২৩০ কর্মকর্তা মধ্যে ১৮৬ জনেরই ব্যক্তিগত নথি নেই, বেতন দেয়া হয়েছে ৪৩ কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক: উন্নয়ন কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেখিয়ে ২৩০ জনকে বেতন-ভাতা বাবদ পরিশোধ করা হয় ৪৩ কোটি ২২ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১৮৬ জনেরই পরিচয়ের কোন নথিপত্র বা ব্যক্তিগত ফাইলের হদিস পায়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিরীক্ষক দল। এসব কর্মকর্তার নিয়োগ দেখানো হয়ে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দেশজুড়ে থাকা ২৬টি ব্রাঞ্চ অফিসে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২৩০জন কর্মকর্তার মধ্যে ৪৪ জনের ব্যক্তিগত ফাইল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়ে কাজ করেন ৫ জন, ঢাকার শেখ মুজিব রোড শাখায় ৩ জন, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ শাখায় ২ জন, শান্তিনগর শাখায় ২ জন, দিলকুশায় ১ জন, ইমামগঞ্জ শাখায় ১ জন, খাতুনগঞ্জ শাখায় ২৪ জন, আন্দরকিল্লা শাখায় ৩ জন, আগ্রাবাদ শাখায় ২ জন এবং হাটখোলা শাখায় ১ জন কাজ করেন।
নিরীক্ষক দলের তথ্য মতে, ২৬টি ব্রাঞ্চে উন্নয়ন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বরে ১৯১ জনকে বেতন দেয়া হয় ১০ কোটি ২২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে ২০৪ জনকে দেয়া হয় ২২ কোটি ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এবং ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসে ২৩০ জনকে দেয়া হয় ১০ কোটি ৯২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২১ সালে বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী বাড়ানো হয় ৩০ জন। তবে এই ৩০ জন কর্মকর্তা বাড়ানোর ফলে বেতন বৃদ্ধি পায় ১ কোটি ২৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ২০২০ সালে কোম্পানিটির বেতন খাতের খরচ হয়েছে মোট ২২ কোটি ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। যা ২০২১ সালে দাঁড়ায় ২৩ কোটি ৩৬ লাখ ৫৮ হাজার টাকা।
তবে ব্রাঞ্চ ভিত্তিক বেতনের তথ্য তুলে ধরা হলেও পৃথকভাবে ২৩০ জন উন্নয়ন কর্মকর্তার নাম-ঠিকানা, ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার সংক্রান্ত কোন তথ্য নিরীক্ষকা প্রতিবেদনে দেয়া হয়নি। অপরদিকে ১৮৬ জনের নামে বেতন-ভাতা দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে কিনা সে বিষয়েও অধিকতর তদন্ত করেনি আইডিআরএ।
অন্যদিকে নিরীক্ষক দল বেতন-ভাতার হিসাবেও ৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা গড়মিলের তথ্য দিয়েছে ২০১৯ থেকে মে ২০২১ সালের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে বেতন দেয়া হয়েছে ১০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। অথচ এ সংক্রান্ত এনেক্সার ‘এইচ’-এ প্রদত্ত মোট বেতন দেখানো হয়েছে ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
তবে ২০২১ সালে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে উন্নয়ন কর্মকর্তা ছিল ২৩০ জন। যার মধ্যে ১৮৬ জনেরই কোন তথ্য পায়নি নিরীক্ষক দল। অথচ ২০২২ সালের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কোম্পানিটির উন্নয়ন কর্মকর্তার সংখ্যা ২০৭ জন। যার মধ্যে ২ জন কর্মকর্তার স্বশরীরে উপস্থিত পায়নি নিরীক্ষক দল। এই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির ২৫ জন উন্নয়ন কর্মকর্তা কমে গেছে।
নিরীক্ষক দলের প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে ২০২২ সালে ২০৭ জন উন্নয়ন কর্মকর্তার হাজিরা ও ব্যক্তিগত নথিপত্র প্রদান করে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স। তবে তাদের মধ্যে ২ জন কর্মকর্তার স্বশরীরে উপস্থিত পায়নি নিরীক্ষক দল। ভিপি এবং এভিপি পদের ওই দুই কর্মকর্তা এক বছরে বেতন-ভাতা নিয়েছেন মোট ২৪ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে ভুতুরে কর্মকর্তার নামে বেতন-ভাতা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে নিরীক্ষক দল।
এর আগে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স প্রধান কার্যালয়ের ৬৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে বেতন-ভাতা পরিশোধ করে। তবে কোম্পানিটি শীর্ষস্থানীয় ১০ কর্মকর্তার বেতন-ভাতার তথ্য নিরীক্ষক দলকে প্রদান করে। নিরীক্ষক দলের মতে, অফিসের পিয়ন এবং ড্রাইভারদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে নগদে।
নিরীক্ষক দল বলছে, ওই তিন বছরে উন্নয়ন কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যে বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে তার স্যালারি স্টেটমেন্ট ও পেমেন্ট ভাউচার নিরীক্ষকদের প্রদান করেনি নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স।
নিরীক্ষক দলের প্রাপ্ত তথ্য অনুরারে, ২০১৩ সালে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ৪৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকা এবং উন্নয়ন কর্মকর্তাদের ২ কোটি ২৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকা বেতন-ভাতা ক্যাশ বা নগদে দেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালে উন্নয়ন কর্মকর্তাদের নামে ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা নগদে পরিশোধ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ২০১৫ সালে শীর্ষস্থানীয় ৯ কর্মকর্তার নামে স্পেশাল অ্যালাওয়েন্স বাবদ ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা নগদে পরিশোধ করা হয়েছে।
বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপিত অনিয়ম-আপত্তির বিষয়ে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এসিসট্যান্ট ভাইস-প্রেসিডেন্ট (অর্থ ও হিসাব) বিদ্যুৎ কুমার সমাদ্দার বলেন, বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপিত সকল অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এসব বিষয়ে আমাদের নতুন করে কিছু বলার নেই। যা বলার তা আইডিআরএ’কে লিখিতভাবেই জানানো হয়েছে।
আইডিআরএ’র উপ-পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সোলায়মান এ বিষয়ে বলেন, বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলোর ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের টার্মস অব রেফারেন্স (টিওআর) অনুযায়ী প্রতিটি অনিয়মের জন্য কোম্পানিগুলোকে জরিমানা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব বিষয়ে এখনো কাজ চলছে, অপরাধ অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।