মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ প্রবিধানমালায় সংশোধন: যা বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার যেকোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বীমা বিষয়ক কাজে এক বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেই তিনি বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হাতে পারবেন। অথচ বীমা শিক্ষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা প্রয়োজন ১০ বছর। একইসঙ্গে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদেও তার ২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে; যা যুগ্মসচিব পদমর্যাদার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। 

এমন প্রস্তাব করা হয়েছে বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালার খসড়া সংশোধনীতে। আমলাদের ক্ষেত্রে এই বিশেষ ছাড় দেয়ার পাশাপাশি বীমা পেশাজীবী এবং এ পেশায় ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে কোন সুবিধা না রাখায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে বীমা খাতে। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র সাথে আলাপকালে বিষয়টি নিয়ে বীমা পেশাজীবী এবং পেশাগত ডিগ্রিধারীরা যা বলছেন তা নিয়ে এ আয়োজন।

বীমা ব্যবসায় প্রফেশনাল ডিগ্রিধারীদের সংগঠন বিআইপিএস’র জেনারেল সেক্রেটারি এ কে এম এহসানুল হক এফসিআইআই বলেন, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালার খসড়া সংশোধনীতে এটি স্পষ্ট নয় যে, বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত যেমন- একচ্যুয়ারি, এসিআইআই, এফএলএমআই এবং অন্যান্য বীমা ডিপ্লোমাধারীদের বেলায় মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বীমা খাতে বহু বীমা ডিপ্লোমাধারী কর্মরত আছেন। বীমা পেশায় শিক্ষিত এবং যোগ্যতাসম্পন্ন এসব ব্যক্তিবর্গ বর্তমানে এ ব্যাপারে শিথিলতা না থাকায় সরাসরি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদে আবেদন করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বীমা খাতের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। বীমা খাতে কর্ম দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বাড়ানোর ব্যাপারে এর কোন-ই বিকল্প নাই।

এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে- মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের অন্যান্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে বীমা ডিপ্লোমাধারীদের বেলায় মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে অভিজ্ঞতার শর্ত বাতিল করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে বীমা বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্যানেল গঠনের মাধ্যমে এবং যথাযথ প্রক্রিয়া, যেমন- লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তাকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট (বিআইপিডি)’র মহাপরিচালক ও প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মো. মোরতুজা আলী বলেন, একচ্যুয়ারি ছাড়াও এসিআইআই, এফএলএমআই সহ বীমায় উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের কর্ম অভিজ্ঞতায় ৫ বছর পর্যন্ত শিথিলতা দেয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদ হিসেবে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ক্ষেত্রে ১ বছর এবং উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ক্ষেত্রে ২ বছর কাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া যেতে পারে। এটা একেবারে উঠিয়ে দেয়াও ঠিক হবে না।

প্রবিধানমালা সংশোধনের খসড়া প্রস্তাবের বিষয়ে কাজী মোরতুজা আলী বলেন, বিদেশি বহুজাতিক বীমা প্রতিষ্ঠানে কর্ম অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ছাড় দেয়া হলে সেটা সুবিবেচনা প্রসূত হবে না; এটা বৈশম্য সৃষ্টি করবে। এটা করা ঠিক হবে না। এ ছাড়াও মুখ্য নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সের পাশাপাশি সর্বনিম্ন বয়সও নির্ধারণ করে দেয়া উচিত, এটা উঠিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। একইসঙ্গে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদ কোনটি হবে সেটাও নির্ধারণ করে দেয়া উচিত, বলেন লাইফ বীমার সাবেক এই মুখ্য নির্বাহী।

এ বিষয়ে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী মো. জালালুল আজিম এফএলএমআই বলেন, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালার খসড়া সংশোধনীতে ভালো-মন্দ দুটো দিক-ই আছে। দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মুখ্য নির্বাহীর সংকট থাকায় বীমা পেশায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞার পরিবর্তে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে- এটা ভালো। আবার মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে ৩ বছরের অভিজ্ঞতার পরিবর্তে ২ বছর চাওয়া হয়েছে- সেটাও ভালো দিক।

তবে বীমা বিষয়ক কাজে ১ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে যুগ্মসচিব পদমর্যাদার ব্যক্তিকে মুখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ দেয়া মোটেই ভালো দিক না। কারণ, যুগ্মসচিব পদমর্যাদার ব্যক্তির ক্ষেত্রে বীমা বিষয়ক কাজের অভিজ্ঞতা হবে মূলত আইনগত। কিন্তু বীমা তো শুধু আইনগত বিষয় নয়; এখানে ব্যবসা আছে, আন্ডার রাইটিং আছে, রি-ইন্স্যুরেন্স আছে, ক্লেইমস আছে, একচ্যুয়ারিয়াল টেকনিক্যাল বিষয় আছে- যেগুলো একজন যুগ্মসচিব পদের ব্যক্তির অভিজ্ঞতায় থাকার কথা নয়।

জালালুল আজিম বলেন, মূলত এ কারণেই বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর ক্ষেত্রে ১৫ বছর বা ১২ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। সেক্ষেত্রে ১ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ করা হলে সেটা বীমা খাতের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। আর যদি সেটাই হয়- সেক্ষেত্রে বাকীদের জন্য ১২ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা চাওয়ার কোন মানেই হয় না।

এ ছাড়াও বিদেশি বীমা কোম্পানিতে কাজের ক্ষেত্রে কর্ম অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে ৮ বছর। তাদেরকে অতিরিক্ত ছাড় দেয়া হচ্ছে; এটার কোন যৌক্তিকতা নেই। কারণ, বিদেশি বীমা কোম্পানিতে কাজ আর দেশি বীমা কোম্পানিতে কাজ- একই; বিশ্বজুড়ে বীমার প্র্যাকটিস তো একই। এক্ষেত্রে বিদেশি বীমা কোম্পানিতে কাজ করলে ৮ বছরের অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট হবে কেন, প্রশ্ন তোলেন প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এই মুখ্য নির্বাহী।

হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, বীমা শিল্পের উন্নয়নে ৫০টি কর্মকৌশল ও করণীয় নিয়ে ২০১৪ সালে জাতীয় বীমা নীতি প্রণয়ণ করা হয়। বীমা শিল্পের মানবসম্পদ উন্নয়নে এর ১৫ নং কর্মকৌশলে বীমা শিল্পে উচ্চতর ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে।

অথচ বীমা প্রতিষ্ঠানে মুখ্য নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে এই উচ্চ শিক্ষা বা ডিপ্লোমার বিষয়টি বাদ দেয়া হয়েছে। বিষয়টি বোধগম্য নয়।  

সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শফিক শামীম বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে ফলাফলের বিষয়ে একটা সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে, এটা ভালো। কর্ম অভিজ্ঞতা কমিয়ে আনাও ভালো। এটা সময়েরই চাহিদা, যুগোপযোগী উদ্যোগ। তবে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্ম অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে ৮ বছরে কমিয়ে আনা তথা পার্থক্য করাটা উচিত হবে না।

শফিক শামীম আরো বলেন, বীমা খাতে দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বাড়ানোর জন্য একচ্যুয়ারি ছাড়াও এসিআইআই, এফএলএমআই সহ বীমায় উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের কর্ম অভিজ্ঞতায় ৫ বছর পর্যন্ত শিথিলতা দেয়া প্রয়োজন।

চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী এস এম জিয়াউল হক এফএলএমআই বলেন, প্রস্তাবিত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ প্রবিধানমালা সংশোধনে সরকারের উদ্যোগকে চার্টার্ড লাইফের পক্ষ থেকে সাধুবাদ জানাই। প্রস্তাবিত প্রবিধানমালাটি বাস্তবায়িত হলে একদিকে যেমন নতুন নতুন মুখ্য নির্বাহী তৈরি হবে অন্যদিকে কোম্পানিগুলো দীর্ঘ দিন ধরে যে মুখ্য নির্বাহীর অভাবে ভুগছে, সেটিরও সুন্দর একটি সমাধান হবে।

এক্ষেত্রে আমাদের মতামত হচ্ছে- প্রস্তাবিত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ প্রবিধানমালায় সরকার বা সরকারের অধীনস্ত অন্য কোন খাতে সর্বশেষ কমপক্ষে যুগ্মসচিব পদমর্যাদার পদে কর্মরত ছিলেন, এরূপ ব্যক্তিকে আমরা সাধুবাধ জানাই। তবে বীমা বিষয়ে ১ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা নিতান্তই কম; এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫ বছর করা উচিত বলে আমরা মনে করি।

এ ছাড়াও প্রবিধান ৮ এর উপ-প্রবিধান (৪) এ ‘লভ্যাংশ’ এর পর ‘ইনক্রিমেন্ট, ইনসেনটিভ’ শব্দদয় সংযোজনের বিষয়ে আমাদের মতামত হচ্ছে- একজন মুখ্য নির্বাহী নিয়োগের পর ৩ বছর যদি একই বেতনে চাকরি করেন তাহলে তিনি উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন এবং কোম্পানির উন্নতির জন্য কোন কাজ করবেন না। সুতরাং কোম্পানির উন্নতির স্বার্থেই ইনক্রিমেন্ট ও ইনসেনটিভ দেয়ার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।