চেয়ারম্যানের নির্দেশ না মানায় হোমল্যান্ডের ২ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি
নিজস্ব প্রতিবেদক: গ্রাহকদের পাওনা টাকা দেয়ার নাম নেই। পাওনা টাকা না পেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে শত শত গ্রাহক। কমে গেছে প্রিমিয়াম আয়। বেতন-ভাতা পরিশোধে খরচ করা হচ্ছে গ্রাহকের জমাকৃত টাকার বিনিয়োগ আয় থেকে। ফলে তহবিল কমছে প্রতিদিনই। অন্যদিকে আত্মসাৎ করা ১০৪ কোটি টাকা উদ্ধারেও নেই কোনো উদ্যোগ। আবার শেয়ার সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন লন্ডন প্রবাসী ৫ জন।
এরমধ্যেই আবারো হুট করেই কোম্পানির চেয়াম্যান জামাল উদ্দিন একক সিদ্ধান্তে কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অব্যাহতি দিয়ে নতুন একজন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিয়েছেন। এতে নতুন করে হোমল্যান্ড লাইফের আবারো জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা আরো বাড়ছে।
এদিকে দুই কর্মকর্তার অব্যাহতি নিয়ে আজ মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলন করেছেন হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, নির্দেশনা না মানায় ওই দুই কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
এসময় তিনি বলেন, কোম্পানির স্বার্থে ওদের টার্মিনেট করেছি। যতদিন তারা ছিল- কোম্পানির যে ব্যবসা-বাণিজ্যের টার্গেট দেয়া ছিল, তারা তা পূরণ করতে পারেনি। বর্তমানে আমাদের ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের অনেক গ্রাহক আছে তাদের টাকা দিতে পারছি না।
হোমল্যান্ড লাইফ সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানির চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন কোম্পানির উর্ধ্বতন ওই ২ কর্মকর্তাকে বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছাড়াই একক সিদ্ধান্তে অব্যাহতি দেন। অপরদিকে জামাল উদ্দিনের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত জাকির হোসেন সরকারকে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হেড অব মার্কেটিং পদে নিয়োগ দেয়া হয়। জাকির হোসেন কোম্পানিটির প্রায় এক কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের ২টি মামলার আসামি। এছাড়া কোম্পানির ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায়ও তিনি অভিযুক্ত।
কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার পাশাপাশি শেয়ার সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে পরিচালনা পর্ষদে থাকতে জামাল উদ্দিন উর্ধ্বতন ২ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দিয়ে তার নিজম্ব কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। এর আগে শেয়ার সার্টিফিকেট জাল করে পরিচালনা পর্ষদে থাকার প্রবাসী ৫ পরিচালক সিলেটে বোর্ড সভা করতে চাইলে এক রীট মামলায় উচ্চ আদালত তা স্থগিত করেন।
সূত্র মতে, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি হোমল্যান্ড লাইফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আব্দুল মতিনকে অব্যাহতি দেন বীমা কোম্পানিটির চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন। আব্দুল মতিনের সাথে কোম্পানির অপর কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার আলোকে অব্যাহতি দেয়া হয় ওই দিনই।
অভিযোগ রয়েছে, আইনী খরচের নামে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান টাকা চাইলে তা না দেয়ায় ওই দুই কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
গত ৯ সেপ্টেম্বর কোম্পানির ১৪৯তম সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে আব্দুল মতিনকে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে তাকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়ে বোর্ড সভার কোনো সিদ্ধান্তের কথা অব্যাহতিপত্রে উল্লেখ করা হয় নাই। কোম্পানির বৃহত্তর স্বার্থে আব্দুল মতিনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে অব্যাহতিপত্রে উল্লেখ করা হয়। চিঠি ইস্যুর দিন থেকেই অব্যাহতি কার্যকর করা হয়।
এর বাইরে অনিয়ম বা দুর্নীতির জন্য তাকে যেমন অভিযুক্ত করা হয় নাই তেমনি কোম্পানির সাথে তার দেনা পাওনার বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা হবে তাও উল্লেখ করা হয় নাই। তবে ব্যবসার পারফরমেন্স সন্তোষজনক না হওয়া ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝে বিশৃংখলার অভিযোগ আনা হয় অপর কর্মকর্তা লুৎফুন নাহারের অব্যাহতিপত্রে।
এদিকে হোমল্যান্ড লাইফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হেড অব মার্কেটিং পদে নিয়োগ দেয়া জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে মো. আবু ইউসুফ ও মো. ইরফানুল হক নামে বীমা কোম্পানিটির ২ কর্মকর্তা। তারা জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে বিশৃংখলা সৃষ্টির অভিযোগ করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
মতিঝিল থানায় জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১৮(১)১১ নং মামলাটি উচ্চ আদালতে আদেশের অপেক্ষায় আছে। এই মামলায় তার বিরুদ্ধে হোমল্যান্ড লাইফের ৮৫ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। আর কোতয়ালী থানার ০১(০১)১১ নং মামলায় জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে কোম্পানির ৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
অপরদিকে কোম্পানি থেকে অব্যাহতি দেয়া মোহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম জোড় করে ৮ কোটি টাকার স্বাক্ষরিত চেক বই নিয়ে গিয়েছে -এই অভিযোগ এনে থানায় জিডি করেছেন হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ৪ কর্মকর্তা। আতাউর রহমান খান, মামুন তালুকদার, শিউলী আক্তার ও নুরুল আলম মিয়াজী নামের ওই ৪ কর্মকর্তা গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মতিঝিল থানায় এই সাধারণ ডায়েরি করেন।
হোমল্যান্ড লাইফে ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আত্মসাৎ হয় ১০৪ কোটি টাকা। আর এই লুটপাটে জড়িত ছিলেন স্বয়ং কোম্পানির মালিকরাই। এ কারণে সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি থাকার পরও এখন পর্যন্ত আত্মসাতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি আত্মসাতকৃত টাকা কোম্পানির ফান্ডে ফেরত আনারও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
উল্টো গ্রাহকদের জমাকৃত ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ও ৫ পরিচালকের শেয়ার সার্টিফিকেট জালিয়াতির কেলেঙ্কারী ধামাচাপা দিতে সিলেটে বোর্ডসভাসহ অন্যান্য সভা করার পাঁয়তারা এবং ঘনিষ্ঠ লোকজনকে কোম্পানির শীর্ষ পদগুলোতে বসাতে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে এসব অনিয়মের ঘটনা তদন্তে সহায়তাকারী কর্মকর্তাদের।
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে ২০২৩ সালে হোমল্যান্ড লাইফের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ।তবে এই তদন্তে বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ তুলেছেন দুদক কর্মকর্তারা। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’কে পাঠানো দুদকের একটি চিঠিতে এই অভিযোগ করা হয়।
বীমা দাবি পরিশোধ না করায় প্রতিনিয়তই হয়রানি, ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের গ্রাহক, মাঠ কর্মীরা। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও গ্রাহকরা পাচ্ছে না মেয়াদ শেষে বীমা দাবির টাকা। এমন গ্রাহক ভোগান্তির কারণেই কোম্পানিটির নতুন প্রিমিয়াম আয় কমে আসছে দ্রুত। ফলে নিয়মিত ব্যয় মেটাতেও এখন ভাঙতে হচ্ছে কোম্পানিটির তহবিল।
এদিকে দুই কর্মকর্তার অব্যাহতি ও নতুন এক কর্মকর্তার নিয়োগকে কেন্দ্র করে আজ মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলন করেন হোমল্যান্ড লাইফের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তার দাবি, বোর্ডের অনুমোদন অনুসারে তিনি কাউকে নিয়োগ দিতে পারেন এবং অব্যাহতি দিতে পারেন।
সংবাদ সম্মেলনে জামাল উদ্দিন আরো বলেন, আমি বিদেশে থাকি। আমি যেটা বলি সেটা হচ্ছে না। আমার নির্দেশ মান্য হচ্ছে না। তাই আমি তাদের টার্মিনেট করেছি। তবে এই ২ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেয়ার ক্ষেত্রে বোর্ডসভার লিখিত কোন অনুমোদন নেই বলেও জানান তিনি।
অর্থ-আত্মসাতের মামলার আসামিকে ডিএমডি ও হেড অব মার্কেটিং পদে নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে জামাল উদ্দিন বলেন, তার বিরুদ্ধে মামলা আছে- এ কথা আমি জানি না। তবে তাকে নিয়োগ দেয়ার সময় ৪ জন পরিচালক ছিলেন যাদের মতামত নিয়েই তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।