অপ্রয়োজনীয় নথিপত্র চাওয়ার অভিযোগ

এসবিসি থেকে পুনর্বীমা দাবি আদায়ে হয়রানি: অভিযোগ নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর

আবদুর রহমান আবির: পুনর্বীমা দাবি পরিশোধে অপ্রয়োজনীয় নথিপত্র চাচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি) । এতে ভোগান্তিতে পড়ছে বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো। তাদের অভিযোগ- এসবিসি এমন সব কাগজপত্র চাচ্ছে যার সাথে দাবির সঠিকতা যাচাইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।

অপরদিকে সাধারণ বীমা করপোরেশন বলছে- বীমা কোম্পানিগুলো প্রয়োজনীয় নথিপত্র না দেয়ায় পুনর্বীমা দাবি পরিশোধ করতে পারছে না। সম্প্রতি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর সাথে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এবং সাধারণ বীমা করপোরেশনের তৃপক্ষীয় মতবিনিময় সভায় এসব অভিযোগ উঠে এসেছে।

তবে পুনর্বীমা দাবি নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের একটি চেক লিস্ট তৈরিসহ পুনর্বীমা প্রিমিয়াম আদায় ও বীমা দাবি নিষ্পত্তির জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তপক্ষ (আইডিআরএ) । একইসঙ্গে বীমা কোম্পানিগুলোকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র করপোরেশনে দাখিল করতে বলা হয়েছে।

উল্লেখ, বীমা করেপারেশন আইন-২০১৯ অনুসারে পুনর্বীমাযোগ্য প্রিমিয়ামের ৫০ শতাংশ সাধারণ বীমা করপোরেশনের সাথে পুনর্বীমা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। 

বেসকারি নন-লাইফ বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ, সাধারণ বীমা করপোরেশনের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ পুনর্বীমা দাবির সঠিকতা যাচাইয়ে নতুন নতুন কাগজপত্র চাচ্ছে। এসব কাগজপতের সাথে বীমা দাবির সঠিকতা যাচাইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।

তাদের মতে, গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন, ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের সাথে বীমা দাবির সঠিকতা যাচাই বা ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ সাধারণ বীমা করপোরেশন এসব তথ্য চেয়ে বীমা কোম্পানিগুলোকে বিপাকে ফেলছে। তাদের মতে, পুনর্বীমার আবেদনের সাথে কি কি নথিপত্র দেয়া হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো চেকলিস্ট নেই।

নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো বলছে, গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহকের গুদামে কি পরিমাণ মালামাল ছিল তার সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য আর্থিক প্রতিবেদন বা ভ্যাট-ট্রাক্সের রিটার্নের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ এসব কাগজপত্র চাচ্ছে পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশন।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তপক্ষে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নিবাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান বলেন- সাধারণ বীমা করপোরেশন অনেক ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ করে বীমা দাবি নিষ্পত্তি না করে ফেরত প্রদান করছে। সাধারণ বীমা করপোরেশন যতক্ষণ পর্যন্ত না একসেপ্টেন্স দিচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ডেবিট নোটও পাঠাচ্ছেন না, ফলে কোম্পানি পুনর্বীমা প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে পারছে না।

সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান আরও বলেন বীমা দাবি নিষ্পত্তির আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে ফায়ার ব্রিগেড রিপোর্ট। বীমা দাবি নিষ্পত্তিতে ফায়ার ব্রিগেড রিপোর্ট বাধ্যতামূলক নয়। আগুন লাগার প্রমাণক হিসেবে কোম্পানিগুলো ফায়ার ব্রিগেড রিপোর্ট সংরক্ষণ করে থাকে। তিনি ফায়ার ব্রিগেড রিপোর্টের দরকার নেই বলে সভায় বক্তব্য প্রদান করেন। এছাড়াও, সাধারণ বীমা করপোরেশন নতুন নতুন বাড়তি অনেক কাগজপত্র চান যা প্রকারান্তরে অপ্রয়োজনীয় ও সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায় বলে তিনি দাবি করেন।

পুনর্বীমা দাবি নিষ্পত্তিতে সাধারণ বীমা করপোরেশনের বোর্ডের অতিরিক্ত দলিল-দস্তাবেজ এর চাহিদাকে দায়ি করেন এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমাম শাহীন।

তিনি বলেন, সাধারণ বীমা করপোরেশন যেসব কাগজপত্রের চাহিদা প্রদান করে তার সাথে বীমা দাবি নিষ্পত্তি সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ বিদেশি পুনর্বীমাকারীরা, যাদের সাথে সাধারণ বীমা করপোরেশনেও পুনর্বীমা করে থাকে, তারা শুধু সার্ভে রিপোর্ট ও লস ইন্টিমেটেডের ভিত্তিতে পুনর্বীমা দাবির অর্থ পরিশোধ করে থাকে।

পুনর্বীমা দাবি নিষ্পত্তিতে বাড়তি ও অপ্রয়োজনীয় তথ্যাদি চাওয়ায় কারণে দাবি নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে, যা বীমা আইনের সাথে সাংঘার্ষিক বলে মনে করেন ইমাম শাহীন।

গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ ফরহাদ আব্বাস হোসেন বলেন- বীমা কোম্পানিগুলো যেভাবে বীমা দাবি নিষ্পত্তি করছে সেটার লস এডজাস্টমেন্ট রিপোর্টটিকেই সাধারণ বীমা করপোরেশন প্রমাণক হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। ফায়ার ব্রিগেড ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে কিনা সেটার একটা ফিজিক্যাল এভিডেন্স নিয়ে সেটাকেই সাধারণ বীমা করপোরেশন গ্রহণ করতে পারে। ফায়ার ব্রিগেড রিপোর্ট সংগ্রহ করা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। তিনি পুনর্বীমা দাবি পরিশোধ সহজ করার দাবি করেন সভায়।

মতবিনিময় সভায় সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুন অর রশিদ বলেন- ফার্স্ট ইন্টিমেটেড সার্ভে রিপোর্টে বীমা দাবির পরিমাণ অনেক বেশি হয়। তিনি বলেন, বছরের পর বছর বীমা দাবি বকেয়া থাকার কারণ হচ্ছে- বীমা দাবি নিষ্পত্তির জন্য কোম্পানিগুলোর কাংখিত সহযোগিতার অভাব। তারা সঠিকভাবে নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজনীয় দলিলাদি দাখিল করতে পারছে না।

এক্ষেত্রে সার্ভে রিপোর্ট না পাওয়া আরেকটি বড় কারণ উল্লেখ করেন তিনি বলেন, সার্ভে রিপোর্ট দাখিল করার জন্য কোম্পানিগুলোকে বারবার তাগাদা দিতে হয়। এছাড়া বীমাকারী প্রতিষ্ঠান পুনর্বীমা প্রিমিয়াম সঠিক সময়ে পরিশোধ না করলে সাধারণ বীমা করপোরেশনের পক্ষে বীমা দাবি পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। এসব কারণে বীমা দাবি নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয় বলে তিনি সভাকে অবহিত করেন।

তবে হারুন অর রশিদ সভাকে অবহিত করেন, পুনর্বীমা সংক্রান্ত বীমা দাবি নিষ্পত্তি সহজীকরণের জন্য সাধারণ বীমা করপোরেশনে একটি গাইডলাইন চূড়ান্ত করার কাজ চলামন রয়েছে যা সেপ্টেম্বর ২০২৪ এর মধ্যে সম্পন্ন হবে মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন- মানুষ বীমা করছে ঝুঁকি নিরসনের জন্য। সে ঝুঁকি নিরসন হবে যদি বীমা দাবি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে নিষ্পত্তি করা যায়। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেকটা বীমা দিবসে বীমা দাবি নিষ্পত্তির উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, বীমা দাবি নিষ্পত্তিতে ফায়ার ব্রিগেড রিপোর্ট শুধুমাত্র অগ্নি দুর্ঘটনার প্রমাণক হিসেবে প্রয়োজন, ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতি নির্ধারণের জন্য ফায়ার ব্রিগেড রিপোর্টের প্রয়োজন হতে পারে। তবে ফায়ার ব্রিগেড রিপোর্টের জন্য বীমা দাবি বছরের পর বছর ঝুলে থাকবে সেটা কাংখিত নয়।

আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, বীমা দাবি নিষ্পত্তিতে বীমা গ্রহীতার অপ্রয়োজনীয় দলিল দস্তাবেজ ও বাড়তি কাগজপত্র চেয়ে বীমা দাবি নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ানো বীমা খাতের জন্য মঙ্গলজনক নয়। বীমা দাবি নিষ্পত্তিতে দাখিলকৃত দলিলাদি ভুল কিংবা সত্য প্রমাণিত না হলে সাধারণ বীমা করপোরেশন বীমা দাবি খারিজ করার এখতিয়ার রাখে। তবে এটা একটা আইন, বিধি অনুসরণ করে হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আন্তজার্তিক নিয়ম-কানুন অনুসরণ করা উচিত।

তিনি সার্ভে রিপোর্টের ক্ষেত্রে ভালো মানের সার্ভেয়ার নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ দেন। এজন্য পুনর্বীমা সংক্রান্ত বীমা দাবি নিষ্পত্তির জন্য সাধারণ বীমা করপোরেশনকে একটি নীতিমালা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিলের চেকলিস্ট তৈরির পরামর্শ দেন।

উল্লেখ্য, সাধারণ বীমা করপোরেশনের ২০০৮ সালের চেকলিস্ট অনুসারে অগ্নি পুনর্বীমা দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোকে ১৩ ধরণের কাগজপত্র দাখিল করতে হতো। জরিপকারির দাখিল করা জরিপ প্রতিবেদনের প্রাসঙ্গিক যাবতীয় তথ্য ছাড়াও এই ১৩ ধরণের কাগজপত্র সন্নিবেশ করতে হতো। এসব কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে-

ক্ষতি অবহিতকরণের পত্র, পলিসি কপি, ফায়ার ব্রিগেড রিপোর্ট, জিডি এট্রি/ এফআইআর এর কপি, ব্যাংক কর্তৃক প্রত্যয়নকৃত স্টক রিপোর্ট (ব্যাংক লোন থাকলে), মেশিনারি/ আমদানিকৃত মালামালের এলসি/ ইনভয়েস, প্রিমিয়াম রশিদ ও ব্যাংক ডিপোজিট স্লিপ এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট, চেয়ারম্যান/ ওয়ার্ড কমিশনার/ আবহাওয়া পরিদপ্তর কর্তৃক ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট (বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে), বৈদ্যতিক সংযোগ বৈধ ছিল কিনা সে সম্পর্কিত দলিলাদি, নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈধ অনুমতি পত্র, বৈদ্যতিক সর্ট সার্কিট নিরসনের যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছিল কিনা সে সম্পর্কিত কাগজপত্র, ফায়ার লাইসেন্স এবং আনুষঙ্গিক দলিলাদি (প্রয়োজন বোধে)।