চিঠি গোপন করে নিরাপরাধীদের শাস্তি দিয়েছে আইডিআরএ
মোস্তাফিজুর রহমান টুংকু: বীমাগ্রাহক জুট টেক্সটাইল মিল কর্তৃক কথিত ৯৬টি বিল-ভাউচারের সিংহভাগই প্রথম জরিপকারীদের তদন্ত শেষে এমনকি চূড়ান্ত জরিপ প্রতিবেদন দাখিলের পরে জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরী করা। বীমা দাবির দ্বিগুণ টাকা হাতিয়ে নিতে বীমাগ্রাহকের ষড়যন্ত্রের বৈধতা দেয় দ্বিতীয় জরিপকারীরা। দিন- তারিখের গণ্ডগোলসহ তুলে ধরা হয় অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে দেয়া কোটি কোটি টাকার বিল-ভাউচারগুলো। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে এসব বিস্তারিত তুলে ধরেছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি।
কিন্তু এককভাবে বীমাগ্রাহক একার পক্ষে কী আদৌ এত বড় অনিয়ম-দুর্নীতি সম্ভব? অনুসন্ধান বলছে, বীমার ইতিহাসের ভয়াবহ এই জালিয়াতিতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে দ্বিতীয় জরিপকারীদ্বয় ইঞ্জিনিয়ার সার্ভে এসোসিয়েট লিমিটেড ও মিডল্যান্ড সার্ভে ইন্সপেকশন কোম্পানি। টেক্সটাইল মিলের ভূয়া-বিল ভাউচারের প্রতিটি সঠিক বলে বৈধতা দিয়েছে দ্বিতীয় জরিপকারীরা। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষাপতিত্বের শুনানীতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজেদের পক্ষে রায় পর্যন্ত বাগিয়ে নিয়েছে। যুক্তি-তর্ক ও প্রমাণের তোয়াক্কা না করেই দ্বিতীয় জরিপকারীর বক্তব্যকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (আইডিআরএ)। প্রথম জরিপকারীদ্বয় ও কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের পক্ষ থেকে উত্থাপিত অভিযোগগুলো তদন্ত না করে উল্টো তাদের বিরুদ্ধে দফায় দফায় শাস্তি দিয়েছে আইডিআরএ। কীভাবে এবং কাদের যোগাসাজসের মাধ্যমে ১৩ কোটি টাকার বীমা দাবি ‘আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ’র মতো ২৪ কোটি টাকা হলো সেই খবর থাকছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্বে।
প্রথম জরিপকারীদের ছাড়াই প্রশ্নবিদ্ধ শুনানী?
বীমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি থেকে সরে এসে প্রথম জরিপকারীরা ভালভাবে কারখানা পরিদর্শন না করেই ভুল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম দেখিয়েছে- এমন অভিযোগ তোলে জুট টেক্সটাইল মিল। আর সেই অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর শুনানীর আয়োজন করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। শুনানীতে ডাকা হয় বীমা কোম্পানি কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী, বীমাগ্রহীতা জুট টেক্সটাইল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং পুনর্বীমাকারী সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই প্রথম জরীপকারীদ্বয় বাল্টিক কন্ট্রোল (বিডি) এবং দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সপেকশনের কাউকে্ই ডাকা হয়নি আলোচিত সেই শুনানীতে। ফলে বীমা গ্রহীতার উত্থাপিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো ধরনের যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ দেয়া হয়নি প্রথম জরিপকারীদের। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করলেও তা আমলে নেয়নি বলে অভিযোগ করে কন্টিনেন্টাল। শুনানীতে জরিপ প্রতিবেদন না পাওয়ার অভিযোগ করে জুট মিল কর্তৃপক্ষ। জরিপকারীদের আত্নপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ ওই শুনানীতে; The insurance Rules, 1958 এর বিধির ২৬ এর (ক) এর উপ-বিধি ৩ লংঘন করেছে প্রথম জরিপাকারীরা এবং আইন লঙ্ঘন করার কারণে কেন জরিপকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে না তার জবাব প্রদানের নির্দেশ দেয়। একইসাথে বীমা কোম্পানিকে জরিপ প্রতিবেদন বীমা গ্রহীতাকে অবহিত করার নির্দেশ দেয়। শুনানী পরবর্তীতে জরিপ প্রতিবেদনে বীমা দাবির ক্ষতি প্রায় ১৩ কোটি টাকার বিষয়ে আপত্তি তোলে জুট মিল। নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে সার্ভেয়ার নিয়োগের দাবি করে বলে জানায় আইডিআরএ।
প্রথম জরিপকারীদের অনুপস্থিতিতে এবং ১ম জরিপ প্রতিবেদনের ওপর আলোচনা না করেই দ্বিতীয় জরিপকারী নিয়োগ গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানায় বীমা কোম্পানী। কিন্তু কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স কর্তৃক রিভিউ শুনানীতে উত্থাপন করলেও এসব বিষয় এড়িয়ে যায় আইডিআরএ।
এমনকি দ্বিতীয় শুনানীতে বীমাগ্রহীতা জুট টেক্সটাইল মিলের নিকট জরিপ প্রতিবেদন প্রেরণের জননী কুরিয়ার সার্ভিসের প্রমাণ পত্র দেখায় প্রথম জরিপকারিরা। কিন্তু তা বিবেচনায় না নিয়ে কুরিয়ার প্রাপ্তি স্বীকার পত্র দেখতে চায় আইডিআরএ। তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র পিওডি দেখাতে পারেনি ১ম জরিপকারীরা। আর সেই প্রাপ্তি স্বীকার পত্র দেখাতে না পারায় খড়গহস্ত হয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। লাইসেন্স স্থগিত করে জরিপকারীদের। জরিপ প্রতিবেদন না পাঠানোর দায়ে লাইসেন্স স্থগিতের বিধান নেই বিদ্যামান বীমা আইনে। যদিও নিজেদের করা আইন ভঙ্গ করে ‘লঘু পাপে গুরু দণ্ড’ দিয়ে নিরপেক্ষতার বদলে ভাউচার জালিয়াত বীমাগ্রহীতা ও দ্বিতীয় জরিপকারীদের পক্ষ নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আর এর মাধ্যমেই জন্ম হয় বাংলাদেশের বীমার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জালিয়াতি ও দুর্নীতির ঘটনার।
চোরের মায়ের বড় গলা
শুনানীতে শুরু থেকেই আইডিআরএ'কে প্রভাবিত করতে দোর্দাণ্ড প্রতাপ দেখায় ইঞ্জিনির্য়াস সার্ভে এসোসিয়েটের প্রধান জরিপকারী আতিক উল্ল্যাহ ভূঁঞা। এমনকি শুধু প্রথম জরিপকারীদের ও হম্বিতম্বি নয়, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দম্ভোক্তি করার অভিযোগ রয়েছে আতিক উল্ল্যাহর বিরুদ্ধে।অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের আলোচনাও গড়াতে দেয়নি বলে জানায় শুনানীতে অংশগ্রহণকারীরা।ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধান বলছে, জালিয়াতি ও ভুলে ভরা ৯৬টি ভাউচার যেন আইডিআরএ খতিয়ে না দেখে সেজন্যই শুনানীতে উচ্চকিত ছিল আতিক উল্ল্যাহ। তবে কী নিজেদের দোষ ত্রুটি আড়াল করতেই ‘চোরের মায়ের বড় গলার’ মতো তাদের এমন হম্বিতম্বি ?
প্রথম ও দ্বিতীয় জরিপকারীসহ সকল পক্ষকে নিয়ে ১২ মার্চ ২০১৮ তারিখে আবারও শুনানী ডাকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কীভাবে টাকার অংক দ্বিগুণ হলো তার বিষয়টি ব্যাখা দেয় দ্বিতীয় জরিপকারীরা। সেদিনের সেই শুনানীর পক্ষ-বিপক্ষ ও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য চৌম্বুক অংশ ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা জরুরি;
শুরুতেই দুটি জরিপ প্রতিবেদনের মধ্যে টাকার অংকের অস্বাভাবিক পার্থক্য কেন তা দ্বিতীয় জরিপকারীদের কাছে জানতে চায় আইডিআরএ। জবাবে দ্বিতীয় জরিপকারীরা বলেন, ‘প্রথম জরিপের সাথে দ্বিতীয় জরিপ প্রতিবেদনের মূল পার্থক্য হলো দ্বিতীয় জরিপে স্পেয়ার পার্টস সংশ্লিষ্ট ক্রয় সংক্রান্ত ৯৬টি বিবেচনায় নিয়ে এ সকল বিল ভাউচার সরেজমিনে যাচাই বাছাই করা হয়েছে। কিন্তু প্রথম জরিপকারীরা উক্ত ৯৬ টি বিল ভাউচার বিবেচনায় নেননি।’
দ্বিতীয় জরিপকারীদের ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের সত্যায়িত-প্রত্যায়িত সেই ৯৬টি বিল ভাউচারই হিসাব-নিকাষ পাল্টে দিয়েছে বীমা দাবির। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে দেখানো হয়েছে কিভাবে অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে ভূয়া বিল ভাউচার বানিয়েছে জুট মিল কর্তৃপক্ষ। শুধু তাই নয়, ৩৫টি ভাউচারের তারিখ প্রথম চূড়ান্ত জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশের পর। আর বাকীগুলোর বেশিরভাগেরই তারিখ ১ম জরিপকারীদের কারখানা পরিদর্শনের পরের তারিখে। কিভাবে তড়িঘড়ি করে জরিপ প্রতিবেদনের পরে এসব ভাউচার জালিয়াতি করা হয়েছে তা নিশ্চয় পাঠকের স্মরণ আছে?
মজার ব্যাপার, বীমাগ্রহীতা জুট টেক্সটাইল মিল কর্তৃপক্ষ নয়, দ্বিতীয় জরিপকারীরা অভিযোগ করছেন যে, প্রথম জরিপকারীরা ৯৬টি ভাউচার বিবেচনায় নেননি। ভাবটা এমন যে, ১৯ মাস আগে প্রথম জরিপকারীদের পরির্দশনের সময় উপস্থিত ছিলেন দ্বিতীয় জরিপকারীরা?
এখানেই শেষ নয়, ঢাকার চিন্ময় এন্টারপ্রাইজের অস্তিত্বের প্রমাণ স্বরূপ মালিকের ছবিসহ শুনানীতে উপস্থাপন করেন ইঞ্জিনিয়ার্স সার্ভে এসোসিয়েটের কর্ণধার আতিক উল্ল্যাহর ভূঁঞা। সরেজমিনে গিয়ে চিন্ময় এন্টারপ্রাইজের ঠিকানা, ৩৯২ নিউ ইস্কাটনে গিয়ে দেখা যায় এটি একটি ঔষধ কোম্পানির অফিস। ৪০ বছর ধরে ঔষধ কোম্পানিটি ওই ঠিকানায় রয়েছে বলে জানান বয়োবৃদ্ধ নিরাপত্তারক্ষী। কোনো কালেই চিন্ময় এন্টারপ্রাইজ বলে কোনো প্রতিষ্ঠান এই ঠিকানায় ছিল না বলেও নিশ্চত করেন তিনি।
অথচ সেই অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের কথিত মালিকের একটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি দেখিয়েই আড়াই কোটি টাকার বেশি দুটি বিলের বৈধতা দেয় দ্বিতীয় জরিপকারীরা। এত টাকার লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ভূয়া, নেই ট্রেড লাইসেন্স বা ভ্যাট রেজিষ্ট্রেশনের কাগজপত্র।এসব না দেখে শুধুমাত্র একজনের পাসপোর্ট সাইজের ছবি দেখালেই চিন্ময় এন্টারপ্রাইজের অস্তিত্ব প্রমাণ হয়? আতিক উল্ল্যাহর কথায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই রহস্যজনকভাবে তা ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেয়। চিন্ময় এন্টারপ্রাইজের প্যাডে উল্লেখিত ০১৭১৯৭৯৬৩১৯ সেল নম্বরটি ব্যবহার করেন চিন্ময় নামের এক ব্যক্তি। যিনি খুলনার একটি জুট মিলে চাকরি করেন। আর তার নাম ব্যবহার করে কে বা কারা বিল ভাউচার করেছে তা জানেন না বলে ইন্সুরেন্স নিউজ বিডি’কে টেলিফোনে জানান উক্ত নম্বর ব্যবহারকারী। এরচেয়ে ভুতুরে কাণ্ড আর কি কিছু হতে পারে?
৯৬ ভাউচারে খরচ দেখানো ১৪ কোটি টাকার হিসাব নেই ব্যাংকে
অস্তিত্বহীন বিল ভাউচারের বিপরীতে কারখানার যন্ত্রাংশ মেরামতের বাবদ জুট টেক্সটাইল মিল কর্তৃপক্ষের ওয়ার্ক অর্ডার বা কার্য্যাদেশ. পেমেন্ট ভাউচার, ব্যাংকের চেকের কপি সাথে ব্যাংকের স্টেটমেন্টের ব্যাপক গরমিল রয়েছে। বীমাগ্রহীতার ৯৬টি বিলে খরচ দেখালেও ১৪ কোটি ৬২ লাখ ৪৯ হাজার ১৮২ টাকার লেনদেনের তথ্য নেই তাদের ব্যাংক স্টেটমেন্ট। নিশ্চয়, এত টাকা নগদ লেনদেন করা সম্ভব নয় এবং বীমা থাকায় তা গ্রহণযোগ্য নয়। বীমাকৃত যে কোনো লেনদেনই ব্যাংকের মাধ্যমে হওয়ার কথা। আর যেহেতু কারখানায় অগ্নিকান্ড ঘটেছে এবং বীমাদাবি উত্থাপন করেছে সে সময় নিশ্চয় কেউ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে নগদ লেনদেন করবে না? ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখেই জরিপকারীরা ভাউচারগুলোর সত্যতা যাচাই বাছাই করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে। জরিপকারী হিসেবে সাধারণ এই বিষয়টি জানা থাকার কথা দ্বিতীয় জরিপকারী মিডল্যান্ড সার্ভে ও ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েটসের। দুঃখজনক হলেও সত্য, দ্বিতীয় জরিপকারীদের প্রতিবেদনে সেই সাধারণ করণীয়টুকু বিবেচনায় নেয়া হয়নি। তবে কি সত্যবাদী যুধিষ্ঠির দাবিদার আতিক উল্যাহরা পরিকল্পিতভাবেই এড়িয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়? বিষয়টি শুনানীতে উত্থাপন করেছিল কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরেও দ্বিতীয় জরিপকারীদ্বয়ের মতো বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষও নীরব থেকেছে। এতে দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধের বদলে জাল-জালিয়াতির পক্ষে আইডিআরএ’র অবস্থান রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ।
শুনানী আইডিআরএ'র, সিদ্ধান্ত আতিক উল্ল্যাহ'র কথায়?
৯৬টি অস্তিত্বহীন ও ভূয়া বিল-ভাউচারসহ অনিয়ম চিহ্নিত করতে নিশ্চয় কাউকে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। সাদা চোখেই ধরা পড়ে জন্মের আগেই টাকা পরিশোধের মতো। শুধু তাই নয়, বীমাগ্রহীতার সাথে যোগসাজস করে বাড়তি ১১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে চক্রান্ত করেছে। অভিনব সেসব জাল-জালিয়াতির পদে পদে প্রমাণ উঠে এসেছে। এমনকী কীভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির জায়েজ করতে আইডিআরএ’র শুনানীতে দ্বিতীয় জরিপকারীরা মিথ্যা ও বিভ্রান্তীকর যুক্তি-তথ্য প্রদান করা হয়েছে তার প্রমাণ পেয়েছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। একইসাথে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যূনতম যাচাই বাছাই ছাড়াই কীভাবে দ্বিতীয় জরিপকারীদের কথায় সম্পূর্ণ পক্ষপাতিত্বমূলক রায় দিয়েছে তাও অনুসন্ধানে উঠেছে।
বিচার মানি, তবে তাল গাছটা আতিক উল্ল্যাহর
জরিপ প্রতিবেদন না পাওয়ার অভিযোগে দ্বিতীয় জরিপকারী নিয়োগ নজিরবিহীন। অগ্নিকাণ্ডের ১৯ মাস পরে দ্বিতীয় জরিপকারীরা সঠিক চিত্র পাওয়ার সম্ভবানা খুবই কম থাকে। কারণ নিশ্চয় প্রায় দু’বছর ধরে পুড়ে যাওয়া সম্পদ ও যন্ত্রাংশ কেউ গুছিয়ে রাখে না আর রাখারও সুযোগ নেই। স্যালভেজ বা উদ্ধারকৃত মালামালের হিসাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বীমা দাবির জন্য। সঙ্গত কারণেই দ্বিতীয় জরিপকারী নিয়োগ গ্রহণযোগ্য নয় বলে শুনানীতে জানায় বীমাকারী কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স।
জবাবে দ্বিতীয় জরিপকারীদের পক্ষে ইঞ্জিনিয়ার সার্ভে এসোসিয়েশনের প্রধান জরিপকারি আতিক উল্ল্যাহ ভূঁইয়া বলেন, “অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায় যে, ২য় জরিপ কিংবা পুন: জরিপ ১, ২ কিংবা ৫ বছর পরও হয়েছে এবং এর প্রেক্ষিতে বীমা দাবির টাকাও পরিশোধ করা হয়েছে এবং এগুলোর একাধিক নজিরও রয়েছে।
মজার ব্যাপার, শুনানীতে সবার বক্তব্য, জরিপ প্রতিবেদনসহ দাখিলকৃত দলিলাদি পর্যালোচনা করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়। কারণ হিসেবে উল্লেখ করে, “দেশের বীমা শিল্পে ২য় জরিপ কিংবা পুন: জরিপ ১,২, কিংবা ৫ বৎসর পরও করা হয়েছে এবং এর প্রেক্ষিতে বীমাগ্রহীতাকে বীমা দাবির টাকাও পরিশোধ করা হয়েছে এবং এ গুলোর একাধিক নজিরও রয়েছে।”
অর্থাৎ শুনানীতে আতিক উল্যাহ যা বলেছেন তাই হুবুহু তুলে ধরেছে। নথিপত্র পর্যালোচনার কথা বলেও বাস্তবে আতিক উল্ল্যাহর একটি শব্দ গ্রহণ বা বর্জন করেনি আইডিআরএ’র পারিষদরা। জুট টেক্সটাইল মিলের বীমা দাবির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অবস্থান যে পক্ষপাতিত্বমূলক তা আবারও উঠে এলো।
এখানেই শেষ নয়, আইডিআরএ যে ৯টি ব্যাখ্যার ভিত্তিতে কন্টিনেন্টালের রিভিউ আবেদন খারিজ করেছে তার প্রায় সবগুলোই আতিক উল্ল্যাহর বক্তব্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে। এতোটাই নাজুক পরিস্থিতি যে, কোনটা আইডিআরএ'র বক্তব্য আর কোনটা আতিক উল্ল্যাহর বক্তব্য তা বোঝা মুশকিল। যেমন, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের ভাউচার সর্ম্পকৃত বীমা কোম্পানির অভিযোগের আলোকে আইডিআরএ সিদ্ধান্ত টেনেছে জালিয়াত চক্রের কথায়।
“মিলের মেশিনারিজ সংশ্লিষ্ট স্পেয়ার পার্টস ব্যতিত মেরামত করা সম্ভব নয়। এতে প্রমাণিত হয় চিন্ময় এন্টারপ্রাইজসহ অন্যান্য স্পেয়ার পার্টস সরবরাহ করার ফলেই মিলের মেশিনারিজ মেরামত করা হয়েছে। সুতরাং ভূয়া ভাউচার সংক্রান্ত বীমাকারীর ৫নং অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়।”
সরেজিমনে ঢাকার অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলো সত্য হয়ে গেল দ্বিতীয় জরিপকারীদের কথার ভিত্তিতে। যেহেতু আতিক উল্ল্যাহ এসব ভাউচারকে সত্য বলে প্রত্যায়ন করেছে, তাই বিনা বাক্যে সত্য বলে সিদ্ধান্ত টেনেছে আইডিআরএ। এমনকী দালিলিক প্রমাণ দেয়ার পরও একটি টাকা কমানোর প্রয়োজন বোধ করে নিয়ে তারা। আশ্চর্যজনকভাবে দ্বিতীয় জরিপকারীদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৪ কোটি ৪৬ লাখ ৬ হাজার ৯৪৪ টাকা-ই ৭ দিনের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেয় বীমাখাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে লেজ বুঝি মাথাকে নাড়ছে! নিয়ন্ত্রক সংস্থার এহেন পক্ষপাতিত্বমূলক সিদ্ধান্তে দেশে বীমাখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
চিঠি গোপন করে হঠাৎই দ্বিতীয় জরিপকারী নিয়োগের আবেদন?
‘ছিল বিড়াল, হয়ে গেল রুমাল’ বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের এই লেখার সাথে কম বেশি সবাই পরিচিত। সেই গল্পের বাস্তব রূপ দিয়েছে খুলনার দিঘলীয় অবস্থিত জুট টেক্সটাইল মিল কর্তৃপক্ষ। বীমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি করতে করতেই হুট করে দাবি তোলে দ্বিতীয় সার্ভেয়ার নিয়োগের। অনেকটা ইউটার্ণ দিয়ে প্রথম জরিপকারীদের বিরুদ্ধে সাজানো হয় ভিত্তিহীন অভিযোগ। আর হঠাৎই কেন বীমা দাবি দ্রুত নিস্পত্তির দাবি থেকে সরে এসে দ্বিতীয় জরিপকারী নিয়োগের দাবি উঠলো তাও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । এমনকী রহস্যজনকভাবে দুর্ঘটনার ১৯ মাস পর নিয়োগ দেয়া হয় দ্বিতীয় জরিপকারী। মজার ব্যাপার, বীমা গ্রহীতা জুট টেক্সটাইলের ‘কথিত’ অভিযোগ আমলে নিলেও বীমা কোম্পানি কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের কোনো কথাই শোনেনি আইডিআরএ।
২০১৬ সালের ৪ মে সকালে আগুন লাগে খুলনার জুট টেক্সটাইল মিলের এক নং শেডে। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বীমাকৃত কোম্পানি কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের নিয়োগকৃত জরিপকারী বাল্টিক কন্ট্রোল (বিডি) এবং দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সপেকশন যৌথ জরিপ প্রতিবেদন দেয় ৩০ মার্চ ২০১৭। নীট ক্ষয়ক্ষতি ১২ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯,৬১৪ কোটি টাকা বলে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনের আলোকে বীমা দাবি নিষ্পত্তির জন্য ১৩ মে ২০১৭ তারিখে বোর্ড সভায় অনুমোদন করা হয় এবং পুনর্বীমাকৃত কোম্পানি সাধারণ বীমার কাছে প্রেরণ করা হয়। বীমা দাবির পরিশোধের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলেও জানায় কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স। দাবি দ্রুত পরিশোধের জন্য আইডিআরএ ও কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের কাছে একধিক চিঠিও দেয় জুট টেক্সটাইল মিল।
আইডিআরএ'র চেয়ারম্যান বরাবর জুট টেক্সটাইল মিলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক রোকেয়া রহমান স্বাক্ষরিত ২৮ ডিসেম্বের ২০১৬ তারিখে আবেদন পত্রে লেখা হয়, “উক্ত বীমা কোম্পানী মনোনীত বাল্টিক কন্ট্রোল (বিডি) লি: এবং দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সপেকশন এর প্রতিনিধিগন ক্ষতিগ্রস্ত কাঁচামাল, প্রক্রিয়াজাত মালামাল, প্রস্তুতকৃত মজুদ পণ্য, মেশিনারী এবং অবকাঠামো একাধিকবার সরজেমিন পরিদর্শন করেন। এছাড়া বীমা কোম্পানী মনোনীত খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যান্ত্রিক বিভাগের ৪ জন অভিজ্ঞ অধ্যাপক প্রতিটি মেশিনের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে ব্যাপাক তদন্ত সম্পন্ন করেন।”........
এমতাবস্থায়, বিষয়টি বিবেচনা করে অতি দ্রুত যাতে আমরা ক্ষতিপুরন বাবদ বীমার টাকা পেয়ে মিলটি পুরাদমে চালিয়ে কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুদ্র অর্জন করতে পারি সে ব্যাপারে আপনার সহযোগিতা কামনা করছি।”
প্রথম জরিপাকারীরা কারখানা পরির্দশন করে সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন দিয়েছে তা স্বীকার করা হয়েছে এই আবেদন। ফলে ১২ কোটি টাকার জরিপ প্রতিবেদন যে মনগড়া নয়, তার অকাট্য দালিলিক প্রমাণ হিসেবে এটা যথেষ্ট। অন্য কেউ নয়, খোদ তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মা রোকেয়া রহমানের লেখা এটি। অথচ জরিপকারীদের একজনমাত্র প্রতিনিধি কারখানা পরিদর্শন করে এবং কাগজপত্র খতিয়ে না দেখেই মনগড়া প্রতিবেদন দিয়েছে বলে আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করে জুট টেক্সটাইল মিল কর্তৃপক্ষ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩০ কোটি টাকা দাবি করে দ্বিতীয় জরিপকারী নিয়োগের আবেদন করে বীমাগ্রহীতা। যদি বর্তমান ব্যবস্থাপনার পরিচালকের অভিযোগ সঠিক হয়, তাহলে আগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিঠিতে কীভাবে লিখলেন প্রতিনিধিগণ একাধিকবার সরেজমিন কারখানা পরিদর্শন করেছে? স্ববিরোধী বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাইতে পারতো আইডিআরএ। কিন্তু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি তারা।
আইডিআরএ’র নথিতে দেখা যায়, সাবেক চেয়ারম্যান শেফাক আহমেদের বরাবর পাঠানো প্রথম চিঠির বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব পান তৎকালীন নন-লাইফ সদস্য জুবের আহমেদ খান। ৫ জানুয়ারি ২০১৭। ফলে এই চিঠি আইডিআরএ’র কাছে না থাকার কোনো কারণ নেই। ফলে ভিত্তিহীন অভিযোগে বীমা দাবি বাড়িয়ে নিতে জুট টেক্সটাইল মিল এই চিঠি গোপন করলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেই প্রতারণা সহজেই ধরতে পারতো। এজন্য নতুন করে তদন্ত কমিটি গঠনের প্রয়োজন ছিল না, শুধু ফাইলের পাতা উল্টিয়ে দেখলেই পারতো। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য, নিয়ন্ত্রক সংস্থা জুট মিলের মতো রহস্যজনকভাবে গোপন করে সেই চিঠি। এখানেই শেষ নয়, ত্বড়িৎগতিতে শুনানী করে দ্বিতীয় জরিপকারী নিয়োগ এবং তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী হুবুহু ২৪ কোটি টাকা পরিশোধের কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স হুশিয়ারি দিয়ে নির্দেশ দেয়।
এমনকী দ্রুত বীমা দাবি নিষ্পত্তির জন্য ২/২/২০১৭ তারিখে আরও একটি চিঠি লেখে জুট টেক্সটাইল মিলের নির্বাহী পরিচালক মোশাররফ হোসনে খান। কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে লেখা ওই চিঠিতে ১ম জরিপকারীদের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র অভিযোগ তোলেনি। “বীমা দাবীর স্বপক্ষে যাবতীয় তথ্য ও উপাত্ত যথাসমযে দাখিল করেছি। ”
পুরো চিঠিতে কোথাও বলা হয়নি যে, ১ম জরিপকারীরা মনগড়া প্রতিবেদন দিয়েছে। মিল কর্তৃপক্ষই বলছে জরিপকারীদের সব কাগজপত্রই দিয়েছে। অথচ দ্বিতীয় জরিপকারীরো বলছে, ৯৬ টি ভাউচার হিসাবে নেয়নি ১ম জরিপকারীরা। এতো দেখি, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি!
নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকায় নাখোশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন
প্রথম শুনানীর ভিত্তিতে দ্বিতীয় জরিপকারীদ্বয় ইঞ্জিনিয়ার্স সার্ভে এসোসিয়েটস লিমিটেডে ও মিডল্যান্ড সার্ভে এন্ড ইন্সপেকশন কোম্পানিকে নিয়োগের জন্য নির্দেশনা দেয় আইডিআরএ। নিয়োগের ৩ মাসের মধ্যে ক্ষয়-ক্ষতি নিরুপণ করে অস্বাভাবিকভাবে ২৪ কোটি ৪৬ লাখ ৬ হাজার ৯৪৪ টাকার বীমাদাবির দ্বিতীয় জরিপ প্রতিবেদন দেয়। যা প্রথম জরিপকারির চেয়ে ১১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বেশি। অগ্নিকাণ্ডের ১৯ মাস পর দ্বিতীয় জরিপ প্রতিবেদনে বীমা দাবি দ্বিগুণ হওয়ার ঘটনায় রীতিমত বিস্মিত বীমাখাত সংশ্লিষ্টরা। আলোচনা গড়ায় বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সাম্প্রতিক বোর্ড সভায়। বোর্ড সভায় একলাফে বীমা দাবি দ্বিগুণ হওয়ার উদ্বেগ জানায় এবং বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অবহিত করার সিদ্ধান্তও হয় বিআইএ’র সভায়। দ্বিতীয় জরিপকারীদের প্রতিবেদন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানান ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবীর হোসেন। বিষয়টি আইডিআরএ চেয়ারম্যানকে অবহিত করার কথাও জানান শেখ কবীর। বীমা কোম্পানিকে গলা টিপে হত্যা করে বীমা দাবি পরিশোধের নির্দেশ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে ক্ষোভ জানান তিনি।
চলবে...