আলফা লাইফের প্রিমিয়াম আয়ের পুরো টাকা জমা হয় না ব্যাংকে
আবদুর রহমান আবির: প্রিমিয়াম আয়ের পুরো টাকা জমা হয় না ব্যাংকে। আবার প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে এজেন্ট লাইসেন্স ছাড়া কমিশন দেয়া হয়েছে শত শত ব্যক্তিকে, যাদের বিষয়ে নাম-পদবি ছাড়া আর কোন তথ্য নেই কোম্পানিটিতে। যে পরিমাণ দায় রয়েছে সেই পরিমাণ বিনিয়োগও নেই। আবার বিনিয়োগ করা হয়েছে বিনিয়োগ নীতিমালা লঙ্ঘন করে।
প্রিমিয়াম আয়, ব্যবস্থাপনা ব্যয় এবং বিনিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম ছাড়াও বছরের পর বছর ধরে সব ধরণের আর্থিক প্রতিবেদনেই দেয়া হয়েছে আয়-ব্যয়ের গোঁজামিল ও গড়মিলের হিসাব। প্রতিবেদনগুলোতে দেয়া হয়েছে মিথ্যা তথ্যও। এককালীন বীমাকে মেয়াদি বীমা দেখিয়ে ব্যয় কম দেখানোর অভিযোগ রয়েছে।
ফলে গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় কোম্পানিটিতে কি পরিমাণ বিনিয়োগ থাকা প্রয়োজন আর কি পরিমাণ রয়েছে এবং ব্যয় কি পরিমাণ করছে তার কোন সঠিক তথ্য না থাকায় গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন ও বর্ষ সমাপনী হিসাবে বীমা কোম্পানিটির এমন চিত্রই উঠে এসেছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে আলফা ইসলামী লাইফ মোট প্রিমিয়াম আয় করেছে ২২ কোটি ৮০ লাখ ৮৭ হাজার ৮৫৪ টাকা। যার মধ্যে ব্যাংকে জমা হয়েছে ১০ কোটি ৭৩ লাখ ১৭ হাজার ২৬২ টাকা। অর্থাৎ গ্রাহকের কাছ থেকে জমা নেয়া ১২ কোটি ৭ লাখ ৭০ হাজার ৫৯২ টাকা কোম্পানিটির ব্যাংকে জমা করা হয়নি। এই তথ্য উঠে এসেছে আইডিআরএ নিয়োগকৃত বিশেষ নিরীক্ষক মসীহ মুহিত হক এন্ড কোং এর প্রতিবেদনে।
আলফা ইসলামী লাইফের এই বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে নিরীক্ষক তার মতামতে বলেছেন, পলিসি ভিত্তিক প্রিমিয়ামের পুরো টাকা ব্যাংকে জমা করা হয়নি। ব্যাংকে জমা করা হয়েছে খরচ বাদ দিয়ে বাকী টাকা।
বিশেষ নিরীক্ষকের ওই প্রতিবেদনে আরো উঠে এসেছে, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে এজেন্ট লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তিদের নামে কমিশন দেয়া হয়েছে ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৬৪ টাকা। নাম ও পদবি ছাড়া এসব ব্যক্তির পরিচয় সংক্রান্ত আর কোন তথ্যই পায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খরচ বাদ দিয়ে প্রিমিয়ামের টাকা ব্যাংকে জমা করা এবং লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তিদের নামে কোটি কোটি টাকার কমিশন পরিশোধ করার মধ্য দিয়ে একটি কোম্পানির চরম অব্যবস্থাপনার চিত্র উঠে এসেছে। এ ধরণের চর্চা গ্রাহকের টাকা আত্মসাতসহ সব ধরণের আর্থিক অনিয়মের সুযোগ থেকে যায়।
গ্রাহকের দায় ১১৫ কোটি ৬৭ লাখ, বিনিয়োগ আছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ টাকা
আলফা ইসলামী লাইফে আইডিআরএ’র বিনিয়োগ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট দায়ের পরিমাণ ১১৫ কোটি ৬৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। আর কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৮৭ কোটি ১১ লাখ ৩৬ হাজার ৩৯৫ টাকা।
সে হিসাবে কোম্পানিটি তার মোট দায়ের চেয়ে ২৮ কোটি ৫৫ লাখ ৩১ হাজার ৬০৫ টাকা কম বিনিয়োগ করেছে। যা লাইফ বীমা কোম্পানির সম্পদ বিনিয়োগ প্রবিধানমালার শর্তের লঙ্ঘন।
আইন অনুসারে, লাইফ বীমা কোম্পানির দায়সমূহের সমপরিমাণ সম্পদ বাধ্যতামূলকভাবে দেশের নির্ধারিত বিনিয়োগ খাতে বিনিয়োগ করতে হয়।
সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগেও প্রবিধানমালার লঙ্ঘন
সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতাও লঙ্ঘন করেছে আলফা ইসলামী লাইফ।
কর্তৃপক্ষের বিনিয়োগ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আলফা ইসলামী লাইফের মোট সম্পদের পরিমাণ ১৬৭ কোটি ১৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের পরিমাণ ১২৪ কোটি ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৭৬০ টাকা।
অথচ কোম্পানিটি সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করেছে ২৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, যা মোট বিনিয়োগের ১৯.২৭ শতাংশ।
আইন অনুসারে কোম্পানিটির এই বিনিয়োগের পরিমাণ থাকার কথা ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ ১০.৭৩ শতাংশ কম বিনিয়োগ করেছে সরকারি সিকিউরিটিজে।
অনুমোদনহীন পলিসি বিক্রির অভিযোগ, এক পরিকল্পেই প্রিমিয়াম আয় ৮৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা
ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৯ সালে আলফা ইসলামী লাইফের সর্বমোট ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম ১ কোটি ৯১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এরপরেই প্রিমিয়াম আয়ের এই চিত্র পাল্টে যায়। ২০২০ সালের তুলনায় ৩ গুণের বেশি প্রিমিয়াম আয় হয় ২০২১ সালে। আলোচ্য বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ কোটি ৫৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা।
এরপরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালেও প্রায় ৩ গুণ প্রিমিয়াম আয় বৃদ্ধি পায় আলফা ইসলামী লাইফের। সে বছর কোম্পানিটি সর্বমোট ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করে ১১৭ কোটি ৯৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ সালে এসে এই প্রিমিয়াম আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫২ কোটি ৭৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।
ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২২ ও ২০২৩ সালে আলফা ইসলামী লাইফের সবচেয়ে বেশি পলিসি বিক্রি হয়েছে ‘ডিপিএস গোল্ড’। এই পলিসি থেকে আলোচ্য দু’বছরে কোম্পানিটি সর্বমোট ৮৮ কোটি ৫৫ লাখ ৭১ হাজার ১৬৯ টাকার ১ম বর্ষ বা নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে।
এর মধ্যে শুধু ২০২৩ সালেই কোম্পানিটি ৭০ হাজার ৪৯০টি ডিপিএস গোল্ড পলিসি বিক্রি করেছে। এসব পলিসি থেকে প্রিমিয়াম এসেছে ৫১ কোটি ৬৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০৮ টাকা। যা কোম্পানিটির আলোচ্য বছরে সংগৃহীত ১ম বর্ষ প্রিমিয়ামের প্রায় ৩৪ শতাংশ।
এর আগে ২০২২ সালে কোম্পানিটি সর্বমোট ৫৪ হাজার ৪৮৫টি ডিপিএস গোল্ড পলিসি বিক্রি করে ৩৬ কোটি ৯১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬১ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে। সে বছর কোম্পানিটির সংগৃহীত মোট নতুন প্রিমিয়ামের প্রায় ৩১ শতাংশ ছিল ডিপিএস গোল্ড পলিসির।
অভিযোগ রয়েছে আলফা ইসলামী লাইফের এই পলিসির অনুমোদন নেই। আবার একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এটি ‘সিঙ্গেল প্রিমিয়াম’ বা এককালীন বীমা পলিসি। আইন অনুসারে সিঙ্গেল প্রিমিয়ামে খরচ করতে পারে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ। এই হিসাবে মোট প্রিমিয়াম আয় থেকে ৭ শতাংশ খরচ বাদ দিলে বাকী টাকার পুরোটাই বিনিয়োগ করার কথা। কিন্তু কোম্পানিটি তা না করে ডিপিএস গোল্ড পলিসির খরচও করেছে মেয়াদী বীমা পলিসির খরচের হার অনুসারে এবং এর কোন টাকাই বিনিয়োগ করা হয়নি।
ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে দেখা যায়, সব ধরণের প্রতিবেদনেই গোঁজামিল দিয়ে আয়-ব্যয়ের হিসাব দিয়েছে আলফা ইসলামী লাইফ। গোঁজামিলের হিসাব দেয়া হয়েছে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা ব্যয়, লাইফ ফান্ড ও বিনিয়োগের তথ্যে।
২০২৩ সালের বর্ষ সমাপনী হিসাবে যেসব খাতে গোঁজামিল দেয়া হয়েছে
আলফা ইসলামী লাইফের বর্ষ সমাপনীর হিসাব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে ২০২২ সালের হিসাবে গড়মিল করা হয়েছে। কোম্পানিটির ২০২২ সালের সমাপনী হিসাব প্রতিবেদনে ২০২২ সালের মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ দেখানো হয় ১৫৩ কোটি ৫৭ লাখ ৬৭ হাজার ৬৯৮ টাকা।
অথচ ২০২৩ সালের বর্ষ সমাপনীর প্রতিবেদনে ২০২২ সালের এই মোট প্রিমিয়াম দেখানো হয়েছে ১৫৩ কোটি ৬০ লাখ ৬১ হাজার ৯৩০ টাকা। অর্থাৎ ২০২২ সালের মোট প্রিমিয়াম আয় ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৩২ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে।
কমিশন খরচ বেশি দেখানো হয়েছে ২৬ লাখ টাকা
২০২২ সালের বর্ষ সমাপনী হিসাব প্রতিবেদনে ২০২২ সালের প্রিমিয়াম সংগ্রহ বাবদ কমিশন খরচ দেখানো হয় ৪৬ কোটি ৩৮ লাখ ৪৬ হাজার ২৬০ টাকা। অথচ ২০২৩ সালের বর্ষ সমাপনীর প্রতিবেদনে ২০২২ সালের এই কমিশন খরচ দেখানো হয় ৪৬ কোটি ৬৪ লাখ ৪১ হাজার ৭৪৪ টাকা। অর্থাৎ ২০২২ সালের কমিশন খরচ ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে ২৫ লাখ ৯৫ হাজার ৪৮৪ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে।
৯৪ কোটি ৫২ লাখ টাকার খরচ হয়ে গেছে ১০২ কোটি ৭২ লাখ টাকা
২০২২ সালের বর্ষ সমাপনী হিসাব প্রতিবেদনে আলফা ইসলামী লাইফের ব্যবস্থাপনা খাতে মোট খরচ দেখানো হয়েছে ৯৪ কোটি ৫২ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭১ টাকা। অথচ ২০২৩ সালের বর্ষ সমাপনী হিসাব প্রতিবেদনে ২০২২ সালের এই মোট খরচ দেখানো হয়েছে ১০২ কোটি ৭১ লাখ ৫০ হাজার ৫৮৮ টাকা।
অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির খরচের হিসাবের গড়মিল ৮ কোটি ১৯ লাখ ১৫ হাজার ৭১৭ টাকা।
লাইফ ফান্ডের হিসাবে গোঁজামিল ৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা
২০২২ সালের বর্ষ সমাপনী হিসাব প্রতিবেদনে ২০২২ সালের লাইফ ফান্ড বা সমাপনী তহবিল দেখানো হয় ৬৮ কোটি ৮০ লাখ ৯০ হাজার ৩৪৪ টাকা। অথচ ২০২৩ সালের বর্ষ সমাপনীর প্রতিবেদনে ২০২২ সালের সমাপনী তহবিল দেখানো হয় ৫৯ কোটি ৬২ লাখ ৭৫ হাজার ৩০৬ টাকা।
অর্থাৎ ২০২২ সালের সমাপনী তহবিল ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে ৯ কোটি ১৮ লাখ ১৫ হাজার ৩৮ টাকা কম দেখানো হয়েছে।
গোঁজামিলের হিসাবে ৪০ কোটি ৮৪ লাখ টাকার বিনিয়োগ যেভাবে ৩৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা
২০২২ সালের বর্ষ সমাপনী হিসাব প্রতিবেদনে ২০২২ সাল শেষে মোট বিনিয়োগ দেখানো হয় ৪০ কোটি ৮৪ লাখ ২ হাজার ২৭৫ টাকা। অথচ ২০২৩ সালের বর্ষ সমাপনীর প্রতিবেদনে ২০২২ সালের এই বিনিয়োগ দেখানো হয় ৩৮ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ২৪০ টাকা।
অর্থাৎ ২০২২ সালের মোট বিনিয়োগ ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে ২ কোটি ২২ লাখ ৩২ হাজার ৩৫ টাকা কম দেখানো হয়েছে।
ব্যয়ের নতুন খাত যুক্ত করে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা খরচ
আইন দ্বারা নির্ধারিত হিসাব সমাপনী প্রতিবেদনের ‘ফরম- সি’ তে ব্যয়ের নতুন খাত যুক্ত করে ২ কোটি ৭৯ লাখ ৬১ হাজার ৩৯৪ টাকা ডেপ্রিসিয়েশন খরচ দেখিয়েছে আলফা ইসলামী লাইফ।
‘ফরম- বি’তে পরোক্ষ ব্যয়ের ক্ষেত্রে গাড়ির জ্বালানী ও অবচয় (ডেপ্রিসিয়েশন) খাতে খরচ দেখানোর পরও ‘ফরম- সি’তে নতুন করে খাত সৃষ্টি করে এই ব্যয় দেখিয়েছে বীমা কোম্পানিটি। অথচ আইনে নির্ধারিত ‘ফরম- সি’ তে এই খরচ দেখানোর কোন সুযোগ নেই বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
গোঁজামিলের হিসাব ২০২১, ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে
ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে দেখা যায়, নিরীক্ষিত বার্ষিক প্রতিবেদনেও গোঁজামিল দিয়ে আয়-ব্যয়ের হিসাব দিয়েছে আলফা ইসলামী লাইফ। গোঁজামিলের হিসাব দেয়া হয়েছে কোম্পানিটির প্রভিশন, কমিশন খরচ, ট্রাভেলিং এন্ড কনভেন্সের তথ্যে।
৩২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার কমিশন খরচ দেখানো হয়েছে ৩৫ কোটি ৫ লাখ টাকা
আলফা ইসলামী লাইফের ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে সর্বমোট কমিশন খরচ দেখানো হয়েছে সর্বমোট ৩২ কোটি ৮৫ লাখ ৯৭ হাজার ৩৯৩ টাকা। আবার ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ২০২১ সালের এই কমিশন খরচ দেখানো হয়েছে ৩৫ কোটি ৪ লাখ ৭২ হাজার ৭৫২ টাকা।
অর্থাৎ ২০২২ সালের প্রতিবেদনে ২০২১ সালের কমিশন খরচ ২ কোটি ১৮ লাখ ৭৫ হাজার ৩৫৯ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে।
মোট খরচের চেয়ে ৫৭ গুণ বেশি প্রভিশন
২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রভিশন ফর স্যালারি এন্ড এলাউঅ্যান্স (ডেভেলপমেন্ট স্টাফ) দেখানো হয়েছে ১৪ কোটি ২২ লাখ ২ হাজার ৫৪ টাকা।
অথচ ২০২২ সালের ডেভেলপমেন্ট স্টাফ স্যালারি খাতে (নোট নং ২৫.০০) সর্বমোট খরচ দেখানো হয়েছে ২৪ লাখ ৯৫ হাজার ৩৩০ টাকা।
অর্থাৎ পুরো বছরে স্টাফ স্যালারি খাতে যত টাকা খরচ হয়েছে তার চেয়ে ১৩ কোটি ৯৭ লাখ ৬ হাজার ৭২৪ টাকা বা ৫৭ গুণ বেশি প্রভিশন দেখানো হয়েছে।
ট্রাভেলিং এন্ড কনভেন্সের হিসাবে গড়মিল
২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ট্রাভেলিং এন্ড কনভেয়ান্স খাতে খরচ দেখানো হয়েছে ২ কোটি ২৩ লাখ ২৪ হাজার ১৭৪ টাকা।
আবার ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ২০২১ সালের ট্রাভেলিং এন্ড কনভেন্স খরচ দেখানো হয়েছে ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৮১৫ টাকা।
অনিয়ম-গড়মিলের প্রমাণ বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও
আলফা ইসলামী লাইফের এসব অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও। কোম্পানিটির ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের ওপর এই বিশেষ নিরীক্ষা পরিচালনা করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। এতে কোম্পানিটির বেশ কিছু গুরুতর অনিয়ম খুঁজে পায় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান মসীহ মুহিত হক এন্ড কোং।
এর মধ্যে গ্রাহকের কাছ থেকে জমা নেয়া আলফা ইসলামী লাইফের ১২ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার টাকার প্রিমিয়াম ব্যাংকে জমা না করার অনিয়মটি অন্যতম।
প্রিমিয়াম সংগ্রহ ২২.৮১ কোটি টাকা, ব্যাংকে জমা ১০.৭৩ কোটি টাকা
বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে ২০১৮ থেকে ২০২০ এই তিন বছরে আলফা ইসলামী লাইফ প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ২২ কোটি ৮০ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। তবে ব্যাংকে ডিপোজিট বা জমা করে ১০ কোটি ৭৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ সংগৃহীত প্রিমিয়ামের ৫৩ শতাংশ তথা ১২ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা করা হয়নি।
এর মধ্যে ২০১৮ সালে ৩ কোটি ১২ লাখ ১১ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে ১ কোটি ৭২ লাখ ৩২ হাজার টাকা এবং ২০২০ সালে ৭ কোটি ২৩ লাখ ২৮ হাজার টাকার প্রিমিয়াম ব্যাংকে জমা করা হয়নি।
ডিসিএস কালেকশন এবং ব্যাংক ডিপোজিটের তথ্য যাচাই করে বেরিয়ে আসে আলফা ইসলামী লাইফের এই অনিয়ম।
খরচ গোপন করে লাইফ রেভিনিউ ফান্ড বৃদ্ধি
এ ছাড়াও স্থায়ী সম্পত্তি, অগ্রিম ভাড়া, এজেন্ট ব্যালান্স এবং আউটস্ট্যান্ডিং প্রিমিয়ামসহ অন্যান্য খারাপ ঋণের ১ কোটি ২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা খরচ হিসেবে দেখানো হয়নি লাইফ রেভিনিউ একাউন্টে।
এর ফলে খরচ হওয়ার পরও লাইফ রেভিনিউ ফান্ডে এই অর্থ প্রতিফলিত হচ্ছে বা সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয় ওই বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।
আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নুরে আলম সিদ্দিকী অভি ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, ডিপিএস গোল্ড পলিসির অনুমোদনের জন্য আইডিআরএ’র কাছে আবেদন করা হয়েছে। আমাদের একচ্যুয়ারি বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। আশা করছি, খুব শিগগিরই আমরা এর অনুমোদন পেয়ে যাবো।
তিনি আরো বলেন, ডিপিএস গোল্ডের প্রিমিয়াম মাসিক ভিত্তিতে নেয়া হয়। তবে কেউ যদি এক সাথে দিতে চায় সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক বছরের প্রিমিয়াম আমরা একসাথে নিয়ে থাকি। এই পলিসির খরচও আমরা নিয়ম মেনেই করে থাকি।
প্রতিবেদনে গোঁজামিলের বিষয়ে অভি বলেন, ২০২৩ সালের হিসাব সমাপনী প্রতিবেদনের অবস্থা এই মুহুর্তে আমি বলতে পারছি না। তবে অডিটেড রিপোর্ট আসলে আপনাদের অভিযোগের বিষয়ে বলতে পারব। আশা করি অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই অডিটেড রিপোর্টটা আমার হাতে চলে আসবে।
প্রিমিয়াম আয়ের পুরো টাকা ব্যাংকে জমা না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৮-২০২০ সালে অ্যাডভান্স অ্যাডজাস্টমেন্টের কারণে এই সমস্যা ছিল। তবে এখন কোন অ্যাডভান্স অ্যাডজাস্টমেন্ট করার সুযোগ নেই। প্রিমিয়ামের শতভাগ টাকাই এখন ব্যাংক একাউন্টে জমা দিতে হয়; তারপর কমিশনসহ খরচের টাকা দেয়া হয়।
তিনি আরো বলেন, অ্যাডভান্স অ্যাডজাস্টমেন্টের বিষয়টি আইডিআরএ’র বিশেষ নিরীক্ষায় উঠে এসেছিল। সেটার বিষয়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষে জবাব দেয়া হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নতুন করে আর কোন অ্যাডভান্স অ্যাডজাস্টমেন্ট হচ্ছে না কোম্পানিতে।
দায়ের সমপরিমাণ সম্পদ বিনিয়োগ না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, কোম্পানির হাতে আগে অর্থ-সম্পদ কম ছিল, এ কারণে দায়ের চেয়ে বিনিয়োগের পরিমাণ কম হয়েছিল। চলতি বছরের জুন শেষে আমরা সেই সমস্যার সমাধান করেছি। বর্তমানে কোম্পানির দায় অনুযায়ী বিনিয়োগ রয়েছে।
নুরে আলম সিদ্দিকী অভি আরো বলেন, ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল এই ৪ বছরে আমরা ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে আইডিআরএ’র অনুমোদিত সীমার মধ্যেই আছি এবং অনেক টাকা আমরা কম খরচ করেছি। এর মধ্যে ২০২৩ সালেই আমরা প্রায় ১৬ কোটি টাকা কম খরচ করেছি।