আর্থিক প্রতিবেদনে গোঁজামিল: চার্টার্ড লাইফের ব্যাখ্যা ও আমাদের বক্তব্য

নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘গোঁজামিলে ভরা চার্টার্ড লাইফের আর্থিক প্রতিবেদন’ শীর্ষক সংবাদের ব্যাখ্যা দিয়েছে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম জিয়াউল হক স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা গত বুধবার (৯ নভেম্বর) বিকেল ৩.৩১টায় ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র ই-মেইলে পাঠানো হয়। এর আগে ৭ নভেম্বর ২০২২ তারিখে সংবাদটি প্রকাশ করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি।

ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র ওই সংবাদে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের আর্থিক প্রতিবেদনে হিসাবের গড়মিলে ৬ কোটি টাকার প্রিমিয়াম ও ১ কোটি টাকার কমিশন গোপন, প্রায় ১১ কোটি টাকার সম্পদ বেশি দেখানো, ১৩ কোটি টাকার খরচকে ১৮ কোটি টাকা দেখানো, ব্যবসা শুরুর প্রথম ৩ বছরে গ্রাহকের জমা করা সব টাকাই খরচ এবং ব্যবস্থাপনা খাতে ২৯ কোটি টাকা অবৈধ ব্যয়ের বিষয় তুলে ধরা হয়।

চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স এসব অভিযোগের কোনটির-ই সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। বরং কোম্পানিটির অবৈধ কর্মকাণ্ডকে আইনসিদ্ধ বলে মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়েছেন বীমা কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য চার্টার্ড লাইফের ব্যাখ্যা ও আমাদের বক্তব্য তুলে ধরা হলো-

চার্টার্ড লাইফ তাদের লিখিত ব্যাখ্যায় দাবি করেছে, ২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে ১ম বর্ষের প্রিমিয়াম ১৬ কোটি ১২ লাখ টাকা কিভাবে পরিবর্তন হয়ে ১০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা হয়েছে এবং গ্রুপ বীমার ৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা মুছে দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে ২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ৩.৫ নং নোটে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। যা প্রতিবেদক পড়েনি। এতে করে কোম্পানির সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে।

তাদের এ দাবি সঠিক নয়। মূলত ২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের লাইফ রেভিনিউ একাউন্টে যেখানে ১ম বর্ষের প্রিমিয়াম ১৬ কোটি ১২ লাখ টাকা পরিবর্তন করে ১০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে এবং গ্রুপ বীমার ৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা মুছে দেয়া হয়েছে সেখানে ৩.৫ নং নোটে এই পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে বলে তার কোন উল্লেখ নেই। এমনকি ২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের সম্পূর্ণ লাইফ রেভিনিউ একাউন্টের কোথাও ৩.৫ নং নোটের উল্লেখ নেই। 

অপর দিকে ‘নোটস অন দ্যা ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট’ –এ ৩.০৫ নং নোটটি প্রিমিয়াম সংগ্রহের হিসাব পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট কিনা তাও নোটটিতে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে চার্ডার্ড লাইফের এ বিষয়ক ব্যাখ্যা মনগড়া।

এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের সংখ্যাবাচক কোন পরিবর্তন পরবর্তী বছরে করতে হলে যৌক্তিক প্রেক্ষাপট এবং এই পরিবর্তনের আইনগত বৈধতা উল্লেখসহ সংখ্যাবাচক পরিবর্তনগুলো পৃথকভাবে সুস্পষ্ট করতে হয়। যা কোম্পানিটি করেনি। ফলে উল্লিখিত ৩.০৫ নং নোটটি প্রিমিয়াম সংগ্রহের হিসাব সংক্রান্ত এ দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।

চার্টার্ড লাইফের ব্যাখ্যায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, গ্রুপ বীমার ব্যবসা তারা প্রথমে একক বীমার ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম হিসেবে বিবেচনা করেছে। পরবর্তীতে তারা অডিটরের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে গ্রুপ বীমা ব্যবসাকে পৃথকভাবে দেখিয়েছে এবং তাদের এই ‘বিবেচনা’ হিসাব নীতিমালা অনুযায়ী ঠিক বলেও দাবি করেছে।

তাদের এ ব্যাখ্যা সঠিক নয়। ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে গ্রুপ বীমার ব্যবসাকে গ্রুপ বীমার ব্যবসা হিসেবে পৃথকভাবে-ই উল্লেখ করা হয়। তবে ২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে তা মুছে দেয়া হয়। তাই গ্রুপ বীমার ব্যবসা ‘প্রথমে’ একক বীমা হিসেবে দেখানো বলতে কি বুঝিয়েছে তা স্পষ্ট নয়।  

এছাড়া বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুসারে গ্রুপ বীমার প্রিমিয়াম একক বীমার প্রিমিয়াম হিসেবে ‘বিবেচনা’র কোন সুযোগ নেই। কারণ, গ্রুপ বীমার এজেন্ট কমিশন ও খরচের হার এবং একক বীমার এজেন্ট কমিশন ও খরচের হার ভিন্ন।  

বিধিমালা অনুসারে, গ্রুপ বীমায় খরচের সর্বোচ্চ সীমা ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে একক বীমার ক্ষেত্রে খরচের সর্বোচ্চ সীমা ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ গ্রুপ বীমার প্রিমিয়ামকে একক বীমার প্রিমিয়াম হিসাবে দেখানো হলে খরচের বৈধ সীমা বৃদ্ধি পায়।

লিখিত ব্যাখ্যায় কোম্পানিটি দাবি করছে ৭৮ লাখ টাকার কমিশন গোপন করা হয়নি এবং নিয়মানুযায়ী কমিশন প্রদান করা হয়েছে।

তাদের এ বক্তব্য সঠিক নয়। ২০২১ সালে এসে ৭৮ লাখ টাকা কম দেখানো বিষয়টি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনেই রয়েছে।

চার্টার্ড লাইফ তাদের ব্যাখ্যায় দাবি করেছে, কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ১৮ কোটি টাকা থেকে ৪.৫ কোটি টাকা বাড়িয়ে সাড়ে ২২ কোটি টাকা করা হয়েছে। যা সম্পদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে কোম্পানিটি ১০.৭৪ কোটি টাকার সম্পদ বেশি দেখিয়েছে।

এক্ষেত্রে ৪.৫ কোটি টাকার মূলধন সম্পদে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও বাকি থাকে আরো ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ পরিমাণ টাকা সম্পদে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেয়নি চার্টার্ড লাইফ। যার মধ্যে অবৈধভাবে বকেয়া প্রিমিয়ামের ৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা সম্পদে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা-ই দেয়নি বীমা কোম্পানিটি।

২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে লাইফ রেভিনিউ একাউন্টে উল্লেখিত ১৩ কোটি ১১ লাখ টাকার খরচ ২০২০ সালে আর্থিক প্রতিবেদনে ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা দেখানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি চার্টার্ড লাইফ।

অন্যদিকে ২৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিষয়টি স্বীকার করে এই ধরনের ব্যয়কে আইনসিদ্ধ বা বৈধ বলার চেষ্টা করেছে চার্টার্ড লাইফ। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি বলছে, বিপনন কর্মী ও কর্মকর্তাদের এই পেশায় টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরণের চর্চা দেশের জীবন বীমা শিল্পে ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

তবে বীমা আইন বলছে, অতিরিক্ত ব্যয়ের এই টাকা বীমা গ্রাহকের। অতিরিক্ত ব্যয়ের নামে গ্রাহকের টাকা খরচের কোন সুযোগ নেই।