সোনালী লাইফের পরিচালনা পর্ষদকে কেন সাসপেন্ড করা হবে না- ব্যাখ্যা চেয়েছে আইডিআরএ
নিজস্ব প্রতিবেদক: সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদকে কেন সাসপেন্ড করা হবে না তার ব্যাখ্যা চেয়েছে আইডিআরএ। বীমাকারী ও বীমা গ্রহীতাদের স্বার্থ রক্ষার্থে এই ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। ৩ কার্য দিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। গতকাল বুধবার (২৪ জানুয়ারি) এই চিঠি পাঠানো হয় পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পরিচালক ইশরা তাহিয়াতকে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, বীমা আইনের বিধি-প্রবিধান লঙ্ঘন, নানাবিধ আর্থিক অনিয়মের জন্য বীমাকারী ও বীমা গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষার্থে বীমা আইন ২০১০ এর ৯৫(১) ধারা অনুসারে পরিচালনা পর্ষদকে কেন সাসপেন্ড করা হবে না। আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে না পারলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সুষ্ঠু তদন্তের জন্য নিরীক্ষককে তথ্য সরবরাহ না করা, নিরীক্ষককে কোম্পানির কম্পিউটার ডাটাবেজ সিস্টেমে প্রবেশ করতে না দেয়া, কোম্পানির নথিপত্রের মূল দলিল সরবরাহ না করা এবং তদন্ত চলাকালে মুখ্য নির্বাহীকে অফিসে ডুকতে না দিয়ে তাকে সাসপেন্ড করা ও মুখ্য নির্বাহীসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করার ঘটনাগুলো তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করার সামিল বলে উল্লেখ করে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য পরিচালনা পর্ষদকে কেন সাসপেন্ড করা হবে না তার ব্যাখা দিতে বলা হয় চিঠিতে।
পরিচালনা পর্ষদকে সাসপেন্ডের বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, আইন লঙ্ঘন করে আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে গ্রাহক স্বার্থহানী এবং কোম্পানির অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত ১৪টি অভিযোগ তদন্তের জন্য কর্তৃপক্ষ বীমা কোম্পানিটিতে গত ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসী চৌধুরী এন্ড কোং-কে নিয়োগ করা হয় এবং তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
তবে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান গত ৩ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অফিসে না থাকাসহ অন্যান্য কারণে তদন্ত ২০ দিন বিলম্ব করার আবেদন করেন। অন্যদিকে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা একটি আবেদনে জানান যে, বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অন্যান্যদের কর্তৃক তিনি অফিসে প্রবেশে বাধাগ্রস্থ হচ্ছেন এবং তার অফিস তালাবদ্ধ করা হয়েছে।
তদন্ত কার্যক্রমের জন্য তথ্য প্রদান কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব বিধায় তদন্ত কাজে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোন বাধা প্রদান না করার নির্দেশনা দিয়ে বোর্ড চেয়ারম্যানকে পত্র দেয়া হয়। কিন্তু কোম্পানির বোর্ডের হস্তক্ষেপ অব্যাহত থাকে এবং বোর্ড সভা করে তদন্ত কমিটি গঠন, কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা এবং কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারির বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে।
গত ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসী চৌধুরী এন্ড কোং কর্তৃপক্ষ বরাবর পত্র প্রেরণ করে জানায়, কার্যপরিধি অনুযায়ী তাদেরকে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সরবারহ করা হচ্ছে না, কোম্পানির কম্পিউটার বেইজ একাউন্টিং সিস্টেমে প্রবেশাধিকার দেয়া হচ্ছে না, সরবরাহকৃত ফটোকপির যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য মূল দলিলপত্র দেয়া হচ্ছে না এবং তদন্তকার্য পরিচালনায় বোর্ড আশানুরূপ সাহায্য সহযোগিতা করছে না।
এ ছাড়াও বোর্ডের চেয়ারম্যান ও কতিপয় পরিচালকদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত চলাকালে বোর্ড কর্তৃক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে তার পদ হতে সাসপেন্ড করা ও তদন্ত কমিটি গঠন করাসহ গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং তদন্তকারী নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নথিপত্র ও তথ্যাদি প্রদান না করা তদন্ত বাধাগ্রস্থ করার প্রচেষ্টা বলে প্রতীয়মান হয়। এতে তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদঘাটন বিঘ্নিত হওয়া এবং বীমাকারী ও বীমাগ্রহীতার স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
এই প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট বীমাকারী ও বীমাগ্রহীতাদের স্বার্থ রক্ষার্থে বীমা আইন, ২০১০ এর ৯৫ (১) ধারা অনুযায়ী সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা পর্যদকে কেন সাসপেন্ড করা হবে না তার লিখিত ব্যাখ্যা আগামী ৩ কার্য দিবসের (২৯ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখ) মধ্যে আবশ্যিকভাবে কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিলের জন্য বলা হলো। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
যেসব আর্থিক অনিয়ম তদন্তে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়-
কোম্পানির এফডিআর এর বিপরীতে সাউথ বাংলা ব্যাংকে এসওডি হিসাব নং- ০০০২৬২২০০০০৭৩ খোলা এবং উক্ত ঋণ হিসাব হতে ৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ও একই ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাব নং- ০০০২১৩০০০০৩৩৪ হতে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা উত্তোলন করে মোট ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ৪ জন পরিচালকের শেয়ার ক্রয়ের মূল্য পরিশোধ;
২০২২ সালে কোম্পানির বোর্ডে পারিবারিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে একই পরিবারের ৪ জন সদস্যের নামে বিপুল সংখ্যক শেয়ার বিনামূল্যে হস্তান্তর করে পরিবারের সর্বাধিক সদস্যকে পরিচালক রাখা;
২০২৩ সালে কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের (ড্রাগন সোয়েটার) প্রতি মাসে ঋণের কিস্তি বাবদ ৩ কোটি টাকা কোম্পানির হিসাব থেকে জনতা ব্যাংকে পরিশোধ করা;
বর্তমান চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন ভবন কোম্পানির জন্য ক্রয়ের নামে কোম্পানির এফডিআর এর বিপরীতে সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক হতে ১৫২ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ এবং এ জন্য ৩ বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকার বেশি সুদ প্রদান;
বর্তমান চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন ইম্পেরিয়াল ভবন কোম্পানি কর্তৃক ৩৫০ কোটি টাকায় ক্রয়ের জন্য করা সমঝোতা চুক্তি;
আইডিআরএ’র অনুমতি ছাড়াই অক্টোবর, ২০২১ হতে নভেম্বর, ২০২৩ সময়ে ইম্পেরিয়াল ভবনের মূল্য বাবদ বর্তমান চেয়ারম্যানের ৫৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা গ্রহণ;
একই সময়ে কোম্পানির তহবিল থেকে মোট ৬১ কোটি ৬২ লাখ ৯০ হাজার ৫শ’ টাকা উত্তোলনপূর্বক বর্তমান চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ;
কোম্পানির পরিচালকগণ কর্তৃক অবৈধভাবে মাসিক বেতনভাতা হিসেবে ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর হতে ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সময়কালে ৩ কোটি ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এবং পরবর্তীতে এরূপে আরো অর্থ গ্রহণ;
আইডিআরএ’র সার্কুলার অমান্য করে কোম্পানির চেয়ারম্যানের জন্য ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় বিলাসবহুল অডি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৭-৩৬৯৫) ক্রয় ও ২০২১-২৩ মেয়াদে এর রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ করা বিপুল ব্যয়;
চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের সদস্য পরিচালকগণ কর্তৃক কোম্পানির ঘোষিত লভ্যাংশের অতিরিক্ত লভ্যাংশ গ্রহণ;
কোম্পানির চেয়ারম্যানের বিদেশে চিকিৎসার যাবতীয় খরচ, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ভ্রমণ ও শপিং খরচ, বিদেশে পড়ালেখার খরচ অবৈধভাবে কোম্পানির তহবিল হতে নির্বাহ;
কোম্পানির একজন পরিচালক (শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল) এর ব্যক্তিগত অফিস কোম্পানির ভেতরে থাকা, গ্রুপ বীমা পলিসি থেকে বড় অঙ্কের কমিশন গ্রহণ এবং ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণে ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখ হতে পরিচালক না হয়েও বোর্ড সভায় অংশগ্রহণ, সম্মানী-বোনাসসহ বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণ এবং ব্যাংক হিসাবের সিগনেটরী থাকা;
কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যান ২০১৪ সাল থেকে ব্যক্তিগত ঋণ সমন্বয়, বিজিএমইকে অনুদান, এসি ক্রয়, বিনোদন (পারিবারিক অনুষ্ঠান, বিবাহের উপহার), দুপুরের খাবার ও সন্ধ্যার নাস্তার বিল, কোরবানির গরু ক্রয়সহ (২০২২ সালে) ব্যক্তিগত খরচ, ২০২২ ও ২০২৩ সালে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণ ব্যয় (১ কোটি ৯২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা) আইপিও খরচের নামে অতিরিক্ত টাকা (১ কোটি) এবং পলিসি নবায়ন উপহার বাবদ নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য ১ কোটি ২৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ইত্যাদি অর্থ কোম্পানি হতে আত্মসাত;
বর্তমান চেয়ারম্যানের ১৫ তলা ভবনে বিভিন্ন অফিস/প্রতিষ্ঠান ভাড়া থাকা সত্ত্বেও সকল ইউটিলিটি বিল কোম্পানি হতে পরিশোধ এবং ২০২১ সাল হতে ইম্পেরিয়াল ভবন কোম্পানি কর্তৃক পুরোপুরি ব্যবহার না করা সত্ত্বেও চেয়ারম্যান অবৈধ প্রভাবের মাধ্যমে পুরো ১৫ তলা ভবনের ভাড়া সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড হতে পরিশোধ; এবং কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যানের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ড্রাগন সোয়েটার ও স্পিনিং লি: এর ২০২১ সালের ট্যাক্স বাবদ (১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা) সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড হতে পরিশোধ।