আইডিআরএ’র নির্দেশ অমান্য

২০১৮ কে ২০১৭ বানিয়ে ব্যবসা দেখাচ্ছে লাইফ বীমাকারীরা

মোস্তাফিজুর রহমান টুংকু: ২০১৮ সালে করা পলিসিকে ২০১৭ সালের দেখিয়ে ব্যবসা সমাপনী নিয়ে অভিনব প্রতারণা করছে লাইফ বীমা খাতের কোম্পানিগুলো। পুরো জানুয়ারি মাস ধরে বিক্রি করা পলিসিতে প্রস্তাবপত্র, প্রিমিয়াম জমার তারিখ, বীমা শুরু (কমেন্সমেন্ট) এমনকি ঝুঁকির তারিখ ২৮ ডিসেম্বর দেখিয়ে পলিসি করা হচ্ছে। এভাবে পলিসি করার জন্য লাইফ খাতের কোম্পানিগুলো তারিখও নির্ধারণ করে দিয়েছে। রাজধানীর আশপাশের এলাকায় লাইফ বীমা কোম্পানির শাখা অফিসগুলো ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

টাকা জমার আগেই গ্রাহকের ঝুঁকি নিচ্ছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ।  কোম্পানিটি জানুয়ারির বিভিন্ন তারিখে প্রিমিয়াম জমা দেখালেও প্রস্তাবপত্র এবং বীমা শুরুর (কমেন্সমেন্ট) ও ঝুঁকি গ্রহণ দেখাচ্ছে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর। কোম্পানিটি আরো এক সপ্তাহ অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত এ কৌশলে পলিসি ইস্যু করবে।

এক্ষেত্রে ডেল্টা লাইফ, ন্যাশনাল লাইফ এবং প্রগ্রেসিভ লাইফ বীমা প্রস্তাব, প্রিমিয়াম জমা, বীমা শুরু এবং ঝুঁকি গ্রহণের তারিখ দেখাচ্ছে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর। ডেল্টা লাইফ ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত, প্রগ্রেসিভ লাইফে এ কর্মকাণ্ড চলবে পুরো মার্চ মাস এবং ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স পুরো ফ্রেব্রুয়ারি মাসে যত পলিসি হবে তা ২০১৭ সালের পলিসি হিসেবে প্রদর্শন করবে।

পদ্মা ইসলামী লাইফ এ ক্ষেত্রে আরেকটু চতুরতার আশ্রয় নিয়েছে। বীমা প্রস্তাব, প্রিমিয়াম জমা, বীমা শুরুর তারিখ গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর দেখালেও ঝুঁকি গ্রহণের তারিখ হবে যেদিন ফার্স্ট প্রিমিয়াম রিসিট (এফপিআর) ইস্যু করা হবে সেই তারিখ। পদ্মা ইসললামী লাইফ এভাবে পলিসি করবে ফেব্রয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত।

ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স জানুয়ারি ২০১৮ সালে করা সকল পলিসিতে প্রিমিয়াম জমা, প্রিমিয়াম জমার পাকা রশিদ, বীমা শুরুর তারিখ, ঝুঁকি গ্রহণের তারিখ দিচ্ছে ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭। একই তারিখেই পলিসি ইস্যু দেখাচ্ছে ন্যাশনাল লাইফ ও প্রগ্রেসিভ লাইফ। প্রাইম ইসলামী লাইফ প্রিমিয়াম জমার তারিখ দিচ্ছে জানুয়ারি, কিন্তু বীমা শুরু, ঝুঁকি গ্রহণ সবই ২৮ ডিসেম্বর।

রাজধানীর আশপাশের কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন অফিস সরজমিন ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যবসা সমাপনের নির্দেশ থাকলেও কোম্পানিগুলো এখনো ২০১৭ সালে ব্যবসা করে যাচ্ছে। অথচ ব্যবসা সমাপনীর প্রতিবেদন কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই আইডিআরএ দাখিল করেছে। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে আইডিআরএ’র কাছে কোম্পানিগুলো কোন হিসাব দাখিল করেছে।

অন্যদিকে, এসব পলিসির কোন মৃত্যুদাবি উঠলে গোজামিলের তারিখ থাকায় পলিসিটি ভূয়া আখ্যায়িত করে নাকচ করে দেয়ার সুযোগ নেয়া যাবে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।

গত ১৯ ডিসেম্বর জীবন বীমা কোম্পানিগুলোকে নির্ধারিত ছকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত বীমা ব্যবসার হিসাব দাখিলের নির্দেশ দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ।

একই সঙ্গে ২০১৭ সালে প্রদর্শিত ১ম বর্ষ ব্যবসার বিপরীতে ব্যাংক জমা অবশ্যই ১ জানুয়ারির মধ্যে হতে হবে। এরপরে জমা করা প্রিমিয়াম ২০১৮ সালের ব্যবসা হিসেবে গণ্য হবে, জানিয়ে দেয় আইডিআরএ।

প্রাইম ইসলামী লাইফের একজন ব্রাঞ্চ ইনচার্জ জানান, জানুয়ারি মাসের সব পলিসি আমরা ২৮ ডিসেম্বর তারিখ দিয়ে করছি।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে লিখিত কোন নির্দেশ নেই। তবে বড় স্যারদের মৌখিক নির্দেশেই এসব পলিসি করা হচ্ছে।

প্রাইম ইসলামী লাইফের ওই শাখায় জানুয়ারি মাসে যত পলিসি করা হয়েছে সব পলিসির জমা রশিদেই জানুয়ারি দেখানো হলেও বীমা শুরুর তারিখ ও ঝুঁকি  দেখানো হচ্ছে ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ।

পিছনের তারিখ দিয়ে কেন পলিসি করেন? এতে লাভ কি? এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের বড় স্যাররা বলেন, পলিসিটি ব্যাগ ডেটে করলে গ্রাহক লাভবান হন। এর কারণ গ্রাহক জানুয়ারি মাসে পলিসি করে আগের বছরের ঘোষণাকৃত বোনাস পাবেন। আর পলিসিটি এক মাস এগিয়ে থাকল।

এ ধরণের কর্মকাণ্ড যে অবৈধ তাও তিনি অবলিলায় স্বীকার করে নিলেন। তিনি বলেন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে হিসাব শেষ করতে হবে এটা আইডিআরএ’র নির্দেশ। তবে তিনি বলেন, বড় স্যারদের নির্দেশ আমাদের কি করার আছে। আমরা তো চাকরি করি মাত্র। বড় স্যার বসেন গাউছে পাকের অফিসে।

তিনি বলেন, গত তিন চার বছর ধরে শুনে আসছি। তবে আমাদের এখানে এভাবে কেউ জানতে আসেনি। আইডিআরএ’র পক্ষ থেকেও কেউ আসেনি। তবে বিভিন্ন মিটিংএ বড় স্যারদের বক্তব্যে শুনেছি ৩১ তারিখের বিষয়ে অবশ্যই হিসাব দাখিল করতে হবে। এ বিষয়ে আইডিআরএ খুব কড়াকড়ি করছে।

প্রাইম ইসলামী লাইফের ওই শাখা থেকে বিদায় নিয়ে আমরা পাশেই ফারইস্ট ইসলামী লাইফের অফিসে। সেখানে তিনটি ফার্স্ট প্রিমিয়াম রশিদে প্রিমিয়াম জমারা তারিখ দেয়া ১৮ জানুয়ারি। কিন্তু এফপিআর রশিদ কাটা হয়েছে ২৮ জানুয়ারি এবং বীমা শুরু তারিখ ও ঝুঁকি গ্রহণের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর।

ডেল্টা লাইফের একটি শাখা অফিসের প্রধান জানালেন আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। তিনি জানান, জানুয়ারি মাসে কোনো পলিসি ইস্যু করা হয়নি। গতকাল অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত যত পলিসি করা হয়েছে সবই ২৮ ডিসেম্বরের তারিখ দিয়ে। প্রিমিয়াম জমার রশিদেও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা স্বাক্ষর করছেন ২৮ ডিসেম্বরের তারিখে।

ব্যাংকে জমার সাথে কীভাবে মিল রাখেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোম্পানি থেকে আমাদের ব্রাঞ্চে এক কোটি টাকার ফাণ্ড দেয়া আছে। অর্থাৎ ব্রাঞ্চের ব্যাংক হিসাবে আগে থেকেই এক কোটি টাকা জমা রাখা হয়েছে। সেখান থেকেই প্রিমিয়াম জমার হিসাব দেখানো হয়। কতদিন থেকে এমনটা চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদিবা রহমান কোম্পানির মূখ্য নির্বাহীর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই ব্যাগ ডেটে পলিসি করানো হচ্ছে। আগে এটা ছিল না।

বীমা আইনে অবৈধ কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই অবৈধ। কিন্তু আমাদের তো কোম্পানির নির্দেশ মানতে হয়। যেহেতু আমরা চাকরি করি।