গ্রাহকের স্বার্থ দেখার যেন কেউ নেই

গোল্ডেন লাইফের টাকা আছে ২২ কোটি, পুরনো গ্রাহকরাই পাবে ৩২ কোটি

নিজস্ব প্রতিবেদক: আর্থিক নিরাপত্তার জন্য গোল্ডেন লাইফে বীমা পলিসি করেন আবুল কালাম। তার পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। ৫ বছর ঘুরেও গোল্ডেন লাইফ থেকে বীমার টাকা পাননি আবুল কালাম। অভিযোগ জানিয়েছেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দফতরে। শুধু আবুল কালাম নয়, এমন শত শত গ্রাহক প্রতিদিনই অভিযোগ করছেন বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে। এরপরও টাকা পাচ্ছেন না গোল্ডেন লাইফের গ্রাহকরা। প্রতিদিনই হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। 

আবার কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় যা হচ্ছে তার চেয়ে খরচ বেশি। নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের হারও কম। ফলে কোম্পানির নতুন তহবিল গঠন হচ্ছে না। পুরনো বকেয়াও পরিশোধ হচ্ছে না। অপর দিকে নতুন গ্রাহকের দায় তৈরি হচ্ছে। যা পরিশোধের সক্ষমতাও নেই কোম্পানির।

গোল্ডেন লাইফের চোখে পরার মত সম্পদ ছিল তেজগাঁওয়ের প্রধান কার্যালয়ের জমি। সেই জমিও বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে কোম্পানিতে আছে ২২ কোটি টাকা। আর পুরনো বকেয়াই ৩২ কোটি ৫৭ লাখ।

গোল্ডেন লাইফের গ্রাহক হয়রানির এ অবস্থা পুরো বীমা খাতেই বিরুপ প্রভাব ফেলছে। সারাদেশের বীমা গ্রাহকদের কাছে গোল্ডেন লাইফ পুরো বীমা খাতের প্রতি অনাস্থা তৈরি করছে।

বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক সক্ষমতা হারানো কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত নিয়ে যারা দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। অন্যথায় বীমা খাতে আস্থা ফিরবে না।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বীমা গ্রাহকের টাকা পরিশোধের জন্য ২০১৯ সালে গোল্ডেন লাইফের প্রধান কার্যালয়ের তেজগাঁওয়ের জায়গাটি ৮০ কোটি টাকায় বিক্রি করে গোল্ডেন লাইফ। এই জমি বিক্রির অনুমোদন নেয়ার সময় গোল্ডেন লাইফ থেকে বলা হয়, জমি বিক্রির এই ৮০ কোটি টাকা থেকে ৩০ কোটি টাকা দিয়ে দাবি পরিশোধ করা হবে। বাকি টাকার মধ্য থেকে ২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হবে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে। আর ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা তফসিলি ব্যাংকগুলোতে স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা হবে। আর ১৩ কোটি টাকা দিয়ে প্রধান কার্যালয়ের জন্য একটি ফ্লোর স্পেস ক্রয় করা হবে।

তবে জমি বিক্রির পর ১৩ কোটি টাকা দিয়ে প্রধান কার্যালয়ের জন্য ফ্লোর স্পেস কেনার কথা থাকলেও ফ্লোর স্পেস কেনার চুক্তি করা হয় ৫১ কোটি টাকার। জমি বিক্রির টাকা থেকে অগ্রীম দেয়া হয় ১৮ কোটি টাকা। ফ্লোর স্পেস কেনার এই চুক্তি করা হয় আইডিআরএ’র অনুমোদন ছাড়াই।

জমি বিক্রির টাকা থেকে ২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ করা কথা থাকলেও তা করা হয়নি। গোল্ডেন লাইফের সিকিউরিটিজ বন্ডে এখন কোনো টাকাই নেই। জমি বিক্রির টাকা থেকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা তফসিলি ব্যাংকে বিনিয়োগ করা কথা। কিন্তু তফসিলি ব্যাংকেও কোনো স্থায়ী বিনিয়োগ নেই।

তফসিলি ব্যাংকে গোল্ডেন লাইফের স্থায়ী বিনিয়োগ রয়েছে সাড়ে ৪ কোটি টাকা। আর ফ্লোর স্পেসের জন্য অগ্রীম পরিশোধ করা ১৮ কোটি টাকা ছাড়া কোম্পানির আর কোনো টাকা নেই।

অথচ মেয়াদে শেষ হয়েছে এমন গ্রাহকদের পাওনা রয়েছে ৩২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আর এই পাওনা টাকা পরিশোধ করতে কোম্পানিতে সম্পদ বলতে রয়েছে মোট সাড়ে ২২ কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গোল্ডেন লাইফ যে পরিমাণ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে তার পুরোটাই খরচ করে ফেলে। আর পলিসি যা করছে তার বেশিরভাগই তামাদি হয়ে যাচ্ছে। ফলে নবায়ন প্রিমিয়াম না আসায় তহবিল গঠন না হয়ে আর্থিক ভিত তৈরি হচ্ছে না। ফলে পুরনো গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। আবার নতুন গ্রাহকের দায় বাড়ছে। এ অবস্থা চলছে বছরে পর বছর ধরে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গোল্ডেন লাইফ ২০২২ সালে মোট প্রিমিয়াম আয় করেছে ৪১ কোটি ১২ লাখ। খরচ করেছে ৪০ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আর ২০২৩ সালের ৯ মাসে মোট প্রিমিয়াম আয় করেছে ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা, যার মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকাই খরচ করে ফেলেছে।

এদিকে তহবিলে অবস্থাও খারাপ। ২০২২ সালে তহবিল ছিল ১৩ কোটি ৮ লাখ ৬১ হাজার টাকা। যা ২০২৩ সালে সেপ্টেম্বর এসে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, আইন অনুসারে সিকিউরিটিজে জামানত হিসেবে থাকতে হয় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অথচ ২০২২ সালে সিকিউরিটিজে জামানত ছিল ১ কোটি ৭ লাখ। এই টাকা থেকে ২০২৩ সালের ৯ মাসে তুলে ফেলেছে ৫৫ লাখ টাকা। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে সিকিউরিটিজে টাকা দাঁড়িয়েছে ৫২ লাখ।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুসারে কোম্পানিটিতে বিনিয়োগের মধ্যে এফডিআর আছে ৩ কোটি ৮০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ও অন্যান্য ১৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

সূত্র মতে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইউই) একটি তদন্ত করে গোল্ডেন লাইফে।

ওই তদন্তে দেখা যায়, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে কোম্পানিটিতে মোট বীমা দাবি উত্থাপিত হয় ২৭৫ কোটি ৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে পরিশোধ করা হয় ২১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। দাবি বকেয়া থাকে ৬১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

বিএফআইইউ এর তদন্তে আরো উঠে আসে, কোম্পানিটি ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালে অতিরিক্ত ব্যয় করে ৫৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ে ব্যয় করে ২১৩ শতাংশ।

২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সালে গোল্ডেন লাইফ মোট নতুন পলিসি ইস্যু করে ৫০ হাজার ৭৮৭টি। এর মধ্যে ল্যাপস বা তামাদি হয়ে যায় ৩৪ হাজার ৪৫৮টি। এছাড়া উন্নয়ন কর্মকর্তাদের অগ্রীম বেতন-ভাতা দেয়া হয় ২৮ কোটি টাকা।

ওই তদন্তের ওপর শুনানী করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। শুনানী শেষে অতিরিক্ত ব্যয়, প্রিমিয়াম আয়ের সমপরিমাণ টাকা ব্যাংকে জমা না করা, নিস্ক্রিয় এজেন্টদের কমিশন প্রদান, স্থায়ী সম্পত্তির পুনর্মূল্যায়ন করে রাজস্ব হিসাবে অন্তর্ভুক্তির জন্য কোম্পানিকে ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

এই জরিমানার টাকাও পরিশোধ করা হয় গোল্ডেন লাইফের তহবিল থেকে। অর্থাৎ গ্রাহকের টাকা ব্যয় করার অপরাধে জরিমানার টাকাও গুণতে হলো গ্রাহককেই। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত কোনো ব্যক্তিকে এই অনিয়মের জন্য কোনো জরিমানা করা হয়নি, কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি।

অথচ গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুন্ন করার জন্য পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়া ও পরিচালক, ব্যবস্থাপনা দায়িত্বশীল অব্যহতি বা বহিস্কার করা এখতিয়ার দেয়া আছে বীমা আইন ২০১০ এ।

এ বিষয়ে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন বলেন, গ্রাহক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে আমরা বীমা দাবি পরিশোধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। এ কারণে লাইফ ফান্ডসহ প্রিমিয়াম আয়ের টাকা কোম্পানিতে জমা রাখা হয়নি, প্রায় সব টাকাই গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধে ব্যয় করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, গ্রাহকদের বাকী পাওনা টাকাও আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। গেলো বছরেই আমাদের ২৪ কোটি ১৮ লাখ টাকার বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে। ২০২১ সালে আমি যোগদানের পর এই দাবি পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৬ কোটি টাকা।

গোল্ডেন লাইফের এই মুখ্য নির্বাহী বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের গ্রাহকদের বকেয়া দায়ের পরিমাণ ৩৪ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে আমাদের টাকা আছে ২২ কোটি ৫০ লাখ। এর মধ্যে আমাদের প্রধান কার্যালয় নির্মাণে অগ্রীম বাবদ বিনিয়োগ রয়েছে ১৮ কোটি টাকা এবং এফডিআর করা আছে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ব্যবসায়িক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পারলে গ্রাহকদের বাকী টাকাও খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই পরিশোধ করা সম্ভব হবে।