গ্রাহকের টাকা দিচ্ছে না প্রাইম ইসলামী লাইফ, মার খাচ্ছেন মাঠকর্মীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক: দিন যাচ্ছে আর আর্থিক সক্ষমতা হারাচ্ছে প্রাইম ইসলামী লাইফ। মেয়াদ উত্তীর্ণ পলিসির বীমা দাবির টাকা দিচ্ছে না কোম্পানিটি। আর গ্রাহকরা তাদের পাওনা টাকা না পাওয়ায় চড়াও হচ্ছেন মাঠকর্মীদের ওপর। সিরাজগঞ্জের একজন ইউপি চেয়ারম্যান অভিযোগ করেছেন গ্রাহকের টাকা দিতে না পারায় মার খাচ্ছেন কোম্পানিটির মাঠকর্মীরা।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রুহুল আমিন সরকারের বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা অভিযোগে প্রাইম ইসলামী লাইফের মেয়াদ উত্তীর্ণ বীমা পলিসির টাকা দ্রুত গ্রাহকদের পরিশোধের নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি বীমা কোম্পানিটির অনিয়ম বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। গত ১ এপ্রিল কর্তৃপক্ষে এ চিঠি পাঠান সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রুহুল আমিন সরকার।
আইডিআরএ বলছে, বীমা দাবির টাকা না পেলে গ্রাহকরা কর্তৃপক্ষে অভিযোগ করতে পারেন। সরাসরি কাগজপত্র পাঠিয়ে অথবা মোবাইল ফোনে এসব অভিযোগ দায়ের করতে পারেন গ্রাহকরা। এক্ষেত্রে অভিযোগের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানির কাছে পাঠানো হয়। ক্রমান্বয়ে এসব বীমা দাবি নিষ্পত্তি করে থাকে বীমা কোম্পানিগুলো।
গ্রাহকদের বীমা দাবি না পাওয়ার অভিযোগের বিষয়টি নিষ্পত্তির পর বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয় বীমা কোম্পানিগুলোর। এক্ষেত্রে অভিযোগ নিষ্পত্তি না হলে পরবর্তীতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়, বলেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির পরিচালক ও মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম।
আইডিআরএ’কে পাঠানো চিঠিতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, অপমান-লাঞ্ছনা ও হুমকি-ধামকির পর এখন গ্রাহকদের হাতে মার-ধরের শিকার হচ্ছেন প্রাইম ইসলামী লাইফের মাঠকর্মীরা। এমনকি ক্ষুব্ধ বীমা গ্রাহকদের তোপের মুখে নিজেদের বাসা-বাড়িতে থাকাও কঠিন হয়ে পড়েছে এসব বীমা কর্মীর।
ক’দিন পরপর ইউনিয়ন পরিষদের অফিস বা গ্রাম আদালতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে প্রাইম ইসলামী লাইফের বীমা কর্মীদের। অসহায় বীমা গ্রাহকদের অসংখ্য অভিযোগের মুখোমুখী হতে হচ্ছে তাদের। এমনকি বীমার টাকা না দিয়ে বীমা কোম্পানির অফিসে ভুক্তভোগী গ্রাহকদের হয়রানী করা হচ্ছে, যার দায় নিতে হচ্ছে এসব বীমা কর্মীর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাইম ইসলামী লাইফের বিরুদ্ধে বীমার টাকা পরিশোধ না করার অভিযোগ এসেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে। শুধু গ্রাহকরা-ই নন, কোম্পানিটির বীমা কর্মীরাও এমন অনেক অভিযোগ দায়ের করেছেন কর্তৃপক্ষে।
২০১৮ সালে মেয়াদ উত্তীর্ণ বীমা দাবির টাকা এখনো পাননি প্রাইম ইসলামী লাইফের অনেক গ্রাহক। ফলে দীর্ঘদিন আগে মেয়াদ উত্তীর্ণ বীমা দাবির টাকা না পেয়ে চরম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন এসব বীমা গ্রাহক। চড়াও হচ্ছে বীমা কোম্পানিটির মাঠকর্মীদের ওপর।
প্রাইম ইসলামী লাইফের বীমা কর্মী সিরাজগঞ্জ সদরের বাসিন্দা মো. নুরুল হুদা আইডিআরএ’র কাছে লিখিত অভিযোগে বলেন, আমি পেশায় একজন মুয়াজ্জিন। গ্রামের মসজিদে আজান দেই। পরিবারের অর্থের যোগান দিতে একসময় যোগ দিয়েছিলাম প্রাইম ইসলামী লাইফে। দীর্ঘ ১৬ বছর কাজ করেছি প্রতিষ্ঠানটিতে।
তিনি বলেন, গ্রামের লোকজনের কাছে আমার একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। তাই তারা আমার কাছে বীমা করতে কোন দ্বিধা করেনি। কিন্তু এখন আমি তাদের সেই বিশ্বাস ধরে রাখতে পারছি না বীমা কোম্পানির কারণে। বয়স এখন আমার প্রায় ৭০ বছর। এই বয়সে এসে মানুষের কটু কথা শুনতে হচ্ছে। এটা আমার জন্য কতটা কষ্টের তা বলে বুঝানো যাবে না।
নুরুল হুদা বলেন, বীমা কোম্পানি থেকে টাকা দিতে দেরি হওয়ায় গ্রাহকরা আমার বাড়িতে এসে গালাগাল করছে, হুমকি-ধামকিও দিচ্ছে। এখন আমি কী করব বুঝতে পারছি না। কোম্পানির কাছে যোগাযোগ করেও কোন লাভ হচ্ছে না। তারা শুধু সময়ক্ষেপন করছে, গ্রাহকের টাকা দিচ্ছে না।
প্রাইম ইসলামী লাইফের আরেক বীমা কর্মী আমজাদ হোসেন অভিযোগ করে বলেন, গ্রামের অনেক মানুষ আমাকে বিশ্বাস করে বীমা করেছে প্রাইম ইসলামী লাইফে। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তারা প্রিমিয়ামের টাকা যুগিয়েছে। প্রয়োজনের সময় যাতে কাজে আসে সেই আশায় বুক বেধেছে বছরের পর বছর। কিন্তু তাদের সেই আশা আজ দূরাশায় পরিণত হয়েছে।
পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলেও বীমার টাকা পরিশোধ করছে না প্রাইম ইসলামী লাইফ। অনেক কষ্টে জমানো বীমার টাকা এখন ফেরত পেতে তাদের ঘুরতে হচ্ছে বীমা কোম্পানির দ্বারে। আমরা এজেন্ট হয়েও গ্রাহকের টাকার জন্য কোম্পানির অফিসে ধর্ণা দিয়েছি বারবার। কিন্তু তাতেও মিলছে না বীমার টাকা।
সিরাজগঞ্জ জেলার ৩ নং বহুলী ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. ফরহাদ হোসেন শেখ ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, প্রাইম ইসলামী লাইফে আমার নিজেরও একটা বীমা পলিসি রয়েছে। বেশ কিছু দিন হলো সেটার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এখনো আমাকে টাকা দেয়নি কোম্পানি। এ অঞ্চলে অন্য বীমা গ্রাহকদের অবস্থা আরো খারাপ।
এদিকে প্রাইম ইসলামী লাইফের প্রিমিয়াম আয়, বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ থেকে আয় কমে যাচ্ছে। ফলে লাইফ ফান্ডে নতুন তহবিল যোগ না হয়ে প্রতি বছরই তা কমছে। অপরদিকে প্রতিনিয়তই বাড়ছে গ্রাহকের পাওনা। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধে কোম্পানিটির আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
২০২০ সালের একচ্যুয়ারিয়াল ভ্যালুয়েশন অনুসারে, প্রাইম ইসলামী লাইফের গ্রাহকের দায় ছিল ১৩৮৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। সে সময় কোম্পানিটির মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৯২৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি ছিল ৪৬১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
কোম্পানিটির তথ্য অনুসারে পূর্বের অনিষ্পন্ন বীমার দাবির পাশাপাশি ২০২৩ সাল এবং পরবর্তী ৫ বছরে মেয়াদ উত্তীর্ণ দাবি পরিশোধ করতে হবে ৭৫৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে ২০২৩ সালে পরিশোধ করতে হবে ১০১ কোটি টাকা।
আর গ্রাহকের এই টাকা পরিশোধের জন্য জুন ২০২৩ সালের অনিরীক্ষিত হিসাব অনুসারে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ৬৯০ কোটি টাকা। যার মধ্যে বিনিয়োগ ৬৭১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এই বিনিয়োগ থেকে প্রতি বছর সম্ভাব্য আয় রয়েছে ৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
এসব বিষয়ে প্রাইম ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সামছুল আলম ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, সম্প্রতি আইডিআরএ’র কাছ থেকে যেসব গ্রাহকের বীমা দাবি না পাওয়ার অভিযোগের ফাইল এসেছে সেগুলোর প্রায় সবই নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এরপরও কোন গ্রাহক বীমা দাবির টাকা না পেলে সেগুলো আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করার চেষ্টা করব।