জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধিতে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়বে বীমা খাতে

তাফহিমুল ইসলাম সুজন: দেশে জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাবে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফুয়েল, ট্রাভেলিং, কনভেয়ান্স, এন্টারটেইনমেন্টসহ বীমা কোম্পানিগুলোর বেশ কিছু খাতে এই খরচ বাড়বে। এর ফলে কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ন্ত্রণের যে চেষ্টা চলছে তাও খানিকটা বাধার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সরকার গত ৫ আগস্ট মধ্যরাত থেকে দেশে সকল প্রকার জ্বালানী তেলের মূল্য নতুন করে নির্ধারণ করেছে। এতে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম বেড়েছে ৩৪ টাকা, কেরোসিন ৩৪ টাকা, অকটেন ৪৬ টাকা এবং পেট্রোল ৪৪ টাকা। এর ফলে একজন ক্রেতাকে প্রতি লিটার ডিজেল ১১৪ টাকায়, কেরোসিন ১১৪ টাকায়, অকটেন ১৩৫ টাকায় ও পেট্রোল ১৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।

জ্বালানী তেলের এই মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহীদের সাথে আলাপ করেছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। তারা বলছেন, জ্বালানী তেলের দাম বাড়ার কারণে বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। তবে তা ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নির্ধারিত সীমার ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বছর শেষে আয়-ব্যয়ের হিসাব করার পরই তা স্পষ্ট হবে।

বীমা কোম্পানিগুলোর পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহীরা বলছেন, জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে লাইফ বীমা খাতে। নন-লাইফ বীমার তুলনায় লাইফ বীমায় সরাসরি প্রান্তিক মানুষের সাথে যোগাযোগ থাকে। তাছাড়া লাইফ বীমার মার্কেটিংয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। ফলে তাদের যাতায়াত খরচ আগের তুলনায় বেশ খানিকটা বৃদ্ধি পাবে।

জ্বালানী সংশ্লিষ্ট খরচের বিষয়ে ধারণা নিতে দেশের ২৫টি লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। এতে দেখা যায়, ২০২১ সালে ১৪টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির তেল খরচ ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা, যা ২০২০ সালে ছিল ২ কোটি ২২ লাখ টাকা। অপর দিকে ২০২০ সালে ১১টি লাইফ বীমা কোম্পানির তেল খরচ ১২ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা ২০১৯ সালে ছিল ১৬ কোটি ২০ লাখ টাকা।

ট্রাভেলিং ও কনভেয়ান্স খাতে গেলো বছর ১০টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি ৩৫ লাখ ২২ হাজার টাকা ব্যয় করেছে। এর আগে ২০২০ সালে এসব কোম্পানির এই ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৫৭ লাখ ৯ হাজার টাকা। এ ছাড়াও লাইফ বীমা খাতের ৯টি কোম্পানির ট্রাভেলিং ও কনভেয়ান্স খাতে ২০২০ সালের ব্যয় ছিল ১২ কোটি ৬৯ লাখ ২ হাজার টাকা, যা ২০১৯ সালে ছিল ১৪ কোটি ৬৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।

বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র ২০১৮ সালের তথ্য অনুসারে, দেশের ২৮টি লাইফ বীমা কোম্পানি ১ হাজার ৮৪১টি গাড়ি ব্যবহার করেছে এবং ৪৬টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি ব্যবহার করেছে ১ হাজার ১২৮টি গাড়ি।

এদিকে গত কয়েক বছর ধরেই ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে বীমা কোম্পানিগুলো। সর্বশেষ ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের সাময়িক হিসাব বিবরণী ও আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ৩২টি লাইফ বীমা কোম্পানির মোট ব্যবস্থাপনা ব্যয় ৩ হাজার ১৫২ কোটি  টাকা, যা ২০২০ সালে ছিল ২ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৫টি কোম্পানির ব্যয় কমেছে ৩৪৭ কোটি টাকা এবং ১৭টির ব্যয় বেড়েছে ১১৫ কোটি টাকা।

অপর দিকে ২০১৯ সালে ৪৫টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা খাতে মোট ব্যয় ছিল ১৯৩ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২১১ কোটি টাকা। এ অবস্থায় জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধিতে বীমা কোম্পানিরগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এদিকে আইন অনুসারে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় অবৈধ।

বিআইএ’র প্রথম ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং মেঘনা লাইফ ও কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্সের ভাইস চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ (পাভেল) বলেন, জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে দেশের বীমা খাতও প্রভাবিত হবে। তবে বড় ধরণের কোন প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। কারণ, কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগ গাড়ি তেলের পাশাপাশি গ্যাসেও চলে।

তবে জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে এবং এর প্রভাব পড়বে বীমা কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম আয়ে। মানুষের সঞ্চয়ের ক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি গাড়ি ক্রয়ের পরিমাণ কমে যাবে। যার কারণে লাইফ ও নন-লাইফ উভয় খাতের প্রিমিয়াম কিছুটা কমে আসতে পারে, বলেন নাসির উদ্দিন আহমেদ।

এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমাম শাহীন বলেন, জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে বীমা খাতে প্রভাব পড়বে, তবে ব্যবস্থাপনা ব্যয় সীমার ওপর তেমন কোন প্রভাব পড়বে না। আমাদের কোম্পানির যেসব কর্মকর্তাকে গাড়ি দেয়া হয়েছে এরইমধ্যে তাদের বলা হয়েছে যেন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া গাড়ি ব্যবহার না করে। অনলাইনে যেসব প্রোগ্রাম করা সম্ভব নয়, শুধু সেগুলো সরাসরি করতে বলা হয়েছে।

জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধিতে বীমা খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে লাইফ বীমায়। কেননা লাইফ বীমার মার্কেটিং কর্মীদের অনেক বেশি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হয়। এতে করে তাদের যাতায়াতের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়াও কোম্পানিগুলোর নিজস্ব গাড়ির খরচও অনেক বেড়ে যাবে।

বেঙ্গল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম মনিরুল আলম বলেন, জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধিতে আমাদের ব্যবস্থাপনা খাতে প্রভাব পড়বে। আমাদেরকে বিভিন্ন স্থানে ট্যুর করতে হয়। শুধু হেড অফিস না, সাথে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদেরও ট্যুর করতে হয়। যাতায়াত, ভেনু ও ফুয়েল এর ব্যয় বাড়ার সাথে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বাড়বে।

তবে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের অনুমোদিত সীমায় প্রভাব পড়বে কিনা এটা সেভাবে বলা যাবে না। এটা ব্যবস্থাপনা খাতের মেজর কোন ব্যয় না হওয়ায় অনুমোদিত সীমায় সেভাবে প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, বীমা খাতে মেজর ব্যয় হচ্ছে কমিশন। বলা যায়, ট্যুর, ফুয়েল ও  ভেনু ব্যয় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে।