নবায়ন কমিশন নিয়ে ডেল্টা লাইফের অবৈধ সার্কুলার

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় না করলে এজেন্টরা তাদের সংগ্রহ করা নবায়ন প্রিমিয়ামের উপর কোনো কমিশন পাবেন না এমন কোনো আইন নেই। অথচ এমন শর্তই আরোপ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে দেশের বৃহৎ লাইফ বীমা কোম্পানি হিসেবে খ্যাত ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। অবৈধভাবে এ সার্কুলার জারিতে অজুহাত দেখানো হয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের জারি করা কমিশন সিডিউল সংক্রান্ত (আইডিআরএ)। এতে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত এজেন্টরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে চাকরি হারানোর ভয়ে এমন অবস্থাতে কেউ প্রতিবাদও করতে পারছে না।

সার্কুলারে বলা হয়েছে, গণ-গ্রামীণ বীমার অনেক বীমা এজেন্ট কোন প্রথম জমা প্রিমিয়াম আয় করছেন না, শুধুমাত্র নবায়ন প্রিমিয়াম এর কমিশন নিচ্ছেন। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ'র নিয়মানুযায়ী বীমা এজেন্টকে সক্রিয় থাকতে হবে। এছাড়া, কাঙ্খিত প্রথম জমা প্রিমিয়াম অর্জিত না হওয়ায় প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম এর লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হচ্ছে না। এ প্রেক্ষিতে কোন বীমা এজেন্ট নির্ধারিত প্রথম জমা প্রিমিয়াম আয় করতে পারলে শুধুমাত্র তাকেই সার্কুলারে উল্লেখিত ছক অনুযায়ী নবায়ন কমিশন প্রদান করা হবে। অর্থাৎ শর্ত পূরণ না হলে নবায়ন কমিশন পাবেন না বীমা এজেন্ট।

সার্কুলারের উল্লেখিত ছক অনুসারে, কোন এজেন্টের মাসে ন্যূনতম ২ হাজার ৫শ' টাকা প্রথম জমা প্রিমিয়াম অর্জিত হলে প্রাপ্য নবায়ন কমিশনের ১০০% প্রদান করা হবে। ত্রৈমাসিক তথা জানুয়ারি-মার্চ, এপ্রিল-জুন, জুলাই-সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর-ডিসেম্বরে ন্যূনতম ৮ হাজার টাকা প্রথম জমা প্রিমিয়াম অর্জিত হলে প্রাপ্য নবায়ন কমিশনের ৯০% প্রদান করা হবে। ষান্মাষিক তথা জানুয়ারি-জুন ও জুলাই-ডিসেম্বরে ন্যূনতম ১৭ হাজার ৫শ' টাকা প্রথম জমা প্রিমিয়াম অর্জিত হলে প্রাপ্য নবায়ন কমিশনের ৮০% প্রদান করা হবে। এছাড়া বার্ষিক তথা জানুয়ারি-ডিসেম্বরে ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকা প্রথম জমা প্রিমিয়াম অর্জিত হলে প্রাপ্য নবায়ন কমিশনের ১০০% প্রদান করা হবে।

তবে এ ধরনের সার্কুলাকে অবৈধ বলছেন বীমা সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ বা নতুন পলিসি বিক্রি বাড়াতে এজেন্টদের চাপের মুখে রাখতে কোম্পানিগুলো নানা উদ্যোগ নিতে পারে। কিন্তু নবায়ন কমিন না দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এজেন্ট লাইসেন্স সচল থাকলে ওই এজেন্ট নবায়ন কমিশন পাবেন। নতুন পলিসি বিক্রির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সক্রিয় এজেন্টদের ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করা আছে। এক্ষেত্রে সক্রিয় এজেন্টদের অতিরিক্ত সুবিধা দেয়ার শর্তও রয়েছে।

ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মাঠ পর্যায়ে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, এ ধরনের শর্ত জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা আরো বলেন, আমার একেকজন জীবনটাই শেষ করে দিয়েছি ডেল্টা লাইফে কাজ করে। এখন অন্যকোনো কোম্পানিতে যেতেও পারছি না। কোম্পানি পরিবর্তন করলে গ্রাহকরাও অনিয়শ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। এমন একটি অবস্থায় চরম দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।

কোম্পানির অপর একটি সূত্র জানায়, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ মেয়াদ উত্তীর্ণ দাবি, অন্তবর্তীকালিন বোনাস দেয়ার ক্ষেত্রে নানান টালবাহানা করছে। প্রতিটি মুহুর্তেই গ্রাহককে জবাবদিহী করতে হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই।

সূত্র মতে, বীমা আইন ২০১০ ও লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কমিশন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে প্রথম বর্ষ বা নতুন পলিসি সংগ্রহ না করলে নবায়ন কমিশন পাবেন না এমন কোনো শর্ত নেই।

বীমা আইন ২০১০ এর ৫৮ (১) ধারায় বলা হয়েছে‍‌,‍ কোন ব্যক্তি বাংলাদেশে বীমা ব্যবসা অর্জন বা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বীমা এজেন্ট বা এজেন্ট নিয়োগকারী বা ব্রোকার ব্যতীত অন্য কাহাকে কমিশন বা অন্য কোন নামে কোন পারিশ্রমিক বা পারিতোষিক পরিশোধ করিবে না বা প্রদান করার জন্য কোন চুক্তি করিবে না৷

উপধারা ২ এ বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি কোন বীমা এজেন্টকে, তাহার যে লাইসেন্সের মেয়াদের মধ্যে লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসা সংগ্রহ করিয়াছিল উহার মেয়াদ উত্তীর্ণ হইলে, লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসার জন্য কোন নবায়ন কমিশন প্রদান করিবে না, বা উক্ত বীমা এজেন্টকে তৎকর্তৃক সংগৃহীত ব্যবসায়ের জন্য কমিশন গ্রহণ করিবে না যদি তিনি ধারা ১২৪ এর উপ-ধারা (১) এর অধীন নিবন্ধিত না হন৷ অর্থাৎ কোনো এজেন্ট তার নিবন্ধন নবায়ন হলেই তিনি নবায়ন কমিশিন প্রাপ্র্য হবেন।

বীমা আইন ২০১০ এর ৬১(১) ধারায় কমিশন পরিশোধ অবসানে বিধিনিষেধ বিষয়ে বলা হয়েছে- কোন ব্যক্তি এবং কোন বীমা এজেন্টের মধ্যে সম্পাদিত কোন চুক্তিতে যাহাতে বীমা এজেন্টের নবায়ন কমিশন বাজেয়াপ্তকরণ কিংবা কমিশন প্রদান বন্ধ করার বিধান সংযোজিত আছে তাহাতে ভিন্নতর কিছু থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে পরিচালিত লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স নবায়ন কমিশন এইরূপ কোন ব্যক্তি জালিয়াতির কারণ ব্যতিরেকে কেবলমাত্র বীমা এজেন্টের চুক্তি অবসান হওয়ার কারণে তাহাকে নবায়ন কমিশন প্রদানে অস্বীকৃতি জানাইতে পারিবে না।

আইডিআরএ ২০১২ সালের ১৫ মার্চ জারিকৃত ০৩(খ)/২০১২ নং সার্কুলারে বলা হয়েছে, যে এজেন্ট বছরে ন্যূনতম ১১টি নতুন পলিসি বিক্রি করেন এবং ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা বার্ষিক কমিশন অর্জন করেন তিনি সক্রিয় ফিনান্সিয়াল অ্যাসোসিয়েট (এফএ) । এক্ষেত্রে সক্রিয় অবস্থান বজায় রাখতে এজেন্টকে অবশ্যই রিনিউয়াল পার্সিসট্যান্সি বোনাস অর্জন করতে হবে। অর্থাৎ ২য় বর্ষ নবায়ন প্রিমিয়ামের ৭০% বা তার বেশি তবে ৮০% এর কম অর্জন করলে ২য় বর্ষ নবায়ন কমিশনের ১০% পার্সিসট্যান্সি বোনাস পাবে এজেন্ট। ৮০% বা তার ওপর তবে ৯০% এর কম হলে পার্সিসট্যান্সি বোনাস হবে প্রাপ্ত কমিশনের ১২.৫%। আর ৯০% এর ওপর ২য় বর্ষ নবায়ন প্রিমিয়াম অর্জন করলে প্রাপ্ত কমিশনের ১৫% পার্সিসট্যান্সি বোনাস পাবে এজেন্ট।

এছাড়া একজন সক্রিয় এজেন্ট বছরে ২০ হাজার টাকা বা তার বেশি কিন্তু ৫০ হাজার টাকার কম ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করলে তার প্রাপ্ত এক বছরের মূল কমিশনের ১০% ইনসেনটিভ বোনাস প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ এক বছরে ৩ হাজার টাকা কমিশন প্রাপ্ত হলে ওই এজেন্টকে আরো ৩শ' টাকা ইনসেনটিভ বোনাস প্রদান করতে হবে। একইভাবে বছরে ৫০ হাজার টাকা বা তার বেশি কিন্তু ১ লাখ টাকার কম ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করলে এজেন্টকে তার প্রাপ্ত এক বছরের মূল কমিশনের ২০% ইনসেনটিভ বোনাস প্রদান করতে হবে।  আর ১ লাখ টাকার ওপর প্রাপ্ত কমিশনের ৩০% ইনসেনটিভ বোনাস দিতে হবে।

অন্যদিকে ডেল্টা লাইফের প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম-এর লক্ষ্যমাত্রা ২০১৭ 'তে মাসভিত্তিক লক্ষ্যামাত্রা অর্জনের হার নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে লক্ষ্যমাত্রার ৬%, ফেব্রুয়ারিতে ৭% ও মার্চে ৯% তথা প্রথম ত্রৈমাসিকে ২২% লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। একইভাবে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ২৭% লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। এরমধ্যে এপ্রিলে ৮%, মে'তে ৭% ও জুনে ১০% অর্জন করতে হবে। তৃতীয় ত্রৈমাসিকে জুলাইয়ে ৬%, আগস্টে ৯% ও সেপ্টেম্বরে ৯% তথা ২৪% লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। সর্বশেষ চতুর্থ ত্রৈমাসিকের অক্টোবরে ৯%, নভেম্বরে ৯% ও ডিসেম্বরে ৯%, মোট ২৭% লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। এভাবে বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ১০০% অর্জন করতে বলা হয়েছে।

২০১১ সালের হিসাব মতে, ডেল্টা লাইফে সর্বমোট ১৮ হাজার ৭২৯ জন এজেন্ট এবং এমপ্লয়ার অব এজেন্ট রয়েছে ৪ হাজার ৩৯৯ জন। তবে কোম্পানির একটি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে তাদের এজেন্টের সংখ্যা ১৮ হাজারের ওপরে।

ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২০১৬ সালে ১৬৪ কোটি টাকা প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম ও ৪২১ কোটি টাকা নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে। এরআগে ২০১৫ সালে কোম্পানিটি ১০৬ কোটি ১০ লাখ টাকা প্রথম বর্ষ ও ৪১০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে। সর্বশেষ বছরে ডেল্টা লাইফের প্রিমিয়াম সংগ্রহে ৬৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

নবায়ন কমিশন নিয়ে সার্কুলার জারির বিষয়ে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিসি) আদিবা রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি'কে তিনি জানান, ফোনে কোন বিষয়ে তিনি কথা বলবেন না। লিখিতভাবে প্রশ্ন পাঠালে তিনি জবাব দেবেন। একথা বলেই তিনি ফোন রেখে দেন। এরপর কয়েক দফা ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে এ বিষয়ে লিখিতভাবে প্রশ্ন পাঠানোর জন্য তার 'ই-মেইল' ঠিকানা জানতে চেয়ে তার মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।