কমিশন বন্ধ ও ব্যাংকিং লেনদেনের নতুন নিয়মে নন-লাইফে সম্পদ বেড়েছে ৯%, বিনিয়োগ ১৫%
তাফহিমুল ইসলাম: করোনা মহামারিতে নন-লাইফ বীমা খাতে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বীমা খাত বাদে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। আশঙ্কা ছিল এই ধরণের পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় ধরণের লোকসানের মধ্যে পড়বে নন-লাইফ বীমা খাত। কিন্তু ২০২০ সালে নন-লাইফ বীমা খাতে সম্পদ বেড়েছে ৯ শতাংশ এবং বিনিয়োগ বেড়েছে ১৫ শতাংশ। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের জারিকৃত ৬৪ নং সার্কুলারকে সম্পদ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বীমা বিশেষজ্ঞরা।
বীমা সংশ্লিষ্ঠরা বলছে, করোনার মধ্যে কোন বাধা পরিলক্ষিত না হওয়া, দাবির পরিমান কমে যাওয়া, করোনার শুরুতে প্রায় তিন মাস কমিশন বন্ধ ও ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং অন্য সকল ব্যবসার মত বীমা ব্যবসা খারাপ না হওয়াকে সম্পদ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণ হিসাবে দেখছেন তারা।
৪৫ টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির ২০২০ সালের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে মোট সম্পদ ও বিনিয়োগে এমন চিত্র পেয়েছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি।
পর্যালোচনা উঠে এসেছে, ২০১৮ সালে নন-লাইফের ৪৫ কোম্পানির মোট সম্পদ ছিল ৭ হাজার ৯’শ ৮৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে ৬.৯০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৫’শ ৩৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে করোনা মহামারির মধ্যেও এই সব কোম্পনির মোট সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে। ২০২০ সালে মোট সম্পদ ৯ হাজার ৩’শ ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে থেকে ২০২০ সালে এক বছরে সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ৮’শ ৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা যা শতাংশের হিসাবে ৯.৪৮ শতাংশ।
২০২০ সালে সবচে বেশি সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে এক্সেপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের। ২০১৯ সালে কোম্পানিটির মোট সম্পদ ছিল ১১৯ কোটি ৩ লাখ টাকা। আর ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৭০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এই এক বছরের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ৫১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা যা শতাংশের হিসাবে ৪৩.৫৬ শতাংশ। এর পড়ে সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ক্রিষ্টাল ইন্স্যুরেন্সের। কোম্পানিটির ৩৭.৭৩ শতাংশ সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে যা টাকার হিসাবে ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ। ২৬ শতাংশ সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের।
শুধু সম্পদ নয় এই সময়ে বিনিয়োগও বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ২০১৮ সালে ৪৫ নন-লাইফ কোম্পানির মোট বিনিয়োগ ছিল ৩ হাজার ৯’শ ৯৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে মোট বিনিয়োগ ৪ হাজার ১’শ ৭০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ২০২০ সালে এসে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮’শ ২৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। যা শতাংশের হিসাবে ১৫.৪৩ শতাংশ। এই এক বছরে মোটি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে ৬’শ ৪৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
বিনিয়োগের দিকে সবচে এগিয়ে রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সে। কোম্পানিটির ২০২০ সালে মোট বিনিয়োগ করেছে ৫’শ ৮৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। যা ২০১৯ সালে ছিল ৪’শ ৬৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। এক বছরে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে ১’শ ২১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। মোট বিনিয়োগের ১২.১৪ শতাংশ রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের। আর মোট বিনিয়োগ ১১.২৮ শতাংশ রয়েছে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সরে। কোম্পানিটির ২০২০ সালে মোট বিনিয়োগ ৫’শ ৪৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
২০২০ সালে সবচে বেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে নর্দান ইন্স্যুরেন্সের। ২০২০ সালে ৭১.৫৫ শতাংশ বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে কোম্পানিটির। ২০১৯ সালে মোট বিনিয়োগ ৩৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা থেকে ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের ৫৪.২৯ শতাংশ, ক্রিষ্টাল ইন্স্যুরেন্স ৩৪.৮৪ শতাংশ বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে ২০২০ সালে।
প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সুজিত কুমার ভৌমিক ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডিকে বলেন, ২০২০ সালে পুরো সেক্টরে সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে। ব্যবসা কম হলেও কমিশন বন্ধ থাকার কারণে সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে। কমিশন বন্ধ থাকার কারণে সব কোম্পানির সম্পদ বৃদ্ধি হওয়া উচিত। আর সম্পদ বাড়লেই তো বিনিয়োগ বাড়বেই। আমাদের এফডিআর বা শেয়ার মার্কেট ছাড়া তো আর বিনিয়োগ করার কোন মাধ্যম নেই। আর আগের তুলনায় এই বছর খরচের পরিমান কম ছিল। প্রিমিয়াম আয়ের ৬৪ নং সার্কুলার থাকাতে আমি মনে করি সম্পদ বাড়ার আরেকটি কারণ।
ক্রিষ্টাল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম শহীদুল্লাহ বলেন, করোনার মধ্যে নন-লাইফ ব্যবসায় তেমন কোন প্রভাব পড়েনি। আর বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমে যাওয়ার ফলে এই বছর সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে।
রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খালেদ মামুন বলেন, আমাদের কোম্পানির সম্পদ বা বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণ যদি বলি তাহলে এর পুরো কৃতিত্ব ম্যানেজমেন্টের। তাদের সূদূর প্রসারী চিন্তার ফলে কোম্পানি লাভবান হচ্ছে। বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্ট কিছু নির্দেশনা দিয়ে দেয়, এইসব স্থানে বিনেয়োগ করা যাবে এর বাহিরে যাবে না। আমরা নির্দেশনা ফলো করি। এর ফলে আমাদের কোম্পানির বিনিয়োগ বৃদ্ধি হচ্ছে সাথে সম্পদও।
এ বিষয়ে বীমা বিশেষজ্ঞ এ কে এম এহসানুল হক এফসিআইআই বলেন, বীমা আইনের আলোকে নিয়ন্ত্রণের ফলে অনিয়ম অনেক কমেছে। আর প্রিমিয়াম আয় জমার ক্ষেত্রে ৩ ব্যাংক হিসাব রাখা বাধ্যতামূলক করার ফলে কোম্পনিগুলো তাদের আয় অন্য ক্ষেত্রে প্রবাহিত করতে পারে না। বলা যায় আগের থেকে অনিয়ম কমে গেছে।
সবচে বড় কারণ যদি বলা হয় এই সময়ে কমিশন কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার ফলে সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বীমা কোম্পানিগুলো যদি আইন মেনে ব্যবসা করে তাহলে মানুষের বীমা প্রতি আগ্রহের সাথে সাথে কোম্পনির ব্যবসাও বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থ্যার ভূমিকা জোরালো হতে হবে।