আইডিআরএ চেয়ারম্যানের একাউন্টে ৪ বছরে জমা ৪০ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক একাউন্টে ৪ বছরে জমা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। জমা করা এই টাকার সাথে ড. মোশাররফের পেশা, অর্থের উৎস ও হিসাব খোলার উদ্দেশ্যের সাথে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। একইসাথে এসব লেনদেনে ঘুষ ও দুর্নীতির সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। এমন প্রতিবেদন দাখিল করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ।

আজ বৃহস্পতিবার (২৬ মে) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. এজারুল হক আকন্দের দ্বৈত বেঞ্চে এই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

অপর দিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় চেয়ে আবেদন করায় আগামী ১৬ জুন প্রতিবেদন দাখিল ও শুনানীর দিন ধার্য করেছেন আদালত।

এর আগে একই বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো এক প্রতিবেদনেও ড. মোশাররফ ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইন ২০১২ এর ২৩ (১) ধারায় মামলার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ।

আদালতে দাখিল করা বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. মোশাররফ এবং তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে ৫টি ব্যাংক একাউন্টে মোট ৩০টি হিসাব পরিচালনার তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ। এর মধ্যে ১৮টি হিসাবে ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে জমা হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি ৮১ লাখ টাকা।

ড. মোশাররফ এবং তার স্ত্রী জান্নাতুল মাওয়া ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর ‘মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এন্ড কোম্পানি’র নামে নগদ ৫০ লাখ টাকার দু’টি এফডিআর করেন, যার সাথে ড. মোশাররফের ঘুষ গ্রহণের অভিযোগের যোগসূত্র থাকতে পারে বলে  সন্দেহ করছে বিএফআইইউ।

প্রতিবেদনটি বলা হয়েছে, লাভস এন্ড লাইভ অর্গানিকস লি. এবং গুলশান ভ্যালি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লি. এর বাইরে কাশফুল ডেভেলপার্স লি. নামে আরো একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ। এখানেও কর্মচারীদের কল্যাণের জন্য গ্রাচুইটি ফান্ড এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠন করেন ড. মোশাররফ।

পাশাপাশি ফান্ড দু’টি পরিচালনার জন্য ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়, যার চেয়ারম্যান হন তিনি নিজে, সেক্রেটারি তার স্ত্রী জান্নাতুল মাওয়া এবং অন্যতম সদস্য ড. মোশাররফের শাশুড়ি লাভলি ইয়াসমিন।

ফান্ড রুলস অনুযায়ী কর্মচারীদের প্রদেয় বেতন/মজুরির ৭.৫% হারে প্রতিমাসের শেষ কর্মদিবসে বোর্ড অব ট্রাস্টিকে পরিশোধ করার বিধান রয়েছে।

আলোচ্য ৩টি প্রভিডেন্ট ফান্ড ও ৩টি গ্রাচুইটি ফান্ড হিসেবে জমা হয়েছে প্রায় ৩২.৯১ কোটি টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে লেনদেন দেখানো হয়েছে প্রায় ৩.৬০ কোটি টাকা।  যা অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে বিএফআইইউ।

এই ৬টি ফান্ডে নগদ জমা হয়েছে ৩.২৩ কোটি টাকা। বাকি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ইএফটি, ক্লিয়ারিং ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে জমা হয়।

প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, ৩টি প্রভিডেন্ট ফান্ড ও ৩টি গ্রাচুইটি ফান্ড অর্থাৎ ৬টি ফান্ডের ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা হওয়া ৩২.৯১ লাখ টাকার মধ্যে ৮.৭৫ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করা হয় এবং ১৬.৮৬ কোটি টাকা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লি. বরাবর পে-অর্ডার করা হয়। বাকি ২৩% টাকা বিভিন্ন একাউন্টে ট্রান্সফার এবং ড. মোশাররফের নিজের নামে ৬টি এফডিআর/টিডিআর করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বিএফআইইউ ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশনে এ বিষয়ে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। দুদকে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে ড. মোশাররফের পেশা, অর্থের উৎস ও হিসাব খোলার উদ্দেশ্যের সাথে লেনদেনের ব্যাপক অসামঞ্জস্যতা রয়েছে এবং এ সকল লেনদেনের সাথে ঘুষ ও দুর্নীতির সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।  

একইসঙ্গে প্রতিবেদনটিতে, ব্যাংক হিসাবে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ লেনদেন, প্রভিডেন্ট/গ্রাচুইটি ফান্ড হিসাবে লেনদেনের মাধ্যমে কর ফাঁকির প্রয়াস গ্রহণ এবং বেনামে ৫০ লাখ টাকার এফডিআর খোলার সময় অর্থের উৎস গোপন, ছদ্মাবৃত্ত বা আড়াল করা এবং এক্ষেত্রে তিনজন ব্যাংক কর্মকর্তার সহায়তা বা পরামর্শ প্রদানের বিষয়ে অনুসন্ধান/তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা পূর্বক প্রযোজ্যক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর আওতায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে বিএফআইইউ।

উল্লেখ্য, দু’টি কোম্পানির পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় তথ্য গোপন করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন-২০১০ এর ৭(৩)(খ) ধারার লঙ্ঘন করে ড. এম মোশাররফ হোসেন চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন। এমতাবস্থায় তার পদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত ২৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট করেন বিনিয়োগকারী আবু সালেহ মোহাম্মদ আমিন মেহেদী।

ড. এম মোশাররফ হোসেন ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

এর আগে ২০১৭ সালের ৯ মে তিনি যৌথমূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে ‘লাভস এন্ড লাইভ অর্গানিক লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানির নিবন্ধন নেন বলে রিট আবেদনে বলা হয়। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি নিজে এবং পরিচালক তার স্ত্রী জান্নাতুল মাওয়া।

এরপর ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ‘গুলশান ভ্যালি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামে আরেকটি কোম্পানির নিবন্ধন নেন ড. এম মোশাররফ হোসেন। তার মালিকানাধীন এই কোম্পানি দু’টির নামে দু’টি করে মোট চারটি এমপ্লয়িজ গ্র্যাচুইটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠন করেন।

এই রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ৯ নভেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের আবেদন নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেন। পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে দুদক ও এফআইইউ’কে জানাতে বলেন আদালত।

একইসঙ্গে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান/তদন্তে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন আইনগত কর্তৃত্ব-বর্হিভূত হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, দুদক, এনবিআর’র চেয়ারম্যান, বিএফআইইউ’র নির্বাহী পরিচালক ও শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

পরবর্তীতে ২৬ সেপ্টেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটকে প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেধে দেয় আদলত।