব খরচ আমরা এই হেডে উল্লেখ করি। যেটা অন্য বীমা কোম্পানি ভিন্ন ভিন্ন হেডে উল্লেখ করে থাকে। এ কারণে আমাদের খরচ বেশি মনে হচ্ছে।

তবে রূপালী লাইফের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভ্রমণ ও পরিবহণ খাতের বাইরে কোম্পানিটি ২০১৫ থেকে ২০১৯ এই ৫ বছরে গাড়ীর তেল খরচ, মেরামত ও সংরক্ষণ খাতে ১২ কোটি ৫ লাখ ৪৮ হাজার ৭১৬ টাকা খরচ করেছে। অর্থাৎ রূপালী লাইফ গাড়ীর তেল, মেরামত ও সংরক্ষণ খাতেও প্রতিদিন খরচ করেছে গড়ে ৬৬ হাজার ৫৪ টাকা।