ড. মোশাররফের শেয়ার ব্যবসা অনভিপ্রেত: আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদন

নিজস্ব প্রতিবেদক: বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে ড. এম মোশাররফ হোসেনের শেয়ার ব্যবসাকে অনভিপ্রেত বলে মন্তব্য করেছে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তদন্ত কমিটি। একইসঙ্গে তার ব্যবসায়িক আচরণ আরো বেশি পরিশীলিত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক হওয়া উচিত ছিল বলেও মন্তব্য করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে কমিটি। হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক গত ১৩ জুন এই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে তদন্ত কমিটির সার্বিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বীমা খাতের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এর ন্যায় উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন একটি পদে আসীন হয়ে ড. এম মোশাররফ হোসেনের ব্যবসায়িক আচরণ আরো বেশি পরিশীলিত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক হওয়া উচিত ছিল মর্মে তদন্ত কমিটি মনে করে।

এ ছাড়াও সরাসরি না হলেও লাভস এন্ড লাইভস অর্গানিকস লি. এবং গুলশান ভ্যালি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লি. নামীয় কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হিসেবে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন তার অধিক্ষেত্রাধীন বীমা কোম্পানিতে শেয়ার ক্রয়ে বিনিয়োগ অনভিপ্রেত মর্মে তদন্ত কমিটি মনে করে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তিন সদস্যের এই তদন্ত কমিটির আহবায়ক ছিলেন অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. হারুন অর রশিদ মোল্লা।  সদস্যরা হলেন- আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্মসচিব মৃত্যুঞ্জয় সাহা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান।

তদন্তে বিবেচ্য বিষয়ে কমিটির মতামতে বলা হয়েছে, ড. এম মোশাররফ হোসেন ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল লাভস এন্ড লাইভস অর্গানিকস লি. এবং গুলশান ভ্যালি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং তা কোম্পানিতে গৃহীত হয়। কিন্তু পদত্যাগপত্র পরিচালনা বোর্ডে আলোচনা করে আরজেএসসিতে প্রেরণ করা হয়নি।

এক্ষেত্রে আইনি সুবিধা নেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠান দু’টিতে দাখিলকৃত পদত্যাগপত্র দু’টি পরবর্তীতে কোন সময় সম্পাদন করেছেন কিনা তা সিআইডি বা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অন্য কোন সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করে নিরূপন করা যেতে পারে বলে মনে করছে তদন্ত কমিটি।

এ ছাড়াও উল্লেখিত প্রতিটি কোম্পানির নামে দুটি করে মোট ৪টি তহবিল গঠন করে ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন ড. এম মোশাররফ হোসেন এবং সদস্য ছিলেন আলমগীর হোসেন ও লাভলী ইয়াসমিন, সচিব ছিলেন জান্নাতুল মাওয়া এবং ট্রেজারার ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন।  পরবর্তী সময় অর্থাৎ ৫ এপ্রিল ২০২২ থেকে অদ্যবধি বর্ণিত ৪টি ফান্ডের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন জান্নাতুল মাওয়া।

ড. এম মোশাররফ হোসেন আইডিআরএ’র সদস্য থাকাকালে ৪ এপ্রিল ২০১৮ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত লাভস এন্ড লাইভস অর্গানিকস লি. এর একটি ফান্ড, ফান্ডের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান থাকাকালে লাভস এন্ড লাইভস অর্গানিকস লি. ও গুলশান ভ্যালি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লি. এর দু’টি করে ৪টি ফান্ড, ফান্ডের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স, সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স নামের বীমা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন।

তদন্তে বিবেচ্য বিষয়ে কমিটির মতামতে আরো বলা হয়েছে, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান থাকাকালীন লাভস এন্ড লাইভস অর্গানিকস লি. এর শেয়ারহোল্ডার ছিলেন এবং উক্ত সময় লাভস এন্ড লাইভস অর্গানিকস লি. এবং পিএলআই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লি. এর প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ারহোল্ডার থাকা অবস্থায় ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড নামীয় বীমা কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করেছেন।

উল্লেখ্য, দু’টি কোম্পানির পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় তথ্য গোপন করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন-২০১০ এর ৭(৩)(খ) ধারার লঙ্ঘন করে ড. এম মোশাররফ হোসেন চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন। এমতাবস্থায় তার পদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত ২৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট করেন বিনিয়োগকারী আবু সালেহ মোহাম্মদ আমিন মেহেদী।

এই রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ৯ নভেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের আবেদন নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেন। পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে দুদক ও এফআইইউ’কে জানাতে বলেন আদালত।

একইসঙ্গে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান/তদন্তে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন আইনগত কর্তৃত্ব-বর্হিভূত হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, দুদক, এনবিআর’র চেয়ারম্যান, বিএফআইইউ’র নির্বাহী পরিচালক ও শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

পরবর্তীতে ২৬ সেপ্টেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটকে প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেধে দেয় আদলত।  সবশেষ গত ২৬ মে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. এজারুল হক আকন্দের দ্বৈত বেঞ্চে প্রতিবেদন দাখিল করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ।

আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আইডিআরএ চেয়ারম্যান (সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন) ড. এম মোশাররফ হোসেন ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক একাউন্টে ৪ বছরে জমা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। জমা করা এই টাকার সাথে ড. মোশাররফের পেশা, অর্থের উৎস ও হিসাব খোলার উদ্দেশ্যের সাথে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। একইসাথে এসব লেনদেনে ঘুষ ও দুর্নীতির সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।

আর্থিক অনিয়ম, ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানান অভিযোগ মাথায় নিয়ে গত ১৪ জুন পদত্যাগ করেন দেশের বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ড. এম মোশাররফ হোসেন এফসিএ’র মোবাইল ফোনে (নং- ০১৭১৪০৪৮০১২) যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যকোন মাধ্যমেও তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।