অবৈধভাবে ৬০ কোটি টাকার কমিশন লেনদেন, ৩ লাখ টাকাতেই মাফ
আবদুর রহমান আবির: কমিশনের নামে ৬০ কোটি টাকার বেশি অবৈধ লেনদেন করেছে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। বীমা আইন ও আইডিআরএ’র ৪ ধরণের নির্দেশ লঙ্ঘন করে এই কমিশন দেয়া হয়েছে। অথচ এই অপরাধের জন্য জরিমানা করা হয়েছে মাত্র ৩ লাখ টাকা। যার মধ্যে কোম্পানিকে করা হয়েছে এক লাখ টাকা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহীকে ২ লাখ টাকা।
শুধু ৪ ধরনের নির্দেশ লঙ্ঘনই নয়, এমন সব ব্যক্তির নামে কমিশন দেয়া হয়েছে যাদের নাম-ঠিকানা নেই। আবার এমনভাবে কমিশন দেয়া হয়েছে যার কোন প্রমাণও নেই। ফলে এ ধরণের কমিশন লেনদেনে অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারের মত ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
কিন্তু আইডিআরএ ৩ লাখ টাকা জরিমানা করে তাদের দায় মুক্তি দেয়ায় বৈধতা পায় অবৈধ লেনদেন এবং ধামাচাপা পড়ে যায় অর্থ আত্মসাৎ বা অর্থ পাচারের সম্ভাব্যতা। বীমা খাত নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন কর্মকাণ্ডে বীমা খাতের দুর্নীতি বন্ধে সরকারের পদক্ষেপগুলো কার্যত অকার্যকর হয়ে উঠেছে। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে বিশেষ নিরীক্ষক হিসেবে চার্টার্ড একাউন্টস ফার্স একনাবিনকে নিয়োগ দেয়। প্রগ্রেসিভ লাইফের ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের বীমা ব্যবসা ও ব্যয় নিরীক্ষা করতে এ বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়।
বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান একনাবিন ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদনে ৪ ধরণের নির্দেশ লঙ্ঘন করে কমিশন দেয়ার এই চিত্র উঠে আসে।
বিশেষ নিরীক্ষার তথ্য মতে, গত ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ৬০ কোটি ২ লাখ ১১ হাজার ২৭৩ টাকা কমিশন ও এলাউন্স নগদে প্রদান করে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, কোম্পানিটিতে এজেন্টদের যে তালিকা রয়েছে তাতে এজেন্টের লাইসেন্স নাম্বার, কোড নাম্বার, চেইন কোড, মোবাইল নাম্বার, জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার নেই। এজেন্টদের তালিকায় থাকা অনেকের নাম ঠিকানাও পেন্সিল দিয়ে লেখা, অনেকের নাম ঘসামাজা করা আবার অনেকের নাম ফ্লুয়েড দিয়ে মুছে ওভার রাইটিং করা। এসব এজেন্টকে কমিশনের এই টাকা গ্রাহকের জমা করা প্রিমিয়ামের টাকার সাথে সমন্বয় করে এবং নগদে পরিশোধ করা হয়েছে।
২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালেও আইনের এসব লঙ্ঘন অব্যহত রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের এ সংক্রান্ত ত্রিপক্ষীয় শুনানী সভার কার্যবিবরণীতে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, বেসরকারি লাইফ বীমা কোম্পানি প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড শুধু কমিশন ও এলাউন্স প্রদানেই ৪ ধরণের নির্দেশ লঙ্ঘন করেছে। এসব লঙ্ঘনের মধ্যে রয়েছে-
লাইসেন্সবিহীন এজেন্টকে কমিশন প্রদান, ৭২ ঘণ্টার প্রশিক্ষণবিহীন ব্যক্তিদের কমিশন প্রদান, নগদে কমিশন প্রদান এবং প্রিমিয়ামের টাকা থেকে কমিশন কেটে রাখা বা প্রিমিয়ামের টাকার সাথে কমিশন বেতন-ভাতা বা রিলিজ সমন্বয় করা।
এসব নির্দেশ লঙ্ঘন করা হয়েছে ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে। যা আবার ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালেও অব্যহত রয়েছে।
আইডিআরএ’র ৪ ধরণের নির্দেশ লঙ্ঘন করায় প্রগ্রেসিভ লাইফকে ১ লাখ টাকা, ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের দায়িত্বরত মুখ্য নির্বাহীকে ১ লাখ টাকা এবং ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে দায়িত্বরত মুখ্য নির্বাহীকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করে।
অথচ বীমা আইন ২০১০ এর ১৩০ ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিটি লঙ্ঘনের জন্য সর্বোচ্চ জরিমানা ৫ লাখ টাকা, লঙ্ঘন অব্যহত থাকলে প্রতিদিন অতিরিক্ত জরিমানা ৫ হাজার টাকা।
এই হিসেবে ৪ ধরণের নির্দেশ লঙ্ঘন করে কমিশন দেয়ায় প্রতিটি অপরাধের জন্য ১ লাখ টাকা করে জরিমানা হলে বীমা কোম্পানিটির মোট জরিমানা হয় ৪ লাখ। আর এই লঙ্ঘন ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে অব্যহত থাকায় পরবর্তী ৩ বছরের জন্য প্রতিদিন প্রতিটি লঙ্ঘনের জন্য ৫ হাজার টাকা হিসেবে অতিরিক্ত জরিমানা দাঁড়ায় ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
অপর দিকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে জরিমানা করা হয়েছে ১৩৪ ধারায়। এ ধারায় সর্বোচ্চ জরিমানা ১ লাখ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৫০ হাজার। আর লঙ্ঘন অব্যহত থাকলে প্রতিদিন অতিরিক্ত জরিমানা ৫ হাজার টাকা। এই হিসেবে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার জরিমানা দাঁড়ায় ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
আইনের যেসব নির্দেশ লঙ্ঘন করে কমিশন দেয়া হয়েছে এবং যে কারণে এই জরিমানা-
বীমা আইন ২০১০ এর ৫৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি বাংলাদেশে বীমা ব্যবসা অর্জন বা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বীমা এজেন্ট বা এজেন্ট নিয়োগকারী বা ব্রোকার ব্যতিত অন্য কাহাকেও কমিশন বা অন্য কোন নামে কোন পারিশ্রমিক বা পারিতোষিক পরিশোধ করিবে না বা প্রদান করার জন্য কোন চুক্তি করিবে না’।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নং লাইফ-০২/২০১২ এর ক্রমিক নং ৩ এ বলা হয়েছে, ‘প্রিমিয়ামের সাথে কোন ধরণের খরচ/প্রাপ্য/দাবি/কমিশন ইত্যাদি সমন্বয় করা যাবে না’।
একই সার্কুলারের (নং লাইফ-০২/২০১২) ক্রমিক নং ৪ এ বলা হয়েছে, ‘বেতন ও ভাতা/কমিশন/রিলিজ/অন্যান্য প্রণোদনা একাউন্ট পেয়ি চেকের মাধ্যমে কেবল মাত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি/প্রতিনিধি নিয়োগকারী ব্যক্তিকে প্রদেয় হবে’।
এ ছাড়াও আইডিআরএ’র সার্কুলার নং- জিএডি ১২/২০১৪ অনুসারে, বীমা শিল্পে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বীমা ব্যবসার সাথে জড়িত প্রত্যেক বীমা এজেন্টকে এজেন্ট লাইসেন্স পেতে বা লাইসেন্স নবায়নের আগে আইডিআরএ’র স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে।
বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, প্রগ্রেসিভ লাইফ ২০১৫ সালে ২২ কোটি ২৬ লাখ ৮৬ হাজার ৯৯৩ টাকা, ২০১৬ সালে ২০ কোটি ১৬ লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৯ টাকা, ২০১৭ সালে ১৭ কোটি ৫৮ লাখ ৮৯ হাজার ৮৩১ টাকা কমিশন প্রদান করে।
প্রতিবেদন অনুসারে কোম্পানিটিতে ২০১৫ সালে ১৩ হাজার ৫৭০ জন, ২০১৬ সালে ১২ হাজার ৩৩৭ জন এবং ২০১৭ সালে ১০ হাজার ৩১৫ জন এজেন্টের তালিকা পায় নিরীক্ষক। তালিকাটি মাইক্রোসফট অফিস জেনারেটেট।
তবে তালিকার এসব এজেন্টের লাইসেন্স নাম্বার, কোড নাম্বার, চেইন কোড, মোবাইল নাম্বার, জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার নেই। এমনকি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারা এজেন্ট রেজিস্ট্রার যাচাই করা হয়নি এবং এসব এজেন্টের ৭২ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ নেই।
বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব এজেন্টকে কমিশন বাবদ ব্যয়ের ১০০ শতাংশই দেয়া হয়েছে নগদে ও প্রিমিয়ামের টাকার সাথে সমন্বয় করে।
প্রগ্রেসিভ লাইফের এই বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর গত ৩ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে ত্রিপক্ষীয় শুনানি সভা করে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। সভায় নগদে কমিশন/ভাতা প্রদানের জন্য বীমা আইন ২০১০ এর ১৩০ ধারা মোতাবেক কোম্পানিকে ১ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করা হয়।
এছাড়া লাইসেন্স বিহীন এজেন্টদের কমিশন দেয়ার জন্য বীমা আইন ২০১০ এর ১৩৪ ধারা মোতাবেক ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের দায়িত্বরত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে ১ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করে। একই সঙ্গে আইনের এই লঙ্ঘন অব্যাহত থাকায় ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে দায়িত্বরত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে ব্যক্তিগতভাবে ১ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করা হয়।
তবে লাইসেন্স বিহীন এজেন্টদের কমিশন দেয়ার অপরাধের জন্য বীমা কোম্পানিটিকে এবং প্রিমিয়ামের টাকা সমন্বয় করে কমিশন প্রদানের অপরাধে বীমা কোম্পানি ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা- কাউকে কোন জরিমানা আরোপ করেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
এমনকি ২০১৬ ও ২০১৭ সালে নগদে কমিশন প্রদান, প্রিমিয়ামের সাথে সমন্বয় ও লাইসেন্স বিহীন এজেন্টদের কমিশন প্রদানের জন্য বীমা কোম্পানটি বা মুখ্য নির্বাহীদের কাউকে কোন জরিমানা আরোপ করেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
এ বিষয়ে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত চন্দ্র আইচ বলেন, আইডিআরএ চাইলে জরিমানা বাড়াতে পারে আবার কমাতেও পারে। তারা যেমনটা মনে করেছে সেরকমটাই জরিমানা করেছে। তবে আমাদের রিভিউ করার কারণে এবং কোম্পানির আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে আইডিআরএ আমাদের জরিমানাটা আরো কমিয়ে দিয়েছে।
অপরাধের তুলনায় জরিমানা ঠিক আছে কিনা এমন প্রশ্নে অজিত চন্দ্র আইচ বলেন, জরিমানার বিষয়টি আইডিআরএ’র এখতিয়ারাধীন। তারা যেমনটা ভালো মনে করেছে তেমনটাই জরিমানা করেছে। এ নিয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই।
তবে এ বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।