বীমা শিক্ষার শর্ত নেই বীমা জরিপকারীর যোগ্যতায়, মিশ্র প্রতিক্রিয়া

আবদুর রহমান আবির: বীমা শিক্ষার বাধ্যবাধকতা না রেখেই বীমা জরিপকারীর যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। দেশি বা বিদেশি স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রিধারী যে কেউ হতে পারবেন নন-লাইফ বীমার জরিপকারী। এক্ষেত্রে জরিপকারী হিসেবে ৫ বছরের অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট। এমন শর্ত দিয়েই “নন-লাইফ বীমা জরিপকারী (লাইসেন্সিং) বিধিমালা, ২০১৮” এর গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।

মূলত বীমা জরিপকারীরাই বীমাকৃত সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণ করে থাকে। একই সাথে পলিসির শর্তের সাথে ক্ষয়-ক্ষতির সমন্বয়ও করে। এ ছাড়াও বীমাকৃত সম্পদের ক্ষতির প্রকৃত কারণও খুঁজে বের করেন জরিপকারীরা। জরিপকারীর এই জরিপ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই বীমা দাবি নিষ্পত্তি করা হয়।

এই প্রবিধানমালায় জরিপকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতার যে শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে তা এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনায় যথেষ্ট কিনা তা নিয়ে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি কথা বলে বীমা বিশেষজ্ঞ ও এখাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। একই সাথে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে জরিপকারীর লাইসেন্স পেতে শর্ত হিসেবে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় তারও খোঁজ-খবর নেয়া হয়।

এতে দেখা যায়, একাডেমিক ডিগ্রির পাশাপাশি বীমা বিষয়ে পেশাগত শিক্ষাকেও অত্যাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জরিপকারীর লাইসেন্স প্রদানে। অন্যদিকে বীমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বীমা জরিপকারীর লাইসেন্স দিতে শুধু স্নাতক ডিগ্রিই যথেষ্ট নয়। বরং স্নাতক ডিগ্রির পাশাপাশি বীমা বিষয়ে পেশাগত ডিগ্রিও আবশ্যক।

নন-লাইফ বীমা জরিপকারী (লাইসেন্সিং) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩ বিধিতে বীমা জরিপকারীর উপ-শ্রেণির কথা উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, ধারা ১২৭ এর উপ-ধারা ৩ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বীমা জরিপকারীকে অগ্নি; নৌ (কার্গো); নৌ-হাল (জাহাজ কাঠামো); মোটর; ইঞ্জিনিয়ারিং; এভিয়েশন; বিবিধ এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সময় সময় সরকারি গেজেটে প্রকাশিত আদেশ দ্বারা নির্দিষ্টকৃত অন্যকোন উপ-শ্রেণী।

এই বিধিমালার ৫ (১) বিধিতে লাইসেন্স প্রদানের প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, আবেদনকারী কোন স্বীকৃত দেশি বা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় হতে অন্যূন স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রিধারী; জরিপকারী হিসেবে ৫ বছরের কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন; চাকরিজীবী নয়; সরকারি বীমাকারী বা বীমা এজেন্ট বা ব্রোকার বা তাদের কর্মচারী নয়; কোন করপোরেশন, কোম্পানি, ফার্ম বা সংস্থার কর্মচারী নয়; পূর্ণ সময়ের জন্য পরিচালক, অংশীদার বা উপদেষ্টা হিসেবে অন্য কোন কোম্পানি, ফার্ম বা সংস্থার সহযোগী নয় এবং আইনের ধারা ১২৭ এর উপধারা ৬ এর অধীন অযোগ্য নয়।

এ ছাড়াও উপবিধি ৩ এ জরিপকারীকে ইন্স্যুরেন্স সার্ভেয়ারর্স এসোসিয়েশনের একজন সদস্য হতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। উপবিধি ২ এ জরিপকারী হিসেবে কোন কোম্পানি বা ফার্মকে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে শর্তাদি উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা অংশীদারকে প্রায় একই ধরনের যোগ্যতার শর্ত পূরণের কথা বলা হয়েছে।

বিধি ৬ এ নির্ধারিত শর্তাদি পূরণ সাপেক্ষে কর্তৃপক্ষকে লাইসেন্স প্রদানের কথা বলা হয়েছে। আর বিধি ৭ এ লাইসেন্সের মেয়াদ ও নবায়নের বিষয়ে উল্লেখ করেছে। লাইসেন্সের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ইস্যু তারিখ থেকে এক বছর। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৩০ দিন পূর্বে বিধি ১৩ এর দফা খ-তে উল্লেখিত নবায়ন ফি পরিশোধ সাপেক্ষে কর্তৃপক্ষ বরাবর লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করতে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে জরিপকারীর জন্য বীমার উপ-শ্রেণিভিত্তিক একাডেমিক শিক্ষা অর্জনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেখানে ফায়ার ইন্স্যুরেন্সের জন্য ব্যাচেলর অব ইঞ্জিনিয়ারিং/ টেকনোলজি, এআইআইআই, এফআইআইআই, আইআইআরএম থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমা ইত্যাদি ডিগ্রি চাওয়া হয়।

আবার নৌ (কার্গো) বীমার জন্য মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং/ নেভাল আর্কিটেকচার/ ব্যাচেলর অব ইঞ্জিনিয়ারিং বা টেকনোলজি, ইন্স্যুরেন্স ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া থেকে এআইআইআই, এফআইআইআই অথবা আইআইআরএম থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমা ইত্যাদি ডিগ্রি চাওয়া হয়।

মোটর বীমার জন্য ৩ বছরের ডিপ্লোমা ইন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং/ অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বা ব্যাচেলর অব ইঞ্জিনিয়ারিং/ টেকনোলজি ইত্যাদি ডিগ্রি চাওয়া হয়। আবার শস্য বীমার ক্ষেত্রে চাওয়া হয় এগ্রিকালচারাল সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রি।

এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ফারজানা চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, জরিপকারীদের মান অবশ্যই উন্নয়ন করতে হবে। কারণ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পেশা। জরিপকারীর ওপর নির্ভর করে বীমাকারী ও বীমা গ্রাহকের স্বার্থ। তাদের ভুলের কারণে অনেক সময় উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এর আগে জরিপকারীর লাইসেন্স প্রদানের কোন মানদণ্ডই ছিল না। সে হিসেবে এবার যেটা করেছে তা ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করছি। তবে পরবর্তীতে যোগ্যতার মান আরো বাড়াতে হবে। জরিপকারীদের দায়বদ্ধ হতে হবে এবং আরো দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা বিভিন্ন সময় জরিপকারীদের যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকেও বলেছি, যোগ করেন তিনি।      

নিটল ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এস এম মাহবুবুল করিম বলেন, বীমা জরিপকারীর শুধু স্নাতক ডিগ্রি থাকাই যথেষ্ট নয়। অবশ্যই তাদের বিশেষায়িত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অন্যথায় তারা জরিপ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে না এবং জরিপও সঠিক হবে না। বিশেষায়িত জ্ঞান না থাকলে অনেক ত্রুটিও তারা উদঘাটনে সক্ষম হবে না।  

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স সার্ভেয়র্স এসোসিয়েশেনের সভাপতি কে এন এম খোরশেদ আলম বাদল বলেন, জরিপকারীর দক্ষতা ও মান উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন। এ জন্য আমরা বিভিন্ন সময় সংগঠনের পক্ষ থেকে তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকি। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও এগিয়ে যেতে চাই।

তবে এই মুহূর্তে উন্নত দেশের মতো বিশেষায়িত ডিগ্রি চাওয়া হলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। যারা দীর্ঘ দিন ধরে জরিপ কাজ করছেন তারা অনেকেই মানের ঘাটতির কারণে পেশা ধরে রাখতে পারবে না। যা বীমাকারী, বীমা গ্রাহক এবং জরিপকারী কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়। তবে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল তৈরি করতে বীমা কর্তৃপক্ষ ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

এ বিষয়ে বীমা ব্যক্তিত্ব এ কে এম এহসানুল হক এফসিআইআই বলেন, পেশাগত যোগ্যতা এবং সঠিক প্রশিক্ষণ ছাড়া বীমা জরিপ অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল কাজ। আন্তর্জাতিক বীমা বাজারে জরিপকারীরা সাধারণত পেশাগত শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের অনেকে এসোসিয়েট বা ফেলো অব চার্টার্ড ইন্সটিটিউট অব ইন্স্যুরেন্স এবং সেই সাথে এসোসিয়েট বা ফেলো অব চার্টার্ড ইন্সটিটিউট অব লস এডজাস্টার।

অথচ বাংলাদেশের অনেক সার্ভেয়ারের প্রয়োজনীয় যোগ্যতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যার কারণে এদের মান এবং যোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। দায়িত্বে অবহেলা, পক্ষপাতিত্ব, সার্ভে রির্পোটে ভুল তথ্য পরিবেশন ইত্যাদি ব্যাপারে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে বীমা কৃর্তপক্ষ বেশ কিছু সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে।

সার্ভেয়ারের সঠিকভাবে ক্ষতির তদন্ত বা নিরুপনের ব্যর্থতার কারণে বীমাকারী এবং বীমাগ্রহীতা উভয় পক্ষই সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বীমা খাতের উন্নয়নে বিশেষ করে বীমা গ্রহীতার স্বার্থ রক্ষার্থে এ ব্যাপারে বীমা কর্তৃপক্ষকে সার্ভেয়ারের নিবন্ধন নবায়ন এবং নতুন নিবন্ধন ইস্যুর পূর্বে সার্ভেয়ারের পেশাগত শিক্ষা, বিশেষায়িত জ্ঞান এবং অন্যান্য যোগ্যতার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।