ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হলে প্রিমিয়াম সংগ্রহ হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা
আবদুর রহমান: ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হলে বীমাখাতে প্রিমিয়াম সংগ্রহ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে আগামী ৩ বছরেই। এমনটাই মনে করছেন দেশের বীমা বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, প্রিমিয়াম সংগ্রহের এই পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে ১০ গুণ বাড়তে পারে। একইসঙ্গে কমে আসবে ব্যবস্থাপনা ব্যয়। বাড়বে গ্রাহকের আস্থা। বাড়তি আয়ের সুযোগ পাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাড়বে সরকারের রাজস্বও। বীমা বিশ্লেষক ও ব্যাংক্যান্স্যুরেন্সের নানা তথ্য পর্যালোচনা করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত সারাদেশে মোট ব্যাংক শাখার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৪৩টি। এ সময়ে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে ৮ কোটি ৯৭ লাখ ৭৭ হাজার ৭১৩টি। এর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের হিসাব ৩ কোটি ৮৮ লাখ ২ হাজার ৬৯৭টি। বিশেষায়িত ব্যাংকের হিসাব ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৭৭৩টি। বেসরকারি ব্যাংকের হিসাবের সংখ্যা হলো ৪ কোটি ২ লাখ ৮৭ হাজার ১৪৭টি। বিদেশি ব্যাংকের হিসাব ৪ লাখ ৯ হাজার ৯৬টি।
প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জালালুল আজিম ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে বলেন, বাংলাদেশে ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হলে এবং সবগুলো ব্যাংক এর আওতায় আনা গেলে আগামী ২/৩ বছরের মধ্যে প্রিমিয়াম আয় ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, বর্তমানে যা সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকায় আটকে আছে। সার্বিকভাবে ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হলে প্রিমিয়াম আয়ের এ পরিমাণ ১০ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
১৯৮০ সালের দিকে ফ্রান্স ও স্পেনে প্রথম ব্যাংকাস্যুরেন্স’র ধারণার উদ্ভব হয়। ব্যাংকাস্যুরেন্স একটি ফরাসি শব্দ, যার অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে বীমা পণ্য বিক্রি। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে ব্যাংকের মাধ্যমে বীমা পণ্য বিক্রি একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এশিয়ার দেশগুলোতেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ব্যাংকাস্যুরেন্স। বিশেষ করে লাইফ বীমা পলিসি বিক্রিতে এটি শীর্ষ মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। প্রায় ১৫ বছর আগে এশিয়ার বাজারে প্রবেশ করে ব্যাংকাস্যুরেন্স। তবে এখনো এর অগ্রগতির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
ব্যাংকাস্যুরেন্স পদ্ধতিতে একটি কার্যকর বিকল্প চ্যানেল হিসেবে কাজ করে ব্যাংক। এতে বীমা কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম সংগ্রহে খরচ কম হয়।অন্যদিকে অতিরিক্ত কোন খরচ ছাড়াই ব্যাংক তার গ্রাহকদের বীমার বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিতে পারে। তাছাড়া ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বেশি থাকায় গ্রাহকদেরও বীমা পলিসি কেনার প্রতি আকর্ষণ সুষ্টি হয়।
ভারতের বীমাখাত নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইআরডিএআই’র মতে, বীমা পণ্য বিক্রির জন্য বীমা কোম্পানিগুলোর করপোরেট এজেন্ট হিসেবে কাজ করে ব্যাংক। এক্ষেত্রে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি একটি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পলিসি বিক্রি করে। এই ব্যবস্থায় ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির পাশাপাশি গ্রাহকও লাভবান হয়।
ব্যাংকাস্যুরেন্সে পদ্ধতিতে পলিসি বিক্রির ৩টি মডেল রয়েছে। সেগুলো হলো- স্ট্রাটেজিক অ্যালাইয়ান্স মডেল, ফুল ইন্টিগ্রেশন মডেল ও মিক্সড মডেল। স্ট্রাটেজিক অ্যালাইয়ান্স মডেল তথা কৌশলগত জোট মডেলের অধীনে ব্যাংক শুধুমাত্র বীমা কোম্পানীর পণ্য বিপণন করবে এবং এখানে কোন ঝুঁকির অংশগ্রহণ নেই।
ফুল ইন্টিগ্রেশন মডেল তথা সম্পূর্ণ অঙ্গীভূতকরণ মডেল অনুযায়ী, ব্যাংক তার নিজস্ব ব্র্যান্ড নামের অধীনে বীমা পণ্য বিক্রি করে। এক্ষেত্রে ব্যাংক তার গ্রাহককের আর্থিক সুবিধা, চাহিদা ও পছন্দ অনুসারে পলিসির ডিজাইন করতে পারে। তবে এ পদ্ধতিতে ব্যাংক উৎপাদকের চেয়ে বীমা পরিবেশক হিসেবে বেশি উপার্জন করতে পারে।
মিশ্র ব্যাংকাস্যুরেন্স মডেল অনুসারে, বীমা কোম্পানির কাছে ব্যাংক তার ডাটাবেস (উপাত্ত-ভাণ্ডার) বিক্রি করে এবং বীমা কোম্পানি নিজেই পণ্য বিপণন করে। এই মডেলে বিতরণ ব্যবস্থার ওপর বীমা কোম্পানির সামান্যই নিয়ন্ত্রণ থাকে।
ব্যাংকাস্যুরেন্সের মাধ্যমে ব্যাংকের নন-ইন্টারেস্ট ইনকাম তথা আমানত ও লেনদেনের ফি, অপর্যাপ্ত তহবিল (এনএসএফ) ফি, বার্ষিক ফি, মাসিক অ্যাকাউন্ট সার্ভিস চার্জ, নিষ্ক্রিয়তা ফি, চেক এবং আমানতপত্র ফিসহ প্রাথমিকভ বিভিন্ন ধরণের ফি প্রাপ্ত হয়। এসবের জন্য ব্যাংকের নতুন কোন বিনিয়োগ ও ঝুঁকি গ্রহণের প্রয়োজন হয় না।
ব্যাংকাস্যুরেন্স মডেল ব্যবহারে বীমা কোম্পানির ব্যবসার নতুন উৎস সৃষ্টি হয়। অত্যাধুনিক এই বিক্রয় প্রক্রিয়া ব্যবহারে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা খরচ কমে আসে। বীমা কোম্পানি অপেক্ষাকৃত কম খরচে ব্যাংকের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বৃহত্তর ভৌগলিক অঞ্চল আওতায় পায়। অর্থাৎ গ্রামীণ বাজারে প্রবেশ করতে সহজ হয়। ব্যাংকের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গ্রাহকের মানসিক বিশ্বাসযোগ্যতা পেতে পারে বীমা কোম্পানি। ব্যাংকাস্যুরেন্সের মাধ্যমে বীমা কোম্পানি সহজেই নবায়ন প্রিমিয়াম পেতে পারে এবং ল্যাপস বা তামাদির ঘটনার সুযোগ কমে আসে।
দ্যা ফাউন্ডেশন ফর দ্যা অ্যাডভান্সমেন্ট অব লাইফ অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স এরাউন্ড দ্যা ওয়াল্ড (এফএএলআইএ) নামে একটি জাপানি প্রতিষ্ঠানের ২০১৬ সালের জারিপে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ব্যাংকাস্যুরেন্স মার্কেটের চিত্র উঠে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, জরিপে অন্তর্ভূক্ত ১৩টি দেশের মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি পলিসি বিক্রি হয় তুরস্কে। এরপরেই রয়েছে তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া। তবে সবচেয়ে কম বিক্রি হয় ভিয়েতনামে, দেশটিতে এজেন্টের মাধ্যমেই বেশি পলিসি বিক্রি হয়।
জরিপ অনুসারে, তুরস্কের ৭৯.৯ শতাংশ প্রিমিয়াম আসে ব্যাংকের মাধ্যমে তথা ব্যাংকাস্যুরেন্সের হাত ধরে। আর ৭.৫ শতাংশ প্রিমিয়াম আসে এজেন্টের মাধ্যমে, ৯.৫ শতাংশ আসে সরাসরি এবং ৩.২ শতাংশ আসে অন্যান্য চ্যানেলে (ব্রোকার্স/এফএ) । দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে তাইওয়ান। দেশটিতে ৫৩.৬ শতাংশ প্রিমিয়াম আয় হয় ব্যাংকাস্যুরেন্সের মাধ্যমে। এছাড়া ৪০.৭ শতাংশ প্রিমিয়াম আসে এজেন্টের মাধ্যমে এবং ৫.৭ শতাংশ অন্যান্য চ্যানেলে।
ব্যাংকের মাধ্যমে প্রিমিয়াম সংগ্রহে এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির ৫২ শতাংশ প্রিমিয়াম আসে ব্যাংকাস্যুরেন্স চ্যানেলে। হংকংয়ে ৪৯.২ শতাংশ প্রিমিয়াম আয় হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। থাইল্যান্ডে ৪২.৩ শতাংশ পলিসি বিক্রি হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। এছাড়া চীনে মোট প্রিমিয়ামের ৩৯ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৩৮.৩ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৩৭ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ৩৬.৭ শতাংশ, ফিলিপাইনের ৩৫ শতাংশ, ভারতে ২০.৮ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৪ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে ২ শতাংশ প্রিমিয়াম আসে ব্যাংকাস্যুরেন্সের মাধ্যমে।
ভারতের বীমাখাতের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইআরডিএআই ২০১৬ সালের এপ্রিলে ব্যাংকগুলোকে তিনটি জীবন বীমা, তিনটি সাধারণ বীমা এবং তিনটি স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার অনুমোদন দিয়েছে। এর আগে ব্যাংকগুলো শুধুমাত্র একটি জীবন বীমা, একটি সাধারণ বীমা ও একটি স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানির পলিসি বিক্রি করতে পারত। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অধিকাংশ প্রধান ব্যাংক বীমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
আইআরডিএআই’র ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে দেশটির বেসরকারি বীমার প্রবৃদ্ধিতে ব্যাংকাস্যুরেন্সের অবদান প্রায় ৫২ শতাংশ। দেশটিতে ২০১৩-১৪ তে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয়েছে ৪৭.৩৭ শতাংশ। আগের বছর অর্থাৎ ২০১২-১৩ তে এর পরিমাণ ছিল ৪৩.০৮ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১২-১৩ তে প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয়েছিল ৩৯.৬৮ শতাংশ। তবে ২০১৩-১৪ তে এর পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৭৩ শতাংশ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক্যাস্যুরেন্স এখন সময়ের দাবি বলে মনে করেন মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) মো. আবু শাহেদ। ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে তিনি বলেন, এতে করে বীমার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। মানসম্মত গ্রাহক পাবে বীমা কোম্পানি। বাড়বে বীমাখাতের আকার। ব্যাংকের মাধ্যমে অল্প কমিশনে বীমা পণ্য বিপণন করা সম্ভব, যা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে সহযোগিতা করবে। বাংলাদেশে বীমার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এবং গণমানুষের কাছে বীমার সুবিধা পৌঁছে দিতে সরকারকেও এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চীফ কনসালটেন্ট কাজী মোরতুজা আলী বলেন, ব্যাংকাস্যুরেন্স পদ্ধতি কার্যকর হলে একজন গ্রাহক এক ছাদের নিচেই ব্যাংকিং ও বীমা সেবা নিতে পারেন। অর্থাৎ ব্যাংকাসুরেন্স গ্রাহককে অন স্টপ ফিনান্সিয়াল সুপারমার্কেট সুবিধা দেয়। ব্যাংকের মাধ্যমেই তারা ঝুঁকি কভারেজ পেতে পারে। প্রচলিত চ্যানেলের চেয়ে ব্যাংকাস্যুরেন্স চ্যানেলে বিতরণ খরচ কম হওয়ায় গ্রাহক তুলনামূলক কম দামে বীমা পণ্য কিনতে পারে। ব্যাংকে স্থায়ী নির্দেশাবলী কার্যকর করার মাধ্যমে খুব সহজে প্রিমিয়াম পরিশোধ করা যায়। এতে পলিসি ল্যাপস হওয়ার সম্ভাবনাও কমে আসে।
প্রগতি লাইফের মূখ্য নির্বাহী জালালুল আজিম আরো বলেন, ব্যাংকাস্যুরেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের পলিসি বাজারে আনা যেতে পারে। এরমধ্যে ব্যাংক হিসাবধারীদের জন্য একাউন্ট ব্যালান্স ইন্স্যুরেন্স অথবা ক্রেডিট ইন্স্যুরেন্স চালু করা যেতে পারে। এর মাধ্যেমে একাউন্ট হোল্ডারদের যেমন আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, তেমনি ব্যাংকের আর্থিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়। অর্থাৎ দেউলিয়া হওয়ার সুযোগ কমে আসে। সরকার চাইলে বীমাখাত থেকে বিনিয়োগ নিয়ে পদ্মাসেতুর মতো বড় বড় প্রকল্পে অর্থের যোগান দিতে পারে। সোস্যাল সিকিউরিটির জন্য সরকার বীমাখাতকে কাজে লাগাতে পারে।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি বাংলাদেশে ব্যাংকাস্যুরেন্স চালুর বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে কেন্দ্রিয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে পৃথক নীতিমালা করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।
প্রকাশের তারিখ- ৮ মার্চ, ২০১৭