কোটা সংস্কার আন্দোলন

সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ: বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ গুণতে হবে সাধারণ বীমা করপোরেশনকে

আবদুর রহমান আবির: কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বিক্ষোভ ও পরবর্তী সময়ে ঘটা সংঘাতে নজিরবিহীন ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায়। এ ঘটনায় রাষ্ট্রীয় বীমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি)-কে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ গুণতে হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) পর্যন্ত তেমন কোনো বীমা দাবি উত্থাপন হয়নি বলে জানিয়েছেন বীমা প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা জোনাল অফিসের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মো. আবদুল মতিন। ক্ষয়-ক্ষতির তথ্য জানতে এরইমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বীমা পলিসির গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে সাধারণ বীমা করপোরেশন।  

প্রসঙ্গত, বীমা করপোরেশন আইন ২০১৯–এর ১৬ ধারা অনুযায়ী কোনো সরকারি সম্পত্তি অথবা সরকারি সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট কোনো ঝুঁকি বা দায় সম্পর্কিত সব ধরনের নন-লাইফ বীমা ব্যবসার ১০০ শতাংশই করে এসবিসি। সংস্থাটির অবলিখন করা এই ১০০ শতাংশের ৫০ শতাংশ নিজের কাছে রেখে বাকি ৫০ শতাংশ সব বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির মধ্যে সমহারে বণ্টন করে দেয়া হয়।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর সারাদেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশি বাধা ও হামলার মুখে তুমুল সহিংসতায় রূপ নেয় এ আন্দোলন।

এ ঘটনায় দেশজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও বুলেট নিক্ষেপসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদের হামলায় দুই শতাধিক ছাত্র-জনতা নিহতের খবর এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। আহত হয়েছেন আরো শত শত মানুষ।

হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়।

ক্ষতিগ্রস্ত এসব সরকারি সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে- মেট্রোরেলের স্টেশন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজা, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা, বিটিভি ভবন, সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মিরপুরের ইনডোর স্টেডিয়াম ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন।

এ ছাড়াও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়, নারায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ও সিটি করপোরেশনের নগর ভবন, নরসিংদী জেলা কারাগার, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানের পুলিশ ফাঁড়ি ও ট্রাফিক বক্স ক্ষতির শিকার হয়।

নজিরবিহীন এই হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিপুল পরিমাণ ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এসব ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেডের অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স বিভাগের ব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন (অবসরপ্রাপ্ত) হাসিব হাসান খান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী ও মহাখালী টোলপ্লাজা আগুনে পুড়ে আনুমানিক ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) রামপুরা ভবনে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৫০ কোটি টাকার সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজা আক্তার। রামপুরা থানায় দায়েরকৃত এ সংক্রান্ত একটি মামলায় তিনি ক্ষয়ক্ষতির এ তথ্য তুলে ধরেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কয়েকটি আঞ্চলিক কার্যালয়ের ৪৭টি গাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রায় ২০৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।

ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, গুলশানে ট্রাফিক উপ-কমিশনারের অফিসসহ এসি রমনা, রামপুরা, মহাখালী ও উত্তরা অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও পুরো ঢাকা শহরে অন্তত ৫৪টি ট্রাফিক পুলিশ বক্স পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

মহাখালীতে সেতু ভবনের সামনে থাকা ৫৫টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। আগুনে পুড়েছে সেতু ভবনের নিচতলায় থাকা বঙ্গবন্ধু কর্নার, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, মিলনায়তন, ডে-কেয়ার সেন্টার। লুট করা হয়েছে ভবনের মূল্যবান জিনিসপত্র। এ ঘটনায় সেতু ভবনের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে এ সংক্রান্ত একটি মামলায় দাবি করেছেন সেতু ভবনের কেয়ারটেকার রবিউল ইসলাম।

এ ছাড়াও মহাখালীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের সামনে এবং বেইজমেন্টে দেয়া আগুনে ৫৩টি গাড়ি ও ১৬টি মোটরসাইকেল সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। ভবনের বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, সার্ভার, ইমার্জেন্সি রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার, অফিসের যন্ত্রপাতিও নষ্ট হয়েছে।

মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনের টিকিট বিক্রির মেশিন, কম্পিউটার, প্রিন্টার, সময়সূচির মনিটর, ভেঙে ফেলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অ্যাকসেস কন্ট্রোল গেট। এ ঘটনায় রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় পাঁচটি মামলা করা হয়। এরমধ্যে ৪টি মামলার এজাহারে মেট্রোরেলের ক্ষয়-ক্ষতির মোট পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৩০০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

সাধারণ বীমা করপোরেশনের ঢাকা জোনাল অফিসের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মো. আবদুল মতিন এ বিষয়ে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, সরকারি সম্পদের যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির তথ্য আমরা গণমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি তাতে আশঙ্কা করা হচ্ছে বড় অঙ্কের বীমা দাবি উত্থাপন হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে তেমন কোন বীমা দাবি উত্থাপন হয়নি। এমনকি গ্রাহকদের পক্ষ থেকেও ক্ষয়ক্ষতির তেমন কোন তথ্য আমাদেরকে জানানো হয়নি।

তিনি আরো বলেন, ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানতে আমরা এরইমধ্যে সম্ভাব্য গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছি। আমাদের সবগুলো ব্রাঞ্চকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বীমা পলিসির গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ করতে। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোন খোলা রাখার পাশাপাশি অপরিচিত নম্বর থেকে আসা কলও রিসিভ করতে বলা হয়েছে, যাতে যেকোন গ্রাহক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানাতে পারে।

আবদুল মতিন বলেন, সাধারণ বীমা করপোরেশন, এলজিইডি এবং বাংলাদেশ বিমানের একটি করে মোট ৩টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে এসেছে। এ ছাড়াও কিছু গ্রাহকের সঙ্গে কথা হয়েছে যারা তাদের বীমা পলিসি বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি। অনেক অফিস এখনো ঠিকমতো চালু হয়নি বিধায় ক্ষয়ক্ষতির তথ্য আসতে বা ফরমাল বীমা দাবি উত্থাপন হতে আরো কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।