মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা

মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে অভিজ্ঞতার শর্ত তুলে নেয়ার দাবি বীমা ডিপ্লোমাধারীদের

নিজস্ব প্রতিবেদক: বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালায় মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে কর্ম অভিজ্ঞতার শর্ত তুলে নেয়া সহ বীমা পেশায় কাজের অভিজ্ঞতা কমিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন বীমা শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রিধারীরা।

বীমা ডিপ্লোমাধারীরা বলছেন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া বীমা খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এ মানব সম্পদের মান বাড়াতে হলে অর্থাৎ কর্মজীবিদের মধ্যে পেশাদারিত্ব বাড়াতে হলে যারা বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। তাহলে-ই সম্ভব হবে বীমা খাতের উন্নয়ন। অপেশাদার ব্যক্তিদের দ্বারা কোনভাবে বীমার মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

ব্যাংকিং খাতের উদাহরণ দিয়ে তারা বলছেন, দুই দশক আগেই ব্যাংকিং খাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বেতন দিতেন তারা। আর এ কারণে ব্যাংকিং খাতে দক্ষ জনবল তৈরি করা সম্ভব হয়। অথচ বীমা খাতে এমন কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি।

শুধু তাই নয়, যারা বীমা শিক্ষায় নানা ধরণের ডিপ্লোমাধারী অথবা বিদেশের উচ্চতর শিক্ষার সনদধারী তাদের জন্যও বিশেষ কোন সুযোগ রাখা হয়নি। এ অবস্থায় কোনভাবেই বীমা খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, বীমা খাতের উন্নয়নে পেশাদার ডিগ্রিধারীদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

উল্লেখ্য, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা ২০১২ এর ৩(খ) অনুসারে- মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগলাভের জন্য ইতোপূর্বে কোন বীমা কোম্পানিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বা এর অব্যবহিত নিম্নপদে অন্যূন ৩ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা সহ যে শ্রেণীর বীমার জন্য কোন ব্যক্তিকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব করা হবে অনুরূপ শ্রেণীর বীমা ব্যবসায় অন্যূন ১৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

প্রবিধানে নির্ধারিত এই কর্ম অভিজ্ঞতা নিয়ে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র সাথে আলাপ করেন বীমা ব্যবসায় পেশাদার ডিগ্রিধারী বেশ ক’জন। তাদের সেই আলাপচারিতা নিয়ে এ আয়োজন।

বীমা ব্যবসায় প্রফেশনাল ডিগ্রিধারীদের সংগঠন বিআইপিএস’র জেনারেল সেক্রেটারি এ কে এম এহসানুল হক এফসিআইআই বলেন, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালার খসড়া সংশোধনীতে এটি স্পষ্ট নয় যে, বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত যেমন- একচ্যুয়ারি, এসিআইআই, এফএলএমআই এবং অন্যান্য বীমা ডিপ্লোমাধারীদের বেলায় মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বীমা খাতে বহু বীমা ডিপ্লোমাধারী কর্মরত আছেন। বীমা পেশায় শিক্ষিত এবং যোগ্যতাসম্পন্ন এসব ব্যক্তিবর্গ বর্তমানে এ ব্যাপারে শিথিলতা না থাকায় সরাসরি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদে আবেদন করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বীমা খাতের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। বীমা খাতে কর্ম দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে এর কোন-ই বিকল্প নাই।

এ কে এম এহসানুল হক বলেন, ব্যাংকিং খাতে দু’দশক আগেই সর্বোচ্চ বেতন-ভাতা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের নিয়োগ দেয়া হয়। এ কারণেই ব্যাংকিং খাতে দক্ষ জনবল তৈরি সম্ভব হয়েছে। অথচ আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এই বীমা খাতে এমন কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, বীমা শিক্ষায় নানা ধরণের ডিপ্লোমাধারী বা বিদেশের উচ্চতর শিক্ষার সনদধারী কারও জন্য বিশেষ কোন সুযোগ রাখা হয়নি।

এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে- মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের অন্যান্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে বীমা ডিপ্লোমাধারীদের বেলায় মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে অভিজ্ঞতার শর্ত বাতিল করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে বীমা বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্যানেল গঠনের মাধ্যমে এবং যথাযথ প্রক্রিয়া, যেমন- লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তাকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই।

প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মামুনুল হাসান এসিআইআই বলেন, বীমা কোম্পানিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের নতুন বিধি (খসড়া)কে স্বাগত জানাই; যা ছিল একটা সময়ের দাবি। কিন্তু এই খসড়া বিধিতে আরো কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন; যা এ খাতের জন্য ভবিষ্যতে আরও ভালো ফল বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি।

এ ক্ষেত্রে খসড়া বিধিতে অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাগণ বীমা কোম্পানিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগের যোগ্যতা এই বিধিতে রাখা ঠিক হবে না। কারণ এতে করে বীমা খাতে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। যার ফলে ভবিষ্যতে মেধাবীরা এ খাতে আসতে অনিহা প্রকাশ করবে এবং বীমা কোম্পানিগুলোতে কর্মরত দক্ষ কর্মকর্তাদের কাজের গতিও কমে আসবে।

মামুনুল হাসান বলেন, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হতে হলে অবশ্যই তাকে কোন বীমা কোম্পানির ৩টি গুরুত্বপূর্ণ (কোর) ডিপার্টমেন্ট, যেমন- অবলিখন, দাবি, পুনর্বীমা ইত্যাদি বিভাগে কাজের দক্ষতা থাকতে হবে।

এক্ষেত্রে যাদের বীমার ওপর উচ্চতর ডিগ্রি আছে, যেমন- একচ্যুয়ারি, এসিআইআই, এফএলএমআই, বিআইএ এবং দেশ বিদেশের বীমা বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা আছে তাদের মুখ্য নির্বাহী বা এর অব্যবহিত নিম্নপদে ২ বছরের কাজের অভিজ্ঞতার শর্ত থেকে ছাড় দেয়া যেতে পারে।

এর ফলে ভবিষ্যতে অনেকেই বীমার ওপর উচ্চতর ডিগ্রির জন্য পড়ালেখা করবে এবং দক্ষ জনবল সৃষ্টি হবে; ফিরে আসবে এ খাতের শৃংঙ্খলা।

সাধারণ বীমা করপোরেশনের ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল মামুন এসিআইআই বলেন, দেশের বীমা খাত এগিয়ে যাক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া বীমা খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়। মূলত বীমা ব্যবসায় প্রফেশনাল ডিগ্রির মাধ্যমেই এ খাতের মানবসম্পদ উন্নয়ন হয়। কিন্তু বীমা পেশায় ডিগ্রিধারীদের যদি বিশেষ কোন সুবিধা বা ছাড় না দেয়া হয় তাহলে কেন-ইবা তারা এসব ডিগ্রি অর্জন করতে যাবে!

এক্ষেত্রে আমার দাবি- বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে একচ্যুয়ারি, এসিআইআই, এফএলএমআই সহ অন্যান্য বীমা ডিপ্লোমাধারীর জন্য মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে অভিজ্ঞতার শর্ত পুরোপুরি ছাড় দিতে হবে। একইসঙ্গে বীমা পেশায় অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ছাড় দিতে হবে। এ ছাড়াও সরকারি বীমা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে অতিক্রম না করার সিস্টেমটাও বন্ধ করতে হবে।

রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের এসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল কাদের এসিআইআই বলেন, দেশের বীমা খাতে এমনিতেই দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবলের অভাব। তারওপর যদি যোগ্যতাসম্পন্ন তথা বীমা পেশায় ডিগ্রিধারীদের গুরুত্ব না দেয়া হয় তাহলে এই অভাব দূর হবে না।

সেক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশা- একচ্যুয়ারি, এসিআইআই, এফএলএমআই সহ অন্যান্য বীমা ডিপ্লোমাধারীর জন্য মুখ্য নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে অব্যবহিত নিম্নপদে অভিজ্ঞতার শর্ত সম্পূর্ণরূপে বাদ দিতে হবে। এটা যদি না করা হয়, তাহলে দেশের বীমা খাতে এসব ডিগ্রিধারী দক্ষ জনবল তৈরি হবে না।

পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ও হেড অব রি-ইন্স্যুরেন্স এন্ড ক্লেইমস (নন-মটর) মোশাররফ হোসেন এসিআইআই বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও কোম্পানির পক্ষ থেকে কর্মকর্তাদের বীমা পেশায় ডিগ্রি নেয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্তু ব্যয়বহুল এসব ডিগ্রি অর্জনের পর প্রতিষ্ঠানগুলোর তাদের মূল্যায়ন করে না। এমনকি অনেক সময় এসব ডিগ্রিধারীরা কোম্পানিতে চাপের মুখে থাকেন। এ কারণে অন্যদের মাঝে এসব ডিগ্রি অর্জনে তেমন কোন আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না, যা বীমা খাতের জন্য একটি ব্যর্থতা।

মোশাররফ হোসেন আরো বলেন, মুখ্য নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে পেশাদার ডিগ্রিধারীদের বেলায় মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে কর্ম অভিজ্ঞতার শর্ত তুলে নেয়া উচিত। অথবা এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা চাওয়া যেতে পারে। পেশাদার ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দিতে না পারলে বীমা কোম্পানিগুলোর শীর্ষ পদে দক্ষ ও পেশাদার ডিগ্রিধারীর যে সংকট রয়েছে সেটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।