বীমা কাভারেজ নেই, ত্রাণের পথ চেয়ে বন্যার্তরা

আবদুর রহমান: এবারের বন্যায় দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি, ফসল ও প্রাণিসম্পদ। তবে ক্ষতিগ্রস্ত এসব সম্পদের কোন বীমা কাভারেজ নেই। বীমা সুবিধা থাকলে দুঃসময়ে সহায়তা পেতেন বানভাসিরা। এ ধরণের সুবিধা না থাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা হয়ে পড়েছে ত্রাণনির্ভর।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যায় কৃষি বিভাগের আনুমানিক ক্ষতি প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। মৎস্য ও পশুসম্পদ বিভাগের ক্ষতির পরিমাণও প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। রোববার পর্যন্ত দেশের ৩১ জেলায় ১১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে বীমা পণ্যের আবশ্যিকতা উপলব্ধি করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বন্যায় রোববার পর্যন্ত ৩১ জেলায় ৭ হাজার ৮৪৫টি গ্রামের ৬৮ লাখ ৯৯ হাজার ২৮ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকায় ৫ লাখ ১৮ হাজার ৮৭৫টি ঘরবাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ৫ লাখ ৭৭ হাজার ৫৭৯ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ সেবা বিভাগের সাম্প্রতিক তথ্য মতে, সারাদেশে প্রায় ৪৩ লাখ প্রাণি ও পোল্ট্রি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রাণির মধ্যে ৭ লাখ ৭৯ হাজার ১৬৬টি গরু, ৫৩ হাজার ৬৩৭টি মহিষ, ২ লাখ ৩৭ হাজার ৩৭৬টি ছাগল, ১ লাখ ৯ হাজার ৯০২টি ভেড়া, ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৬১৮টি মুরগি ও ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৪৯৬টি হাঁস রয়েছে।

এরআগে গত মার্চে পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় হাওড় অঞ্চলের ছয় জেলার ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও হাওড়ের মাছ। কর্মহীন হয়ে পড়েন হাওড়পাড়ের কৃষক ও শ্রমিকরা। সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে প্রকাশিত একটি হিসাবে দেখা গেছে, এসব ক্ষতির আর্থিক মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতায় যতটুকু সহযোগিতা করা সম্ভব তার চেয়ে অনেক বেশি সহযোগিতা করা সম্ভব বীমা কাভারেজের মাধ্যমে। এজন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে, বীমার আওতায় আনতে হবে এসব সম্পদ। প্রয়োজনে বীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে। তাহলে বানভাসী এসব মানুষ দ্রুত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। কারণ, বীমাকৃত সম্পদের ক্ষতিপূরণ সরাসরি গ্রাহকের কাছে পৌছায়।

পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা কিউএএফএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, উত্তরাঞ্চলে বন্যায় এবার বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এসব সম্পদের কোন বীমা নেই। বীমা কাভারেজ থাকলে ক্ষতিপূরণ পেতেন বানভাসীরা। তাহলে এতো এতো ত্রাণ তহবিল গঠনের প্রয়োজন হতো না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টাকা চায়। এটা না করে বীমা চালু করলে কোম্পানিগুলোই ক্ষতিপূরণ দিত।

তিনি বলেন, প্রতিবছরই বন্যা হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ বিতরণ করছে। কিন্তু কেউ বলছে না ক্ষতিগ্রস্তদের কিভাবে স্বয়ং সম্পূর্ণ করা যায়। দেশে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান আছে কিন্তু বীমা বাধ্যতামূলক নেই। তিনি বলেন, ত্রাণের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের সাময়িক কিছুটা সহযোগিতা করা যায়। তবে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। কিন্তু সম্পদের বীমা কাভারেজ থাকলে তাদের জন্য ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়।

সরকারের উদাসীনতার কারণে মানুষ বীমার সুবিধা পাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, সবাইকে বীমার আওতায় আনতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর বহু দেশে বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলাদেশে থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে আরো কিছু বীমা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। তাহলে দুর্যোগ মোকাবেলা সহজ হবে।

কোম্পানিগুলো ফসল ও প্রাণি সম্পদের বীমা চালু করছে না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী বলেন, বীমা কোম্পানি মূলত একটা ফান্ড তৈরি করে গ্রাহকের ক্ষতিপূরণ দেয়। এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বীমা চালু থাকা প্রয়োজন। স্বল্পমাত্রায় বীমা কাভারেজ চালু থাকলে কোম্পানির পক্ষে তা লোকসান হয়। এজন্য ব্যাপকভাবে বীমা চালু করতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।

দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে শস্য বীমা চালু করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সাধারণ বীমা করপোরেশনের (এসবিসি) আবহাওয়া সূচক ভিত্তিক শস্য বীমা প্রকল্পের পরিচালক ওয়াসিফুল হক। তিনি বলেন, কৃষকদের সহায়তায় বীমার বিকল্প নেই। সরকার পদক্ষেপ নিলে ভারতের মতো ব্যাপকভাবে শস্য বীমা সুবিধা দেয়া সম্ভব। প্রয়োজনে এগ্রিকালচার ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন গঠন করতে পারে সরকার। এজন্য সরকারি মহলে বীমা নিয়ে আরো ভাবনার প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ওয়াসিফুল হক জানান, দেশের তিনটি জেলায় পরীক্ষামূলক শস্য বীমা চালুর পর কৃষকের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। প্রথম দিকে কৃষকরা আগ্রহী না হলেও বীমা দাবি পাওয়ার পর তারা আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৭৭২ জন কৃষকের অনুকূলে শস্য বীমা পলিসি ইস্যু করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৩৭৩টি পলিসি ইস্যু করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে ৩২ লাখ ৮৩ হাজার ১০০ টাকা বীমা দাবি পরিশোধ করা হচ্ছে।

এসবিসি'র ওই প্রকল্পের ম্যানেজার মো. আমির হোসেন মিয়া বলেন, বীমা সুবিধা পেলে কৃষকদের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়। নতুন উদ্যোমে তারা ফসল ফলাতে পারেন। তিনি বলেন, কৃষকদের জন্য সরকার সহায়তা দিলেও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা তা খুব একটা পান না। তবে বীমার মাধ্যমে সহযোগীতা করলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরাই পেয়ে থাকেন। এজন্য দেশজুড়ে শস্য বীমা চালু করা খুবই জরুরি।

এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে বীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রাথমিকভাবে কৃষি ঋণের সঙ্গে বীমা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। বিদেশি সাহায্যের সঙ্গেও বীমা যুক্ত করা যেতে পারে। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নির্দেশনা দিয়ে বেশি সংখ্যক কৃষককে বীমার আওতায় আনা সম্ভব। এতে করে সরকারের ওপর চাপ কমবে, বাড়বে কৃষকের সচ্ছলতা