মুখ্য নির্বাহীদের দৃষ্টিতে নতুন বছরে বীমা খাতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
আবদুর রহমান আবির: নতুন বছর, নতুন চ্যালেঞ্জ; সম্ভাবনাও অপার। তবে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মেলবন্ধনে এগিয়ে যাবে দেশের বীমা খাত। ২০২৩ সালের বিষয়ে এমনটাই প্রত্যাশা দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর মুখ্য নির্বাহীদের।
তাদের মতে, ২০২৩ সাল নির্বাচনী বছর হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিরতার যেমন শঙ্কা রয়েছে; তেমনি অস্থিতিশীল বিশ্ব অর্থনীতি এবং দেশের ব্যাংকিং খাতের নেতিবাচক পরিস্থিতি বীমা খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্ভিক্ষের শঙ্কা, অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি- এসবই সঞ্চয়বিমুখ করতে পারে প্রত্যাশিত বীমা গ্রাহকদের।
তবে ই-কেওয়াইসি বাস্তবায়ন; ব্যাংকাস্যুরেন্স চালুর উদ্যোগ; বেসরকারী খাতের জন্য বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা উন্মুক্তকরণ আশা জাগিয়েছে দেশের বীমা খাতে। বিভাগীয় বীমা মেলা ও জাতীয় বীমা দিবস উদযাপন ইতিবাচক ধারণা তৈরি করছে মানুষের মাঝে। দাবি পরিশোধ জোরদার হওয়ায় বীমায় আস্থা বাড়ছে গ্রাহকদের।
সার্বিকভাবে নতুন বছরে ব্যবসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছেন প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী জালালুল আজিম। তিনি বলেন, ২০২৩ সালে দেশের বীমা খাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও নতুন কিছু সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও কিছু নতুন পদক্ষেপ নেবে। যেগুলো দেশের বীমা খাতকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেবে উন্নয়নের পথে।
তিনি বলেন, নতুন বছরে দেশে ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হওয়ার কথা রয়েছে। নতুন এই ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল চালু হলে আমরা আরো বেশি ব্যবসা করার সুযোগ পাবো। এটা বীমা খাতের পেনিট্রেশন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। তবে অটোমেশন বা ডিজিটাইজেশন ছাড়া এটা ফলপ্রসু হবে না। তাই নতুন বছরে বীমা খাতে বেশ কিছু অটোমেশন বা ডিজিটাইজেশনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন হবে।
জালালুল আজিম বলেন, এরইমধ্যে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ই-কেওয়াইসি চালুর নির্দেশনা দিয়েছে। কোম্পানিগুলো নিজেদের স্বার্থেই আরো কিছু ডিজিটাইজেশনের পদক্ষেপ নেবে। এসব পদক্ষেপের ফলে বীমা খাতে আরো প্রবৃদ্ধি ঘটবে।
নতুন বছরে বীমা খাতের চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, এমনিতেই খাতটির ইমেজ সংকট কাটানো যাচ্ছে না। নতুন করে এ বছর দেশের বড় একটি বীমা কোম্পানি ভেঙে পড়েছে। কয়েকটি বীমা কোম্পানির দাবি পরিশোধ এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে আসেনি। এ কারণে মানুষের মাঝে আস্থার সংকট থেকেই যাচ্ছে। তাছাড়া ২০২৩ সাল দেশের নির্বাচনী বছর। এ সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে। ফলে বীমা ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নতুন বছরেও থাকবে। এরইমধ্যে ডলারের দাম বেড়েছে; এলসি’র সংকট দেখা দিয়েছে। যার ফলে নন-লাইফ বীমার মেরিন ব্যবসা আরো কমে যাবে। এছাড়া দেশে রেমিটেন্স আসার পরিমাণ কমেছে, যার বড় প্রভাব থাকবে লাইফ বীমা খাতে। লাইফ বীমা গ্রাহকদের বড় একটা অংশ বিদেশে চাকরি করেন বা সেখান থেকে টাকা আসলে তাদের নিকটাত্মীয়রা বীমা পলিসি কেনেন। তাই রেমিটেন্স কমলে লাইফ বীমা ব্যবসাও বিঘ্নিত হবে।
হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, সার্বিকভাবে ২০২৩ সাল ভালো যাবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা। নতুন বছরে ব্যবসায়িক মন্দার একটা গুঞ্জণ রয়েছে; যার কারণে বীমা কোম্পানিগুলো বছরের শুরু থেকেই ভালো ব্যবসার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। আর এ কারণেই নতুন বছরটি ভালো যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, বীমা খাতে করোনার রেশ অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ- গ্রাহকদের দাবি পরিশোধ; যা অনেকটাই অনুকূলে চলে এসেছে। নতুন বছরে কোম্পানিগুলো যদি আরেকটা ধাক্কা চেষ্টা করে তাহলে বীমা দাবি পরিশোধের চাপটা কমে যাবে এবং গ্রাহক আস্থা বাড়বে। ফলে কোম্পানিগুলোর ব্যবসাও বাড়বে।
বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল আরা বলেন, ২০২৩ সাল নির্বাচনী বছর হওয়ায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির একটা শঙ্কা থেকেই যায়। তবে বিরোধী রাজনৈতিক জোটের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, যেটা ব্যবসার জন্য ইতিবাচক। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালকে বীমা খাতের জন্য ভালোর বছর বলেই আমরা মনে করছি।
জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী ও বিআইএফ’র ভারপ্রাপ্ত জেনারেল সেক্রেটারি এস এম নুরুজ্জামান বলেন, দেশের বীমা খাতের জন্য নতুন বছরে বেশ কিছু সম্ভাবনা রয়েছে। ডিজিটাইজেশনের অংশ হিসেবে ১ জানুয়ারি ২০২৩ থেকে দেশের বীমা খাতে চালু হচ্ছে ই-কেওয়াইসি। এটি বাস্তবায়ন হলে গ্রাহক পরিচিতি যাচাই সহজ হবে। ফলে পলিসি ইস্যু যেমন সহজ হবে তেমনি বীমা দাবি পরিশোধের জটিলতাও কমে আসবে। গ্রাহক আস্থা বাড়বে, বাড়বে বীমা ব্যবসা।
এ ছাড়াও নতুন বছরে ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হলে বীমার পেনিট্রেশন বাড়বে। এরইমধ্যে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা বেসরকারী খাতের কোম্পানিগুলোর জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা বাড়বে, বাড়বে বীমার পেনিট্রেশন। ইতোমধ্যে জাতীয় বীমা দিবস উদযাপনে সাধারণ মানুষের মাঝে বীমা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা বাড়তে শুরু করেছে। বীমা দাবি পরিশোধ আরো জোরদার করা গেলে গ্রাহকদের আস্থাও আরো বাড়বে। বিভাগীয় বীমা মেলাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
অন্যদিকে নতুন বছরে দেশের বীমা খাতকে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি হতে হবে। ২০২৩ সাল হবে দেশে নির্বাচনী বছর। এ কারণে নতুন বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে। ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতার পাশাপাশি অস্থিতিশীল বিশ্ব অর্থনীতিরও প্রভাব রয়ে যাবে দেশের বীমা খাতে। আবার বড় আকারের কোন বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারলেও বিশ্বে করোনা ভাইরাসের একটা প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে বলেও মনে হচ্ছে।
সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শফিক শামীম বলেন, বিভিন্ন আর্থিক জরিপে বলা হচ্ছে- দেশিয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ২০২৩ সাল হবে খুব কঠিনতার বছর। সুতরাং অর্থনীতি কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়লে বীমা খাতও কঠিন অবস্থায় পড়বে সেটা বলা হয়ে থাকে; তবে এমন কোন সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস নেই।
এক্ষেত্রে বিশ্ব অর্থনীতি যে মন্দা পরিস্থিতির মধ্যে চলছে সেখান থেকে ঘুরে না দাঁড়ানো পর্যন্ত বীমা খাতের চ্যালেঞ্জ থাকবে। এর ফলে বীমার সংখ্যা কমে যাবে। এরইমধ্যে মেরিন ইন্স্যুরেন্স কমে গেছে। আর মেরিন ইন্স্যুরেন্স কমে যাওয়া নন-লাইফ বীমা খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
শফিক শামীম বলেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে যখন মন্দা পরিস্থিতি চলে তখন আমার অভিজ্ঞতা হলো- এই সময়ে বীমা গ্রাহকদের মধ্যে অন্যায্য দাবি উত্থাপন করে বীমা কোম্পানির কাছ থেকে টাকা আদায়ের একটা প্রবণতা তৈরি হয়। গত এক বছরে আমি এমন পরিস্থিতি দেখে আসছি।
নতুন বছরে বীমা খাতে সম্ভাবনার বিষয়ে সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের এই মুখ্য নির্বাহী বলেন, দেশের বীমা খাতে একটি বড় সম্ভাবনা হলো- ২০২২ সালে আমাদের দেশ রপ্তানীর রেকর্ড ছুঁয়েছে। এর অর্থ হলো- বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার বেশ কিছু সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, রপ্তানী খাতের মধ্যে গার্মেন্টস শিল্প এরইমধ্যে তাদের অবস্থান ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছে। এটা চলতে থাকলে বীমা খাতের জন্যও ভালো হবে। অর্থাৎ বৈশ্বিক মন্দার পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে থাকতে পারলে আমাদের বীমা খাতের জন্যও সুখবর রয়েছে।
রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ খালেদ মামুন বলেন, বীমা খাতের জন্য ২০২৩ সালটি হবে অনিশ্চয়তার বছর। তাই ব্যবসার পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে তা এখনো বুঝে ওঠা কঠিন। তবে ২০২৪ সালের শুরুর দিকে যেহেতু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে তাই ২০২৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির একটা সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের মেগা প্রজেক্টগুলোর পাশাপাশি ছোট ছোট প্রজেক্টের বিনিয়োগও প্রায় বন্ধ। বেসরকারি প্রজেক্টগুলো তো এমনিতেই অর্থ সংকটে রয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতি ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়টিও অনিশ্চিত। অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে না উঠলে এবং দেশে দেশে যুদ্ধ বন্ধ না হলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে বলা মুশকিল।
সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত কোন সূচক-ই (ইনডেক্স) বীমা খাতের অনুকূলে নয়। তাই নতুন বছরে বীমা খাতের বিষয়ে কোন প্রত্যাশাও দেখছি না, বলেন রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী খালেদ মামুন।
ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জামিরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে দেশের নন-লাইফ বীমা খাত একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এবং সেটি হলো মেরিন বীমা ব্যবসা কমে যাওয়া। মূলত ডলার সংকটে এলসি খুলতে না পারার কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। নতুন বছরে বীমা খাতের জন্য এটি যেমন বড় চ্যালেঞ্জ, তেমনি সম্ভাবনারও বলতে পারি। কারণ, এই সংকট কেটে গেলেই আগের ভালো অবস্থায় ফিরে আসবে দেশের বীমা খাত।
জামিরুল ইসলাম বলেন, জনবহুল এই দেশের লাইফ বীমা খাতের পেনিট্রেশন অনেক কম। বলতে গেলে, এটি লাইফ বীমা খাতের জন্য একটি সম্ভাবনা। নতুন বছরে আমরা যদি এই শূণ্যতা (পেনিট্রেশন গ্যাপ) পূরণ করতে পারি তাহলেও আমাদের সম্ভাবনা বাস্তবে রূপায়িত হবে।
একইভাবে কৃষি নির্ভর এই দেশের নন-লাইফ খাতে ক্যাটল ইন্স্যুরেন্স ও ওয়েদার বেজড ক্রপ ইন্স্যুরেন্স একটি বড় সম্ভাবনার জায়গা। এটি যদি আমরা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি তাহলে নতুন বছরে আমরা আরো এগিয়ে যেতে পারব। একইসাথে এগিয়ে যাবে দেশের বীমা খাত, বলেন ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের এই মুখ্য নির্বাহী।