বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার উপায় হতে পারতো বীমা

আবদুর রহমান আবির: পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় এবার দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি, ফসল ও প্রাণিসম্পদের। ক্ষতিগ্রস্ত এসব সম্পত্তির বীমা করা নেই।  অপরদিকে স্বাস্থ্য ও জীবন বীমার পলিসিও এ অঞ্চলে কম। ফলে বানভাসি মানুষের এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারি সাহায্য ও ত্রাণের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। অথচ বীমা করা থাকলে বন্যার আর্থিক ক্ষতিপূরণ পেতে পারতো বীমা কোম্পানি থেকেই। এতে সরকারের ওপর চাপ কমে আসত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বীমা সম্পর্কে আমাদের দেশে সচেতনতা কম। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিশ্বব্যাপী নানা ধরণের বীমা স্কিম চালুর প্রচলন রয়েছে। কৃষি বীমা, শস্য বীমা, প্রাণিসম্পদ বীমা ইত্যাদি প্রচলন হচ্ছে দেশে দেশে। অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে বীমা। তাদের মতে, সরকারি বেসরকারি সকল পর্যায়েই বীমা সুবিধা দিতে নানা ধরণের স্কিম নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে বীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে।  তাহলে এ ধরণের ক্ষতি মোকাবেলা সহজ হয়ে উঠবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের কিছু অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি এখনো অবনতির দিকে। তবে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে এরইমধ্যে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। সেই সাথে বাড়তে শুরু করেছে এসব অঞ্চলের ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য জানানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে ক্ষতির এই হিসাব চূড়ান্ত হতে আরো অনেকটাই সময়ের প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ইউনিসেফ গত ২৭ জুন ‘মানবিক পরিস্থিতি প্রতিবেদন’ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৯টি জেলার ৭২ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ৪ লাখ ৭২ হাজার ৮৫৬ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বন্যায় ৫২ জনের মৃত্যুর খবর দেয়া হয়েছে।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে, গত ১৭ মে থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত সারাদেশে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮৬ জনে দাঁড়িয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বন্যাসৃষ্ট দুর্ঘটনা ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে এসব মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে সিলেট বিভাগেরই ৫৩ জন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে ২৮ জন এবং রংপুর বিভাগে এ পর্যন্ত পাঁচজন মারা গেছেন।

এদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যায় গত ২৮ জুন পর্যন্ত দেশের ১৫টি জেলায় ৬ হাজার ৫৬৯টি গবাদিপ্রাণির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২৮ কোটি ১৪ লাখ ৫১ হাজার ১৫০ টাকা। এই ক্ষতির প্রায় অর্ধেকই হয়েছে সিলেট বিভাগের ৪টি জেলার ৩৪টি উপজেলায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের বন্যায় সিলেটের ২২ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সড়ক, কৃষি ও মাছের। সিলেট জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক হিসাবে, বন্যায় নগরে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর সিটি করপোরেশনের হিসাবে নগরে ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকা। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, সিলেট জেলায় বন্যায় ১ হাজার ৭০৪ হেক্টর জমির বোরো, ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির আউশের বীজতলা ও ১ হাজার ৪৭১ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেটের উপপরিচালক মো. কাজী মজিবর রহমান।

সিলেট জেলা মৎস্য অফিসের হিসাবে, পানিতে ১৮ হাজার ৭৪৯টি পুকুর, দিঘি, খামারের মাছ ভেসে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যজীবীর সংখ্যা ১৫ হাজার ১৬৩। ভেসে গেছে ২ হাজার ৩০৫ টন মাছ, ২ দশমিক ১৩ টন পোনা। এ ছাড়া খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকার। সব মিলিয়ে বন্যায় এখানে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২২ কোটি টাকা।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও সম্পত্তির বীমার বিষয়ে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা কাজিম উদ্দিন বলেন, আকস্মিক এ বন্যায় ঘর-বাড়ি, মৎস, ফসল, গবাদি প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; প্রাণহানীও হয়েছে অনেক। তবে বন্যার কারণে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোন বীমা দাবি উত্থাপন হয়নি। এমনকি বন্যাদুর্গত অঞ্চলে আমাদের গ্রাহকদের খোঁজ-খবর নিতে কর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, এরপরও বীমা দাবির কোন তথ্য আসেনি।

তিনি আরো বলেন, বর্তমানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বেড়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের বীমাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে সময়োপযোগী বীমা পরিকল্প বাজারে আনতে হবে। মৎস, গবাদিপ্রাণি, ফসল ইত্যাদির বীমাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, সিলেটে আকস্মিক বন্যায় অনেক ঘরবারি, ফসল, গরু-ছাগলের ক্ষতি হয়েছে। এমনকি অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এক্ষেত্রে বীমা করা থাকলে অন্তত আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সহজ হতো।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক ও জেনিথ ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, ভয়াবহ এই বন্যায় এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোন বীমা দাবি উত্থাপন হয়নি। অন্যকোন কোম্পানিতে বীমা দাবি উত্থাপন হয়েছে বলেও শুনিনি। যদি এমনটাই হয়, তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের কেউই হয়তো বীমার আওতায় নেই।

এস এম নুরুজ্জামান বলেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ বীমা সম্পর্কে সচেতন নয়। তাছাড়া, সিলেট অঞ্চলে এমন ভয়াবহ বন্যা হতে পারে, বিষয়টি কেউই কল্পনা করতে পারেনি। অথচ, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের বীমা করা থাকলে বিপদের এই সময়ে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পেতো। বীমা পলিসির মেয়াদোত্তর দাবি বা সার্ভাইবেল বেনিফিট অথবা লোন নেয়ার সুযোগ পেতো।এ ছাড়াও স্বাস্থ্য বীমা থাকলে চিকিৎসার খরচ পেতো। অকাল মৃত্যুতে গ্রাহকের পরিবার বীমা দাবির অর্থ পেতো।

পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের সিলেট ব্রাঞ্চের ইনচার্জ ও কোম্পানিটির এসিসট্যান্ট ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আহমেদ তাজদিকুল মওলা বাপ্পি ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, বন্যায় এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোন বীমা দাবি উত্থাপন হয়নি। এমনকি অন্য কোন কোম্পানির কাছেও ক্লেইম হয়নি। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে যেসব বীমা পলিসি ইস্যু হয় তাতে সাধারণ বন্যার কাভারেজ নেন না গ্রাহকরা।

বাপ্পি বলেন, এ অঞ্চলের সকল নন-লাইফ বীমা কোম্পানির কর্মকর্তাদের সাথে আমাদের প্রায় আলোচনা হয়। কিন্তু বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি, গাড়ি, শিল্প-কারখানা- কোনটির বীমা দাবি উত্থাপন হয়েছে এমন কোন তথ্য এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে আসেনি।  যেসব খাদ্যগুদাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো সাধারণ বীমা করপোরেশনের কাছে বীমা করা।  এক কথায় বললে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বেসরকারি কোন সম্পদের বীমা কাভারেজ নেই।

ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের ডেপুটি ম্যনেজিং ডাইরেক্টর ও কোম্পানি সেক্রেটারি রফিকুর রহমান বলেন, সাধারণত দরিদ্র কৃষকরাই গবাদি প্রাণী পালন করে। এক্ষেত্রে একটি গবাদি প্রাণীর মৃত্যু যেন একজন কৃষকের মৃত্যু; বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পুরো পরিবার। গবাদি প্রাণীর মৃত্যুর ক্ষতি কাটিয়ে উঠে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে একটি কৃষক পরিবারের বছর পেরিয়ে যায়। এক্ষেত্রে বীমা করা থাকলে সহজে সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

তিনি বলেন, গবাদি প্রাণী বীমার প্রচারণা না থাকায় দেশের কৃষক পর্যায়ে এখনো এই বীমার গুরুত্ব অনুধাবন হয়নি। এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় বা এর আওতাধীন জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে এই বীমার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। তাহলে সিলেটসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যার মতো যেকোন প্রকৃতিক দুর্যোগে কৃষকদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহজ হবে।

রফিকুর রহমান আরো বলেন, গরু, মহিষ ও ছাগল-ভেড়াসহ প্রায় ১৫ হাজার গবাদি প্রাণী আমাদের কোম্পানির ক্যাটল ইন্স্যুরেন্সের আওতায় রয়েছে। তবে সিলেটসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট বন্যায় এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোন বীমা দাবি উত্থাপন হয়নি। কারণ, বীমাকৃত প্রাণীগুলোর প্রায় সবই নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া হয়েছে।  আর বন্যায় যেসব গরু-ছাগলের প্রাণহানী হয়েছে সেগুলোর কোনটি বীমার আওতায় ছিল না।

সাধারণ বীমা করপোরেশনের ম্যানেজর আবদুল করিম বলেন, সিলেটের হাওড় অঞ্চলে এবার আমাদের কোন বীমা করা ছিল না। বর্তমানে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, নওগাঁ, গাইবান্ধা ও শেরপুর অঞ্চলে সীমিত আকারে আমাদের শস্য বীমা চালু রয়েছে।  এসব এলা‌কার প্রায় ১৯ হাজার কৃষক বীমার আওতায় রয়েছে। গেলো মৌসুমে গাইবন্ধায় আমাদের প্রায় ১৮ লাখ টাকার বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির বিপণন, ব্যবসা উন্নয়ন ও দায়গ্রহণ বিভাগের এই ম্যানেজার আরো বলেন, বীমা সুবিধা পেলে কৃষকদের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়। নতুন উদ্যোমে তারা ফসল ফলাতে পারেন। তিনি বলেন, কৃষকদের জন্য সরকার সহায়তা দিলেও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা তা খুব একটা পান না। তবে বীমার মাধ্যমে সহযোগীতা করলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরাই পেয়ে থাকেন। এজন্য দেশজুড়ে শস্য বীমা চালু করা খুবই জরুরি।

এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে বীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রাথমিকভাবে কৃষি ঋণের সঙ্গে বীমা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। বিদেশি সাহায্যের সঙ্গেও বীমা যুক্ত করা যেতে পারে। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নির্দেশনা দিয়ে বেশি সংখ্যক কৃষককে বীমার আওতায় আনা সম্ভব। এতে করে সরকারের ওপর চাপ কমবে, বাড়বে কৃষকের সচ্ছলতা।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স প্রফেশনালস সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি এ কে এম এহসানুল হক এফসিআইআই বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে ক্ষুদ্রবীমার আওতায় আনা হয়। এটি একটি বীমা প্যাকেজ, যার মাধ্যমে বীমা গ্রহীতার বাড়ি-ঘর, ফসল, কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন- পাম্প, ট্রাক্টর ইত্যাদির ঝুঁকি গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশেও এভাবে বীমার প্যাকেজ চালু করা যেতে পার। যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারে।