আথির্ক ভিত দুর্বল হয়ে পড়ছে ডেল্টা লাইফের
নিজস্ব প্রতিবেদক: আর্থিক ভিত দুর্বল হয়ে পড়ছে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। ফলে দুই যুগ ধরে চলে আসা দেশের লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানের খ্যাতিটি ধরে রাখা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
বিগত কয়েক বছর ধরেই কোম্পানিটি আশানুরূপ প্রিমিয়াম সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে রেভিনিউ সারপ্লাসে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। সেই সাথে কমেছে বিনিয়োগ থেকে আয়। অন্যদিকে বেড়েছে লায়াবিলিটি। এমন পরিস্থিতি কোম্পানির আর্থিক ভিতের ওপর আঘাত করছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকে কোম্পানিটি তার ঐতিহ্য হারাবে। এর ফল ভোগ করতে হবে গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডার উভয়কেই।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে দাখিল করা হিসাব অনুসারে, গত ১০ বছরের মধ্যে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স সর্বোচ্চ নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ২০১১ সালে ১২৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এরপর ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিগত ৬ বছরে এমন সফলতা দেখাতে পারেনি ডেল্টা লাইফ। সর্বশেষ হিসাব সমাপনী বছরে কোম্পানিটি নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ১১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা আবার গত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
২০১১ সালের আগে ডেল্টা লাইফের প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি ছিল একটা ধারাবাহিক গতিতে। আর ২০১১ সালের পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গেছে নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহের প্রবৃদ্ধির ধারা। যদিও এই প্রবৃদ্ধির ধারা ২০১১ সালকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।
হিসাব অনুসারে, ২০১২ সালে ৮১ কোটি ৭ লাখ টাকা, ২০১৩ সালে ৮৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে ১০০ কোটি ৪ লাখ টাকা এবং ২০১৫ সালে ১০৬ কোটি ৫৮ লাখ নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ডেল্টা লাইফ। কোম্পানিটির নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল ২০১২ ও ২০১৩ সালে। আগের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের তুলনায় এ দুটি বছর নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ৫৮ ও ৫৪ শতাংশে নেমে যায়।
প্রিমিয়াম সংগ্রহের এ অবস্থার কারণে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের রেভিনিউ সারপ্লাস, বিনিয়োগ ও লাইফান্ডসহ সকল খাতেই প্রবৃদ্ধি কমে যায়। অপর দিকে বেড়ে যায় লায়াবিলিটি বা দায়।
নিয়ন্ত্রক সংস্থায় দাখিল করা হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিগত ৫ বছরে কোম্পানিটির অপারেশনাল সারপ্লাস বা রেভিনিউ সারপ্লাসে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে ১০ শতাংশের বেশি। ২০১১ সালে ডেল্টা লাইফের রেভিনিউ সারপ্লাস ৫৪০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম। ২০১০ সালে রেভিনিউ সারপ্লাস ৬২০ কোটি ৯২ লাখ।
এছাড়া ২০১২ সালে সারপ্লাসের পরিমাণ ৬০০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা- প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৬৪৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা- প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৬৮৮ কোটি ৮ লাখ টাকা- প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৭০৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা- প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৬৯৮ কোটি ২২ লাখ টাকা-প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ।
রেভিনিউ সারপ্লাসের এই হিসাব করা হয়েছে- মোট প্রিমিয়াম থেকে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাদ দেয়ার পর বিনিযোগ আয় যোগ করে।
প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে কোম্পানিটির বিনিয়োগেও। গত ৫ বছর ধরেই প্রবৃদ্ধি কমছে ডেল্টা লাইফের বিনিয়োগে। এই সময়ের মধ্যে কোম্পানিটির বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে ১১.১৬ শতাংশ। ২০১১ সালে ডেল্টা লাইফের বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬.৮৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে এসে ৫.১৬ শতাংশে নেমে আসে। ২০১১ সালে কোম্পানটির মোট বিনিয়োগ ছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আর ২০১৬ তে ছিল ৩ হাজার ৩৭৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
এছাড়া ২০১২ সালে ডেল্টা লাইফের বিনিয়োগ ছিল ২ হাজার ৪৮৯ কোটি ১৪ লাখ- প্রবৃদ্ধি হয় ১৫.১১ শতাংশ, ২০১৩ সালে বিনিযোগ ছিল ২ হাজার ৭৯১ কোটি ১৪ লাখ টাকা- প্রবৃদ্ধি হয় ১২.১৩ শতাংশ, ২০১৪ সালে বিনিয়োগ ৩ হাজার ৩৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা- প্রবৃদ্ধি হয় ৮.৮৩ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে বিনিয়োগ ছিল ৩ হাজার ২০৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা- প্রবৃদ্ধি হয় ৫.৬৪ শতাংশ।
নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহ, বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ থেকে আয় এবং রেভিনিউ সারপ্লাসের প্রবৃদ্ধি কমে আসলেও বৃদ্ধি পেয়েছে কোম্পানিটির লায়াবিলিটি বা দায়। ২০১০ সাল থেকে বিগত ৫ বছরে কোম্পানিটির দায়ের পরিমাণ বেড়েছে ১১১ শতাংশ। ২০১০ সালে কোম্পানিটির দায়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৮২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা ২০১৫ সালে এসে দাঁড়ায় ২ হাজার ৭০৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কোম্পানিটির ব্যবসা বৃদ্ধিতে ধরাবাহিকতা না থাকলেও দায়'র প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে ধারাবাহিকতা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রেভিনিউ সারপ্লাসের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার এ ধারা অব্যহত থাকলে সর্বোচ্চ লাইফ ফান্ডের কোম্পানি হিসেবে ডেল্টা লাইফের অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাদের মতে, কোন কোম্পানির আর্থিক ভিত নির্ভর করে রেভিনিউ সারপ্লাসের ওপর। রেভিনিউ সারপ্লাসের টাকাই লাইফ ফান্ডে যোগ হয়। ফলে কোম্পানির বিনিয়োগ, বিনিয়োগ থেকে আয়, মূলধন বৃদ্ধি তথা আর্থিক সক্ষমতার বৃদ্ধির সব কিছুই নির্ভর করে রেভিনিউ সারপ্লাসের ওপর।
বীমা বিশ্লেষকদের মতে, একটি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির রেভিনিউ সারপ্লাস কমে গেলে কোম্পানিটির গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডার উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্রাহকরা যেমন মুনাফা থেকে বঞ্চিত হয়, তেমনি লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হয় শেয়ারহোল্ডাররা। তাই রেভিনিউ সারপ্লাস প্রবৃদ্ধি করতে না পারলে ডেল্টা লাইফের আর্থিক ভিত ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে তারা মনে করছেন।
ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের আর্থিক অবস্থার এসব দিক নিয়ে কথা হয় কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও একাধিক কর্মীর সাথে। তারা কোম্পানির এমন পরিস্থিতির জন্য বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতাকেই দায়ি করে। তাদের মতে, কোম্পানি কোনো নীতিমালার ওপর চলে না চলে চেয়ারম্যান ও এমডি'র পছন্দ-অপছন্দের ওপর।
তাদের অভিযোগ, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের ঐতিহ্যবাহী ও বৃহৎ কোম্পানিটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক মুনাফা প্রদানের যে খ্যাতি ছিল তা এখন আর নেই। এখন অহরহই অভিযোগ আসছে দাবি পরশোধ না করার। প্রতিটি অফিসেই দাবির টাকার জন্য গ্রাহকদের ধর্ণা দিতে হচ্ছে। এরপরও সময়মতো টাকা পাচ্ছে না। এর প্রভাব পড়ছে নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহে।
এসব বিষয়ে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিসি) আদিবা রহমানের বক্তব্য জানতে তার ব্যক্তিগত ও অফিসের ই-মেইল ঠিকানায় লিখিতভাবে প্রশ্ন পাঠানো হয়। এক দিনের মধ্যে বক্তব্য জানাতে ৩১ মে, ২০১৭ তারিখে ই-মেইলটি পাঠানো হয়। এক সপ্তাহ পরেও মতামত না পাঠানোয় ৭ জুন তার মোবাইল ফোনে কয়েক দফা কল করা হয়। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয় সাড়া দেয়ার জন্য। ৮ মার্চও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে অফিসের পিএবিএক্স নম্বর ও সরাসরি টেলিফোন নম্বরে কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।