ঋণ করে চলছেন বীমা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

তাফহিমুল ইসলাম সুজন: যাপিত জীবনের জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির সাথে খাপ খাওয়াতে হিমশিম খাচ্ছেন বীমা কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর কারণ, যে হারে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে সে হারে বেতন-ভাতা বাবদ আয়ের ওপর নির্ভরশীল বীমা কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয় বাড়েনি। ফলে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য  ঋণ করতে হচ্ছে তাদের।

অনেকেই আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখতে যাপিত জীবনে পরিবর্তন আনছেন। পরিবর্তন এসেছে তাদের খাবারের তালিকায়। প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমন মাছ বা মাংস খাওয়াও কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধিতে বীমা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবনযাত্রায় যে প্রভাব ফেলেছে তা উঠে এসেছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি'র প্রতিবেদনে।

প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধিতে জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি নানা প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়তই গবেষণা করে যাচ্ছে।

তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক কৃষি বিভাগ ইউএসডিএ প্রকাশিত গ্রেইন এন্ড ফিড আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে খুচরা বাজারে সাধারণ মানের (মোটা চাল) প্রতি কেজি চালের গড় মূল্য ছিল ৩২ টাকার কিছু বেশি। সেই চালের মূল্য চলতি বছরে হয়েছে ৪৭ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে মোটা চালের মূল্য বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ।

আর বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (বিআইজিডি) তথ্য মতে, দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে শহরে বসবাসরত মানুষের আয় কমেছে ৮ শতাংশ, গ্রামে তা ৩ শতাংশ।

প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা বলছে, নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে, নিম্নমানের পণ্য কিনছে বা একেবারে বাদ দিয়েছে। ২৭ শতাংশ পরিবার কম পরিমাণ চাল কিনছে। আগের চেয়ে নিম্নমানের চাল কিনছে ৩৬ শতাংশ পরিবার। তবে পুষ্টির জন্য দরকারি মাছ, মাংস, দুধ কম কেনা বা একেবারে বাদ দিয়েছে অনেক পরিবার। অন্তত একবেলা কম খেয়েছে, এমন পরিবারের সংখ্যা শহরে ২১ শতাংশ এবং গ্রামে ১৩ শতাংশ।

বাজারে সব ধরনের পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় শাক-সবজি খেয়ে দিন পার করছেন বীমা কোম্পানির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। আগে যেখানে মাসে সংসারের সব খরচ ১৪ থেকে ১৭ হাজার টাকায় হয়ে যেত, এখন তা ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর ফলে খরচ কমাতে অনেকে শাক-সবজির ওপর নির্ভরশীল হচ্ছেন।

বেসরকারি লাইফ বীমা কোম্পানিতে জুনিয়র অডিট অফিসার হিসেবে কর্মরত রায়হান ইসলাম ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। দুই জনের সংসারে মাসেও মাংস খাওয়া হয় না তাদের। রায়হান ইসলাম বলেন, এতো টাকা দিয়ে মাংস খাবো কি করে! বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদির খরচ মেটাতেই আমাদের মাসে ১২ হাজার টাকা শেষ হয়ে যায়। আর খাওয়ার টাকা প্রতি মাসে বাসা থেকে আনতে হচ্ছে বা কারো কাছে ধার বা ঋণ নিয়ে চলতে হচ্ছে।

রায়হান ইসলাম আরো বলেন, গরুর মাংসের বদলে হয়তো মাসে একদিন ছোট একটি মুরগি নিয়ে আসি। এছাড়া প্রতিদিন শাক-সবজি বা ভর্তা খেয়ে থাকতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে আমরা পুষ্টিহীনতায় ভুগতে পারি।

একই কথা বলছিলেন অপর একটি বীমা কোম্পানিতে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি করা নাহিদ হাসান কপল। তিনি বলেন, আগে মাসে চার-পাঁচ দিন মাংস খাওয়া হতো। এখন একদিনও খেতে পারি না। মুরগি খেতে হয়, তারও দাম বেশি।

তিনি আরো বলেন, তিন-চার মাস আগেও নিয়মিতভাবে বাসায় টাকা পাঠাতাম। আর এখন উল্টো বাসা থেকে অথবা কারো কাছে ঋণ করে নিয়ে আসতে হচ্ছে।

ব্যয় বাড়ে, বেতন বাড়ে না

দেশের বীমা খাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ২০১৮ সালের এক হিসাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ধরা হয়েছে ৭ লাখের বেশি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বীমা কোম্পানিগুলোর কর্মী ও কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা দেয়া হয় দু’ভাবে। মাঠ পর্যায়ে উন্নয়ন কর্মী হিসেবে যারা কাজ করেন তাদেকে দেয়া হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেধে দেয়া হারে কমিশন। তবে প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেয়া হয় মাসিক ভিত্তিতে, কোম্পানির নির্ধারিত বেতন কাঠামোয়।

রায়হান ইসলাম বলেন, সব কিছুর মূল্য বাড়ছে কিন্তু বেতন বাড়ছে না। বেতন না বাড়ায় রোজার ঈদের পর থেকে আর কুলাতে পারছি না। এখন প্রতিমাসে বাসা থেকে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা নিয়ে আসতে হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, অনেক পুরনো কর্মচারী চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। অফিস থেকে বলা হচ্ছে, এই বেতনে চাকরি করলে করেন, না করলে চলে যান; কত জন আছে এই বেতনে কাজ করার।

কোম্পানি ও নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বীমা কর্মকর্তা বলেন, কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম আয় ঠিকই বাড়ে কিন্তু আমরা যারা স্থায়ী কর্মকর্তা বা কর্মচারী আছি তাদের বেতন-ভাতা বাড়ে না। আর বাড়ানো কথা বললেও মনে হয় আকাশের চাঁদ চেয়েছি তাদের কাছে।

সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুর রাহমান বলেন, সব কিছুর মূল্য বৃদ্ধিতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। শুধু আমি না, আমার অধিনস্তরা আরো বেশি কষ্ট করছে। বর্তমানে যে অবস্থা চলছে তা একইভাবে চলতে থাকলে এলসির খরচ বেড়ে যাবে। তখন কেউ এলসি করতে চাইবে না। ফলে এলসি না করলে ইন্স্যুরেন্স সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তিনি আরো বলেন, এই অবস্থায় থেকে সংসারের আর কি চিন্তা করবো। বউ-বাচ্চা মারা যাবে, না হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যেতে হবে। কিছুই করার নেই।

তিনি বলেন, আমাদের সরকারের সচেতন হওয়া উচিত। সবকিছুর দিকে নজর রাখা উচিত। এই সেক্টর অনেক কষ্ট করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুসংগঠিত করেছেন। ৪০ বছর থেকে কেউ নজর দেয়নি এই সেক্টরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নজর দিয়েছেন। খুব তাড়াতাড়ি এই সমস্যা সামাধান হবে। তবে আমরা সাহস করে আমাদের এই নাজুক পরিস্থিতির কথা মালিকদের কাছে তুলে ধরতে পারি না। যার কারণে আমাদের পরিস্থিতিরও কোন পরিবর্তন আসছে না।

নাহিদ হাসান কপল আরো বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেভাবে আমাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পায়নি। অন্য কোন কোম্পানির কথা বলতে পারছি না, তবে আমাদের কোম্পানিতে বছর শেষে বেতন কিছুটা বৃদ্ধি পায়।

তিনি বলেন, বছর শেষে যেখানে বেতন বেড়েছে ৭ শতাংশ সেখানে অন্য সব কিছুর মূল্য বেড়েছে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ। তাহলে এই বেতন দিয়ে আমরা কিভাবে চলি। এই জন্য আমাদেরকে ঋণ করতে হচ্ছে বা বাসা থেকে টাকা আনতে হচ্ছে।

বেড়েছে বীমা কোম্পানিগুলোর আয়

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, দেশে সরকারি-বেসরকারি লাইফ ও নন-লাইফ বীমা খাতে ব্যবসা করছে ৮১টি কোম্পানি। ২০২১ সালে এসব কোম্পানির মোট আয় বেড়েছে ৮.৪৫ শতাংশ বা ১ হাজার ১২১ কোটি টাকা। আয় বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে বীমা খাতের সম্পদ। ২০২১ সালে এ খাতের মোট সম্পদ বেড়েছে ৬.০৫ শতাংশ বা ৩ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালে দেশের বীমা খাতের মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা।

১১টি লাইফ বীমা কোম্পানির বার্ষিক অর্থিক প্রতিবেদ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, ২০১৯ সালের থেকে ২০২০ সালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় কমেছে ৫.৩১ শতাংশ। আর নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ১৩টি বীমা কোম্পানির ২০২০ সালে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় কমেছে ২.৩৬ শতাংশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, করোনা মহামারির সময় অনেক কোম্পানি তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাঁটাইয়ের কারণে সে সময় তাদের বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় কমেছিল। আবার অনেক কোম্পানি এই সসময় তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ করে নাই।

কি ভাবছেন বীমা মালিকেরা

বীমা কোম্পানির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে ব্যবস্থাপনা বিভাগ। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত আসে কোম্পানির মালিক বা পরিচালকদের কাছ থেকে। বীমা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কাঠামো কি হবে, কার কত টাকা বেতন বাড়বে-তার সবই বীমা মালিকদের কাছ থেকে নির্ধারণ হয়।

বীমা কোম্পানিগুলোর মালিকরা বলছেন, আয়-ব্যয়ের হিসাব কষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বেতন বাড়াবো কিনা বা কতটু বাড়বে। আবার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় হলে তা অবৈধ হবে, সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হয় কোম্পানিগুলোকে। তা না হলে এর প্রভাব পড়বে কোম্পানির ফান্ডে।

বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ)’র প্রথম ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্সে ভাইস-চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ (পাভেল) বলেন, সব বীমা কোম্পানির মালিকদের সাথে এই বিষয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে। তাদেরকে আমরা আবারো বলবো, তারা যেন মিনিমাম একটা বেতন কাঠামো করে; যাতে করে তারা (কর্মকর্তা-কর্মচারীরা) সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারে।

নাসির উদ্দিন আহমেদ (পাভেল) আরো বলেন, এটা শুধু মালিকদের একার বিষয় না, এটা ম্যানেজমেন্টেরও ইসু। বীমা কোম্পানির আয়-ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই বেতন-কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে। ব্যবস্থাপনা ব্যয় তো বাড়ানো যাবে না। লাইফ বীমায় ব্যয় বাড়িয়ে দিলে লাইফ ফান্ডে এর প্রভাব পড়বে।