বাংলাদেশ ন্যাশনালের ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি: আয়কর গোয়েন্দাকে তদন্তের সুপারিশ
নিজস্ব প্রতিবেদক: বীমার প্রিমিয়াম ও অন্যান্য খাতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ভ্যাট ও আয়কর ফাঁকির বিষয়ে তদন্তের জন্য আয়কর গোয়েন্দা কমিশনারকে নির্দেশনা প্রদানের সুপারিশ করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। গত ২৭ মার্চ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে পাঠানো এক চিঠিতে এই সুপারিশ করা হয়েছে।
একইসঙ্গে বীমা কোম্পানিটির ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকির বিষয়টি নিয়ে মূসক নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকে অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।
কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকির বিষয়টি নিয়ে ব্যাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে মূসক নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকে অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং সম্ভাব্য রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি স্থানীয় ভ্যাট সংশ্লিষ্ট। তাই এই দপ্তর থেকে আপাতত আর কোন কার্যক্রম গ্রহণ সমীচীন হবে না।
অপরদিকে আন্ডার-ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২১ বছরে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের মালিক প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের প্রায় ৭৯ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ তদন্তের জন্য কাস্টম হাউস চট্টগ্রাম এবং কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের মতামত নেয়ার সুপারিশ করে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
এ ছাড়াও মেঘনা গ্রুপের আমদানিকৃত পণ্যের শুল্কায়নকৃত মূল্যের সঠিকতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে আন্ডার-ইনভয়েসিং এর অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনের আওতায় ব্যবস্থা গ্রহণসহ এনবিআর’র অভিযোগে বর্ণিত অন্যান্য বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করা যায় বলে জানিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকে পাঠানো এক চিঠিতে ভূয়া বা জাল ইন্স্যুরেন্স কাভারনোট ইস্যুর মাধ্যমে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল কর্তৃক বীমা কোম্পানিটির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ খতিয়ে দেখার নির্দেশনা দেয়া হয়। ওই অভিযোগের প্রাথমিক পর্যালোচনা করে এসব সুপারিশ করে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের চিঠিতে অভিযোগের মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলা হয়, কাস্টম হাউসে শুল্কায়নকৃত (চড়াওকৃত) মূল্যের ভিত্তিতে বীমা পলিসি নেয়া হলে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অনেক বেশি প্রিমিয়াম আয় হতে পারতো। আর বেশি প্রিমিয়াম পেলে এর বিপরীতে বেশি পরিমাণ ভ্যাট সরকারের প্রাপ্য হতো।
এ ছাড়াও শুল্কায়নকৃত মূল্যের ভিত্তিতে এলসি খোলা হলে এর ব্যাংকের কমিশন/ চার্জ বেশি হতো যার বিপরীতে সরকার বেশি ভ্যাট পেতো। একইভাবে শুল্কায়নকৃত মূল্য বিবেচনায় নেয়া হলে স্ট্যাম্প ডিউটি ও সংশ্লিষ্ট ভ্যাটসহ অন্যান্য খাতেও রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে মর্মে অভিযোগে বলা হয়েছে।
এর আগে ২০২৪ সালের জুন মাসে এ সংক্রান্ত অভিযোগটি খতিয়ে দেখতে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেয়। চিঠিতে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ৫টি খাতে তদন্তের সুপারিশ করে সংস্থাটি। গোয়েন্দা সংস্থার ওই চিঠিতে বলা হয়, গত ২০ বছরের ৫টি খাতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের সম্ভাব্য আত্মসাতের পরিমাণ ১৫১৮ কোটি টাকা।
সংস্থাটি যে ৫টি বিষয়ে তদন্তের সুপারিশ করে সেগুলো হলো- মেঘনা গ্রুপের ৭০টি কোম্পানির বিপরীতে বছর ভিত্তিক ও শ্রেণী ভিত্তিক দাবিকৃত ও পরিশোধিত দাবির পরিমাণ যাচাই, ইস্যুকৃত কভার নোট পলিসির সংখ্যা এবং প্রিমিয়াম এবং আদায়কৃত প্রিমিয়ামের পরিমাণ, পলিসি ইস্যু করার পর কি পরিমাণ পলিসি ও প্রিমিয়াম বাতিল করা হয়েছে তার পরিমাণ, ৭০টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে কি পরিমাণ টাকা বীমা দাবি বাবদ পুনর্বীমা কোম্পানি সাধারণ বীমা করপোরেশন ও বিদেশী পুনর্বীমা কোম্পানি থেকে আদায় করা হয়েছে তার পরিমাণ ও বীমা দাবির পরিশোধের ব্যাংক হিসাব।
উল্লেখ্য, মেঘনা গ্রুপের ৭০টি প্রতিষ্ঠানের বীমা করতে ১৩৭২ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি এবং অর্থ আত্মসাৎ করেছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স। -এমন অভিযোগ করেন বীমা কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক এম এফ কামাল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বরাবর দফায় দফায় তিনি এই অভিযোগ করেন।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের অভিযোগে এমএফ কামাল দাবি করেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স রাজস্ব ফাঁকি এবং অর্থ আত্মসাৎ করেছে ১৩৭২ কোটি টাকা। প্রিমিয়ামে টাকা ও আমদানি মূল্য কম দেখিয়ে কোম্পানিটি এই বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছে। এর আগে ২০১৪ সালের অভিযোগে তিনি দাবি করেছিলেন কোম্পানিটির রাজস্ব ফাঁকি ও আত্মসাতের পরিমাণ ৪৭২ কোটি টাকা।
এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে তদন্ত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে এনবিআর ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে ২৫ মার্চ ২০১৯ সালে। অপরদিকে আইডিআরএ কমিটি গঠন করে ১২ জানুয়ারি ২০২১ সালে।