বিদায়ী বছরে বীমা খাতে যত অর্জন
তাফহিমুল ইসলাম (সুজন): ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বিদায়ের পথে আরেকটি বছর। নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে দেশের বীমা খাত পার করছে ২০২২ সাল। বিদায়ী বছরে দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা খাতে সাড়া ফেলেছে নানান ঘটনা। আর এসব ঘটনা যেমন আলোচিত বা সমালোচিত, তেমনি বেশ কিছু অর্জনও বয়ে এনেছে বীমা খাতে। বছরজুড়ে বীমা খাতের উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন তুলে ধরা হলো-
জাতীয় বীমা দিবসকে ‘ক’ শ্রেণীতে উন্নীত
জাতীয় বীমা দিবসকে সরকার ‘খ’ শ্রেণী থেকে ‘ক’ শ্রেণীতে উন্নীত করেছে। এতে করে জাতীয় বীমা দিবসকে ‘ক’ শ্রেণীতে উন্নীত করায় সাধারণ মানুষের জন্য বীমার গুরুত্ব অনুধাবন করা আরো সহজ হবে এবং উন্নয়ন ত্বড়ান্বিত হবে বীমা খাত। প্রচার-প্রচারণা বাড়ার সাথে বীমা গ্রাহকদের সেবা প্রাপ্তি আরো সহজ হবে। স্বচ্ছতা আসবে দেশের বীমা ব্যবসায়।
২০২২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সভায় জাতীয় বীমা দিবসকে ‘খ’ শ্রেণী থেকে ‘ক’ শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে দিবসটিকে ‘ক’ শ্রেণীভুক্ত করার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়।
গত ১৩ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে বিষয়টি যথাযথ পরিপালনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাধারণ অধিশাখা। একইসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১৫ জানুয়ারি ২০২০ তারিখের বীমা দিবস সংক্রান্ত পরিপত্রটি বাতিল ঘোষণা করে।
প্রথম বারের মত প্রতিবন্ধীদের জন্য বীমা চালু
নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য নতুন বীমা পরিকল্প এই বছররে শুরুতে চালু করে সরকার। আর এই স্বাস্থ্য বীমা পরিকল্পের নামকরণ করা হয়েছে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা’। ২০২২ সালের ১ মার্চ জাতীয় বীমা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন ঘোষণা করেন নতুন এই বীমা পরিকল্পের।
স্বাস্থ্য ও জীবন ঝুঁকির ক্ষতি মোকাবেলায় অটিজম ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধীদের (এনডিডি) বীমার আওতায় আনতে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে উদ্যোগ নেয় সরকার। পাইলট প্রকল্প হিসেবে এটি বাস্তবায়নে কাজ করেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ বীমা করপোরেশন।
বেসরকারি লাইফ বীমা খতের জন্য উন্মুক্ত হয় বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা
শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা পলিসি চালু করে সরকার। পরিকল্পটি প্রথমে সরকারী লাইফ বীমা কোম্পানি জীবন বীমা করপোরেশনে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে চালু করলেও ২৯ নভেম্বর তা সকল বেসরকারি লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোকে চালুর নির্দেশ দিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা’ প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রমালিকানাধীন জীবন বীমা করপোরেশনের মাধ্যমে দেশের প্রাথমিক, কারিগরি এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বীমার আওতাভুক্ত করে পরিকল্পটির পাইলটিং করা হয়েছিল।
আর ২৯ নভেম্বর সকল বেসরকারি লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোকে চালুর অনুমোদন দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
এর ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন চলমান রাখা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে তাদের ঝরে পড়া রোধে ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা’ হতে পারে অন্যতম একটি মাধ্যম। এতে যেমন বীমার প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি পাবে, পাশাপাশি জীবন বীমা খাতে বীমার পেনিট্রেশন বৃদ্ধি পাবে। আবার অন্যদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কম বয়সী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনের ধারাবাহিকতাও বজায় থাকবে।
বীমা খাত উন্নয়নে ৯ সার্কুলার জারি
দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন বিষয়ে চলতি বছরে ৯টি সার্কুলার জারি করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এছাড়াও বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটি প্রবিধানমালা- ২০১২ এর সংশোধন এবং তা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য নতুন নতুন নির্দেশনাও জারি করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
৯ সার্কুলারের মধ্যে নন-লাইফ খাতে ৪টি, লাইফ খাতে ৩টি এবং সাধারণ (জিএডি) ২টি সার্কুলার জারি করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
ইংরেজি পাশাপাশি বাংলায় বীমা পলিসি ইস্যু
বীমা পলিসিতে উল্লেখিত শর্তসমূহ এবং পলিসি ইস্যুর সময় প্রয়োজনীয় দলিলাদির তালিকা ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় প্রণয়ন ও সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। ১৩ নভেম্বর চিঠির মাধ্যমে বীমা কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেয় বীমা খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
বীমা কোম্পানিগুলোর ইস্যুকৃত পলিসি সম্পূর্ণ ইংরেজিতে হওয়ায় অধিকাংশ বীমাগ্রাহক তাদের প্রাপ্যতা এবং প্রযোজ্য শর্তাবলি বুঝতে পারেন না। বীমা পলিসি বাংলা ভাষায় সহজ-সরল এবং বোধগম্য হলে সকলের বুঝতে পাবে। বীমা খাতের প্রেনিট্রেশন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বীমা পলিসিসমূহ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট দলিলাদি ইংরেজির পাশাপাশি সহজবোধ্য বাংলা ভাষায় প্রণয়ন করা জন্য নির্দেশ দেয় আইডিআরএ।
বীমা কোম্পানিগুলোর সম্পদ ছাড়িয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা
দেশে ব্যবসা করা ৮১ টি বীমা কোম্পানির মোট সম্পদ ৬০ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে ২০২১ সালের শেষে এসে। এর মধ্যে ৩৫টি লাইফ বীমা কোম্পানির মোট সম্পদ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আর ৪৬টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির সম্পদ পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।
২০১০ সালে দেশের বীমা কোম্পানিগুলোর মোট সম্পদ ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই ১১ বছরে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকায়।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমিকে ‘বঙ্গবন্ধু ইন্স্যুরেন্স ইনস্টিটিউটে’ রুপান্তর
দেশের বীমা খাতে এক বড় পরিবর্তন নিয়ে আসছে সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক মানের একটি ইন্স্যুরেন্স ইনস্টিটিউট পেতে যাচ্ছে দেশের বীমা খাতের। নাম দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু ইন্স্যুরেন্স ইনস্টিটিউট।
মূলত বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উত্থাপিত বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমিকে ইনস্টিটিউট করা হবে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানের বঙ্গবন্ধু ইন্স্যুরেন্স ইনস্টিটিউটে রূপান্তরকরণে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রস্তাব করার লক্ষ্যে ২০২১ সালের ১০ নভেম্বরে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
কমিটির দেয়া প্রস্তাবনাসহ চূড়ান্ত প্রতিবেদন আইনে খসড়া তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবদুল্যাহ হারুন পাশার সভাপতিত্বে খসড়া আইনের পর্যালোচনা সভা আয়োজন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
প্রথম বারের মত বহিরবিশ্বে বাংলাদেশের বীমা অফিস
প্রথমবারের মতো বহিরবিশ্বে থেকে প্রবাসীরা লাইফ বীমা পলিসির প্রিমিয়ামের টাকা দেশের ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে পারবে। প্রবাসী কর্তৃক বিদেশ হতে প্রিমিয়াম বাবদ প্রেরিত অর্থ ব্যাংক হিসাবে টাকায় জমা করার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
যুগান্তকারী এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দেশের লাইফ বীমার ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। আর এই প্রথম বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসীদের টাকায় প্রিমিয়াম জমা করার অনুমোদন দিয়েছে বেসরকারি বীমা কোম্পানি এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, প্রবাসী কর্তৃক বিদেশ হতে প্রিমিয়াম বাবদ প্রেরিত অর্থ বেসরকারি বীমা কোম্পানি এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যাংক হিসাবে টাকায় জমা হতে হবে। রিপোর্টিং এর সুবিধার্থে এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যাংক একাউন্টে সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কোর্ডের বিপরীতে জমা হবে। এক্ষেত্রে সরকারি বিধি মোতাবেক ট্যাক্স-ভ্যাট প্রযোজ্য হবে বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
৫ বছর পর নন-লাইফ ও দেড় বছর পর লাইফে সদস্য পেয়েছে আইডিআরএ
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) আইন অনুযায়ী সংস্থাটির শীর্ষ পদে একজন চেয়ারম্যান এবং একজন করে প্রশাসন, আইন, লাইফ ও নন-লাইফ বিষয়ক চারজন সদস্য থাকার কথা। পাঁচ বছর পর নন-লাইফ ও দেড় বছর পর লাইফ সদস্য নিয়োগ দিয়ে সরকার অবশেষে সেই কোটা পূরণ করেছে। প্রশাসন ও আইনবিষয়ক সদস্যের পদ কখনোই শূন্য ছিল না সংস্থাটির।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২৩ জুন ২০২২ সালে নন-লাইফ সদস্য হিসেবে মো. নজরুল ইসলাম এবং লাইফ সদস্য হিসেবে কামরুল হাসানকে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। দুজনের নিয়োগ তিন বছরের জন্য দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।