ছাড়পত্র দাখিল না করেও পাইওনিয়ারের মুখ্য নির্বাহী পদে সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান
আবদুর রহমান আবির: ৩ মাসের মধ্যে ছাড়পত্র দিতে না পারলে নিয়োগ অনুমোদন বাতিল হবে। এমন শর্তে সৈয়দ শাহরিয়ার আহসানকে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ অনুমোদন করে আইডিআরএ। তবে বেধে দেয়া সময়ের মধ্যে ছাড়পত্র দিতে না পারায় সৈয়দ শাহরিয়ারের নিয়োগ বাতিল করেনি বীমা খাতের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। শাহরিয়ার আহসানের নিয়োগ অনুমোদন করা হয় গত বছরের ২৫ অক্টোবর।
সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান এর আগে রাষ্ট্রায়ত্ব বীমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে ছিলেন। শাহরিয়ার আহসানকে সাধারণ বীমা করপোরেশনের এমডি পদে নিয়োগ প্রদান করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
সাধারণ বীমা করপোরেশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার, আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে শাহরিয়ার আহসানকে ছাড়পত্র দেয়নি সাধারণ বীমা করপোরেশন। অপরদিকে আইডিআরএ’র তদেন্তও শাহরিয়ার আহসানের দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। এসব দুর্নীতির বিষয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে আইডিআরএ। এসব জেনে-শুনে ছাড়পত্র ছাড়া শাহরিয়ার আহসানকে নিয়োগ অনুমোদন করায় আইডিআরএ’র কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তবে শাহরিয়ার আহসানের ছাড়পত্র দাখিল করতে না পেরে গত ১৬ অক্টোবর এক চিঠিতে বেশ কিছু নথিপত্র দাখিল করেন পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী (সিসি) এস এম মিযানুর রহমান। একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন এসব নথিপত্র ছাড়পত্রের সামিল। পরে ২২ নভেম্বর অপর এক চিঠিতে ৮টি বিষয়ে নথিপত্র দাখিল করে তা ছাড়পত্রের সামিল বলে দাবি করেন সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান। এসব নথিপত্রের মধ্যে রয়েছে-
২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩য় দফায় দেয়া নিয়োগপত্রের কপি; দায়িত্ব হস্তান্তরের বিষয়ে নির্দেশ চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে দেয়া চিঠি; করপোরেশনের জিএমকে অতিরিক্ত হিসেবে এমডি’র দায়িত্ব পালনে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অফিস আদেশ; এমডি বাংলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল পরিশোধের প্রত্যয়নপত্র; এমডি বাংলো হস্তান্তরের পত্র; এমডি বাংলোর বুঝে নেয়া মালামালের তালিকা; এমডি বাংলোর ভাড়া বকেয়া না থাকার প্রত্যয়নপত্র এবং করপোরেশনের জিএম’র নিকট এমডি’র দায়িত্ব হস্তান্তরের পত্র।
চুক্তি ভেঙ্গে দ্বিগুণের বেশি বেতন নির্ধারণ
সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান সাধারণ বীমা করপোরেশনের এমডি পদে নিয়োগ পান ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় ৭৮ হাজার টাকা। এই চুক্তি করা হয় ৩ বছরের জন্য অর্থাৎ ২০১৯ সালে ৭ সেপ্টম্বর পর্যন্ত।
কিন্ত চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এক বছর আট মাসের মাথায় এসে শাহরিয়ার আহসানের বেতন-ভাতা ৭৮ হাজার টাকার পরিবর্তে করা হয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এই বেতন তিনি পাবেন যোগদানের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ থেকেই। একই সাথে এই হিসেবে প্রাপ্য বকেয়া পরিশোধেরও নির্দেশ দেয়া হয়।
শাহরিয়ার আহসানের নতুন হারে বেতন দেয়ার এসব সিদ্ধান্ত হয় সাধরাণ বীমা করপোরেশনের ৫৮১তম সভায়। সভার ২০.১ নং আলোচ্য সূচির আলোকে। তবে বেতন বাড়ানোর বিষয়টি ব্যতিক্রম হিসেবে উল্লেখ করা হয় সভার কার্য বিবরণীতে।
সাধারণ বীমা করপোরেশনে শাহরিয়ার আহসান নিয়োগ পান ৩ দফায়। এর মধ্যে প্রথম নিয়োগ পান ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। এই নিয়োগ দেয়া হয় ৩ বছরের জন্য। এই চুক্তি অনুসারেই পরে ২ দফায় আরো ৩ বছরের জন্য নিয়োগ পান শাহারিয়ার আহসান।
চুক্তিতে শাহরিয়ার আহসানের বেতন ধরা হয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া বেতনের অর্ধেক অর্থাৎ ৯০ হাজার টাকা। অথচ সাধারণ বীমা করপোরেশন অর্ধেক বাড়িভাড়ার এ সিদ্ধান্তও পরিবর্তন করে বাড়িভাড়া নির্ধারণ করেন ৪০ হাজার টাকা। এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় করপোরেশনের ৫৮১তম সভায়। ওই সভার ১৭.৬ নং আলোচ্য সূচির আলোকে।
শুধু সরকারি চাকরি বিধিমালা না মেনে শাহরিয়ার আহসানের বেতন-ভাতা বাড়ানো বা বাড়ি ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তাই নয়। শাহরিয়ারকে থাকার জন্য বিলাসবহুল বাংলো বরাদ্দ দেয়া হয় রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত গুলশানে। গুলশানের ডুপ্লেক্স এই বাড়িতে রয়েছে সিলিং ফ্যান ১০টি, ৫টি গীজার, ১৭টি লাইট সেট, ৫টি বেসিন, ৫টি কমোড ছাড়াও অত্যাধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা।
শাহরিয়ার আহসানের বসবাসের জন্য গুলশানে এমডি বাংলোর ডুপ্লেক্স বাড়িটি মেরামত ও আধুনিকায়ন করতে ব্যয় করা হয় ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হয় কার্যাদেশ দিয়ে। বাকি টাকা পর্যায়ে ক্রমে ব্যয় করা হয়। এক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় নীতিমালাও অনুসরণ করা হয় নাই। এই ব্যয় করা হয ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে।
আইডিআরএ’র তদন্তে যেসব দুর্নীতির সত্যতা মেলে:
২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে প্রতিবেদন দাখিল করে আইডিআরএ। ওই প্রতিবেদনে শাহরিয়ার আহসানের বিরুদ্ধে প্রমাণিত দুর্নীতিগুলো হলো- ঢাকাস্থ গুলশান-১ এ অবস্থিত এসবিসি’র দখলীয় দ্বিতল বাড়িটি টেন্ডার না করে নিজ ক্ষমতার মধ্যে বারবার আরএফকিউ এর মাধ্যমে সাড়ে ৬১ লাখ টাকা ব্যয়, যা বিধি ও ক্ষমতা বহির্ভূত; সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া বাড়িতে বসবাস করেও ৯০ হাজার টাকা বেতনের মধ্যে ৪০ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া গ্রহণ; বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অন্যায়ভাবে বদলি করণ;
পুনর্বীমা প্রিমিয়ামের বকেয়া প্রায় ১১৮০ কোটি টাকা, পুনর্বীমার অর্থ ব্যয়ে অনিয়ম এবং পুনর্বীমা বিভাগ ও পুনর্বীমা হিসাব বিভাগ একজন ডিজিএম’র মাধ্যমে পরিচালনা করে অনিয়ম-দুর্নীতির আড়াল করা; সরকারি নিয়োগ বিধি লঙ্ঘন করে সিলেকশন কমিটির সুপারিশ ছাড়াই গাড়ি চালক পদে নিয়োগ এবং সরকারি অনুমোদন বিহীন ও মামলা থাকা অবস্থায় চারজন লিফটম্যান নিয়োগ;
সরকারি আর্থিক নীতি উপেক্ষা করে এসবিসি’র তহবিল বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখা; নিয়ম ভেঙ্গে নিজের জন্য কোটি টাকার জিপ গাড়ি ক্রয়; চুক্তি ছাড়াই ভাড়াটিয়া প্রতিষ্ঠানের জন্য সংস্কার কাজে ৫০ লাখ টাকা ব্যয়; এসআরও’র নির্দেশনা অমান্য করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অগ্রিম ঋণ অনুমোদন এবং আয়কর উপদেষ্টা নিয়োগের নামে বেতন ভাগ-বাটোয়ারা।
আইডিআরএ’র তদন্ত দলের সুপারিশ:
উল্লেখিত অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাওয়ায় সাধারণ বীমা করপোরেশনের এমডি সৈয়দ শাহরিয়ার আহসানসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে তদন্ত দল। একইসাথে এসব দুর্নীতির ফলে কি পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপনে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করে আইডিআরএ’র তদন্ত দল।
পরবর্তীতে তদন্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে আর্থিক সংশ্লিষ্ট ৮টি অভিযোগ তদন্তে ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস ‘একনাবিন’কে বিশেষ নিরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ করে আইডিআরএ। একইসঙ্গে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিলের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে এক মাস সময় বেধে দেয়া হয়। তবে এ বিষয়ে পরবর্তীতে আর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে- এমন কোন তথ্য জানা যায়নি।
এ বিষয়ে সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান বলেন, আইডিআরএ আমার পূর্বের কর্মস্থলের ছাড়পত্র চেয়েছিল; নিয়োগ অনুমোদনের পত্রে সেই শর্ত দেয়া হয়েছিল। সেই প্রেক্ষিতে আমি কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্র দাখিল করেছি।
তিনি বলেন, পূর্বের কর্মস্থলের দায়িত্ব হস্তান্তরের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চাওয়া, নতুন কাউকে দায়িত্ব দেয়া, দেনা-পাওনা পরিশোধ করা, বাসা হস্তান্তরসহ যেসব কারণে ছাড়পত্র দারকার হয়, তার সব কাগজপত্র আমি নিয়ন্ত্রক সংস্থায় দাখিল করেছি।
সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান বলেন, এসবিসি’তে আমার কোন দেনা-পাওনা নেই; আমার কাছে যেসব জিনিস ছিল তার সবই আমি বুঝিয়ে দিয়েছি। চাকরি ছাড়ার জন্য সরকারকে আমি দু’মাস আগেই নোটিশ দিয়েছি; একইভাবে আইডিআরএ’কেও আমি নোটিশ করেছি।
তিনি আরো বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে আমি আমার দায়িত্ব হস্তান্তর করেছি। সুতরাং আলাদাভাবে আমার কোন ছাড়পত্রের প্রয়োজন নেই। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সাথে এ বিষয়ে আমার কথা হয়েছে, আমার শর্ত পূরণে এগুলো যথেষ্ট বলে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক ও মুখপাত্র (উপসচিব) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান ছাড়পত্র দিয়েছে কিনা সেটা আমার জানা নেই, খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। তবে ছাড়পত্র না দিয়ে থাকলে দিয়ে দেবে; এটা তো তার নিয়োগের শর্ত।
ছাড়পত্র না দিলে অনুমোদন বাতিল করা হবে কিনা এমন প্রশ্নে আইডিআরএ’র মুখপাত্র বলেন, সেটা নিয়ে কর্তৃপক্ষ ভাববে এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান তো ছাড়পত্র দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ; এটা তাকে দিতেই হবে।
ছাড়পত্র না দিয়ে আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাগজপত্র দিলে সেটা ছাড়পত্রের শর্ত পূরণ করবে কিনা এমন প্রশ্নে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সেটা হওয়ার কথা নয়। তবে আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত না।