বীমা শিক্ষার বাধ্যবাধকতা নেই মুখ্য নির্বাহী নিয়োগে, উপেক্ষিত জাতীয় বীমা নীতি
আবদুর রহমান আবির: শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা হলেও পেশাগত ডিগ্রিধারীদের জন্য নতুন কোন সুবিধা দেয়া হয়নি বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালার সংশোধনীতে। অভিযোগ উঠেছে, পেশাগত ডিগ্রিধারীদের জন্য অভিজ্ঞতার শর্তে আগে যেটুকু ছাড় দেয়া হয়েছিল সেটিও এই সংশোধনীর মাধ্যমে কমানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেশাগত ডিগ্রিধারীদের জন্য নতুন করে কিছু সুবিধা দেয়া হলে বীমা শিক্ষার প্রতি যেমন আগ্রহ বাড়ত, তেমনি খাতটিতে দক্ষ জনবল তৈরির পথ সুগম হতো। একইসঙ্গে ২০১৪ সালে প্রণীত জাতীয় বীমা নীতির অন্যতম একটি কর্মপরিকল্পনা- বীমা কোম্পানির নির্বাহী পর্যায়ের নিয়োগে বীমা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার বিষয়টিও সহজতর হয়ে আসতো।
বীমা ডিপ্লোমাধারীরা বলছেন, মুখ্য নির্বাহী হিসেবে তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা অভিজ্ঞতার শর্ত। এক্ষেত্রে এই শর্ত আরো শিথিল করা প্রয়োজন। তাদের মতে, বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী নিয়োগে ১২ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বীমা পেশায় ডিগ্রিধারীদের জন্য এটি ৫ বছর করা যেতে পারে।
গত ২৪ ডিসেম্বর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা, ২০১২ এর সংশোধনীর প্রজ্ঞাপন গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। এর মাধ্যমে প্রবিধানমালাটিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। একদিকে ছাড় দেয়া হয়েছে কর্ম অভিজ্ঞতা ও স্নাতক ডিগ্রির মেয়াদে। অন্যদিকে জোর দেয়া হয়েছে ডিগ্রির ফলাফলে।
একইসাথে বন্ধ করা হয়েছে বীমা আইনের ৫০(১) ধারায় অপসারিত মুখ্য নির্বাহীর পুনর্নিয়োগের পথ। এ ছাড়াও বহুজাতিক বীমা কোম্পানির উর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা পদের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে রাখা হয়েছে ব্যতিক্রম। তবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি বীমা শিক্ষার। এমনকি নতুন কোন সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হয়নি বীমা ডিগ্রিধারীদের।
অথচ জাতীয় বীমা নীতির অন্যতম একটি কর্মপরিকল্পনা ছিল ‘বীমা শিল্পে নির্বাহী পর্যায়ে চাকরির ক্ষেত্রে বীমা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা থাকা বাধ্যতামূলককরণ’। বীমা খাতের উন্নয়নে ২০১৪ সালে এই নীতি প্রণয়ন করে সরকার। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর ২০১২ সালে প্রণীত মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ প্রবিধানমালায় এবার সংশোধনী আনা হলেও এতে উপেক্ষা করা হয়েছে জাতীয় বীমা নীতির এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা।
বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালার ধারা ৩ এর (গ) উপধারায় ১১টি পেশাগত ডিগ্রি বা পদধারীদের নিয়োগে অগ্রাধিকার দেয়া যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে দেশের বীমা শিল্পে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমির কোন ডিগ্রি এই অগ্রাধিকার প্রদানের তালিকায় স্থান পায়নি।
এ ছাড়াও সংশোধিত প্রবিধানমালার ধারা ৩ এর (ঘ) উপধারায় ৩টি পেশাগত ডিগ্রি বা পদধারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ১২ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা থেকে ৩ বছর এবং উপধারা (ঙ) –তে ৯টি পেশাগত ডিগ্রি বা পদধারীদের ক্ষেত্রে ১২ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা থেকে ২ বছর শিথিল করা যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বীমা ব্যবসায় প্রফেশনাল ডিগ্রিধারীদের সংগঠন বিআইপিএস’র জেনারেল সেক্রেটারি এ কে এম এহসানুল হক এফসিআইআই বলেন, বীমা খাতে দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে বীমা শিক্ষার কোন-ই বিকল্প নাই। এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী নিয়োগে বীমা বিষয়ক ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে যারা বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত আছেন তাদেরকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে বীমা খাতে বহু বীমা ডিপ্লোমাধারী কর্মরত আছেন। কিন্তু মুখ্য নির্বাহী হিসেবে তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা অভিজ্ঞতার শর্ত। এক্ষেত্রে প্রবিধানমালার এই শর্ত আরো শিথিল করা প্রয়োজন। বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী নিয়োগে ১২ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বীমা পেশায় ডিগ্রিধারীদের জন্য এটি ৫ বছর করা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
এ কে এম এহসানুল হক বলেন, বীমা খাতের উন্নয়নে সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার যেকোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এখন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স প্রফেশনালস সোসাইটি (বিআইপিএস)’র সাথে আলোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ, বীমা পেশায় শিক্ষিত পেশাদার ব্যক্তিদের নিয়ে দেশে এটিই একমাত্র সংগঠন।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের বর্তমান সদস্য সংখ্যা শতাধিক। যাদের মধ্যে রয়েছে এফসিআইআই, এসিআইআই, এফএলএমআই, এবিআইএ, এফআইআইআই এবং এআইআইআই’র মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রফেশনাল ডিগ্রিধারী। আর এদের মাধ্যমেই সম্ভব বীমা খাতের উন্নয়ন।
প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জালালুল আজিম, এফএলএমআই বলেন, বাস্তবতার নিরীখে শিক্ষাগত যোগ্যতায় যে শিথিলতা দেয়া হয়েছে সেটা স্বল্প সময়ের জন্য চলতে পারে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এটি বীমা খাতের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। আমাদেরকে অবশ্যই পেশাগত ডিগ্রিকে গুরুত্ব দিতে হবে। মূল্যায়ন করতে হবে বীমা শিক্ষায় শিক্ষিতদের।
এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানির শীর্ষ পদগুলোতে পেশাগত ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ দেয়ার জন্য আইডিআরএ’কে একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। যেই রোডম্যাপের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট একটা সময়ের পর, হতে পারে সেটা ৫ বা ১০ বছর, পেশাগত ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাইলে যেকোন সময় এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করতে পারে, বলেন জালালুল আজিম।
হোমল্যান্ড লাইফের সাবেক মুখ্য নির্বাহী ও ইন্স্যুরেন্স ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল বলেন, বীমা খাতের উন্নয়নে সরকার ২০১৪ সালে জাতীয় বীমা নীতি প্রণয়ন করেছে। এই নীতিতে ৫০টি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়। এর ১৫ নম্বর কর্মপরিকল্পনাই হলো- বীমা শিল্পের মানবসম্পদের উন্নয়ন।
এই কর্মপরিকল্পনার ‘ঘ’-তে বীমা শিল্পে নির্বাহী পর্যায়ে চাকরির ক্ষেত্রে বীমা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা থাকা বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানির সিইও নিয়োগে এই উচ্চ শিক্ষা বা ডিপ্লোমার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই বীমা খাতের উন্নয়নের স্বার্থেই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।
ড. বিশ্বজিৎ মন্ডল আরো বলেন, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে ইউজিসি’র সমতাকরণ সার্টিফিকেট দাখিল শুধু নতুনদের জন্য নয়, যারা ইতোমধ্যে বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রেও এটি দাখিল করা বাধ্যতামূলক রাখা প্রয়োজন। এতে করে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ডিগ্রির ভুয়া বা জাল সনদ দাখিল বন্ধ করা সম্ভব হবে।
রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ খালেদ মামুন এফসিআইআই বলেন, শিক্ষা এমন একটি জিনিস যা কারো ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। শিক্ষা নিজে থেকেই আসতে হয়, নিজেকেই এটা গ্রহণ করতে হয়। কেউ যদি নিজে থেকে শিখতে না চায়, তাহলে এটি চাপিয়ে দিয়ে কোন লাভ হবে না।
তবে বীমা শিল্পে যদি কেউ কাজ করতে চায় তাহলে তাকে বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন আছে। আর মুখ্য নির্বাহীর ক্ষেত্রে এটি অতীব প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তবে বীমা শিক্ষাকে বাধ্যগতভাবে নিতেই হবে এটার পক্ষে আমি নই, বলেন মোহাম্মদ খালেদ মামুন।
বীমা শিক্ষার বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর পর্যায়ে যারা থাকেন তাদের ক্ষেত্রে মিনিমান একটা বীমা শিক্ষা থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমির যে ডিপ্লোমা ডিগ্রি রয়েছে সেটি হতে পারে বীমা কোম্পানির একজন মুখ্য নির্বাহীর নূন্যতম বীমা শিক্ষা।
চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম জিয়াউল হক, এফএলএমআই বলেন- দেশের বীমা খাতে সবচেয়ে বড় সংকট রয়েছে দক্ষ জনবলের। এ কারণে অনেক সম্ভাবনা থাকার পরও খাতটি প্রত্যাশিতভাবে এগিয়ে যেতে পারেনি। এক্ষেত্রে বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ ও পেশাদার জনবল গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। তবে যথাযথ মূল্যায়ন না পেলে বীমা শিক্ষার প্রতি কারো আগ্রহ তৈরি হবে না, এটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিল- মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ প্রবিধানমালার সংশোধনীতে এই বীমা শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হবে। এক্ষেত্রে ২০১৪ সালে প্রণীত জাতীয় বীমা নীতির অন্যতম একটি কর্মপরিকল্পনা- বীমা শিল্পে নির্বাহী পর্যায়ের নিয়োগের ক্ষেত্রে বীমা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারত।
কিন্তু দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর ২০১২ সালে প্রণীত মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ প্রবিধানমালার সংশোধনী আনা হলেও এতে উপেক্ষা করা হয়েছে জাতীয় বীমা নীতির পরিকল্পনা। এটা বীমা ডিগ্রিধারীদের অনেকটাই হতাশ করেছে, বলেন এস এম জিয়াউল হক।