শহিদুল ইসলামের বিএ-এমএ সনদের বৈধতা নেই

আবদুর রহমান আবির: বর্তমান সময়ে বীমা খাতে বেশ আলোচিত নাম শহিদুল ইসলাম। যিনি কোন বীমা কোম্পানিতেই পূর্ণাঙ্গ মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি; কিন্তু একাধিক বীমা কোম্পানিতে মুখ্য নির্বাহীর চলতি দায়িত্ব পালন করেছেন। 

শহিদুল ইসলাম বীমা খাতে আলোচনায় উঠে এসেছেন মূলত তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের কারণে। বীমা কোম্পানিতে মুখ্য নির্বাহী পদে চাকরি নিতে তিনি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের অননুমোদিত ক্যাম্পাস মিরপুর-১০ থেকে ইস্যুকৃত বিএ ও এমএ পাসের দু’টি সনদ দাখিল করেন।

সনদ দু’টির তথ্য অনুসারে, তিনি ২০১০ সালে সিজিপিএ ৩.৫১ নিয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস (বিএ) এবং ২০১১ সালে সিজিপিএ ৩.৫৪ নিয়ে একই বিষয়ে মাস্টার্স অব আর্টস (এমএ) ডিগ্রি অর্জন করেছেন।  

তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ধানমন্ডি ক্যাম্পাস থেকে ইস্যুকৃত এ সম্পর্কিত বিভিন্ন চিঠি এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে দেখা গেছে শহিদুল ইসলামের বিএ এবং এমএ সনদের কোন বৈধতা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলছে- দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের মিরপুর ক্যাম্পাসের কোন বৈধতা নেই। আবার সাময়িক অনুমোদন পাওয়া দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র বৈধ ক্যাম্পাস ধানমন্ডি থেকেও বলা হয়েছে- শহিদুল ইসলামের সনদ দু’টি ধানমন্ডি ক্যাম্পাস থেকে ইস্যু করা হয়নি।

শহিদুল ইসলামের শিক্ষা সনদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ২০২১ সালে। ওই বছরের ২৭ মার্চ ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’তে ‘বেস্ট লাইফের নতুন সিইও শহিদুল ইসলামের শিক্ষা সনদ ২টি দারুল ইহসানের ধানমন্ডি থেকে ইস্যুকৃত নয়’ শিরোনামের সংবাদ প্রকাশিত হয়।

সে সময় তিনি দাবি করেন তার বিএ ও এমএ পাসের সনদ দু’টি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ধানমন্ডি ক্যাম্পাস নয়, মিরপুর ক্যাম্পাস থেকে ইস্যু করা হয়েছে। শহিদুল ইসলাম এখনো একই দাবি করছেন।

শহিদুল ইসলামের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ যাচাইয়ের জন্য ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেয় সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ। সে সময় শহিদুল ইসলাম বীমা কোম্পানিটিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব পালন করছিলেন।

সানলাইফের ওই চিঠির ৪দিন পর ৩১ আগস্ট জবাব দেয় বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষ। দারুল ইহসান ট্রাস্টের প্যাডে সনদ দু’টির বিষয়ে পাঠানো মতামতটি ছিল- “সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর উল্লেখিত প্রোগ্রামের সনদপত্র দু’টি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ী নং ২১, রোড-৯/এ, ধানমন্ডি আ/এ, ঢাকা-১২০৯ থেকে ইস্যু করা হয়নি”।

দারুল ইহসানের চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, মো. শহিদুল ইসলামের সনদপত্র দু’টি বিশ্বিবদ্যালয়ের সংরক্ষিত রেকর্ডের সাথে যাচাই করে মতামত প্রদান করা হয়েছে। ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন দারুল ইহসান ট্রাস্টের সচিব, তবে সেখানে তার নাম উল্লেখ করা হয়নি।

দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমন অভিমত আসার কিছুদিন পরেই সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চাকরি ছেড়ে বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সে যোগদান করেন শহিদুল ইসলাম। সেখানেও তিনি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব পালন করেন। 

শহিদুল ইসলাম কোম্পানিটিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব পালনকালে ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট বেস্ট লাইফ কর্তৃপক্ষ দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের মিরপুর ক্যাম্পাসের বৈধতা জানতে চেয়ে ইউজিসিকে চিঠি দেয়। তার প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি ইউজিসি থেকে বেস্ট লাইফকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়-

“‌‌দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৯৩ সালের ২৯ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। বন্ধকৃত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়টির সাময়িক অনুমতি পত্রে উল্লিখিত ঠিকানা ছিল বাড়ী নং-২১ (নতুন), রোড নং- ৯/এ, ধানমন্ডি আ/এ, ঢাকা- ১২০৯। উক্ত ঠিকানার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়টির কমিশন অনুমোদিত আর কোন বৈধ ক্যাম্পাস ছিল না”।

ইউজিসির ওই চিঠিতে আরো বলা হয়, “বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২০১০ সালের পর হতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি তথা আচার্য কর্তৃক নিযুক্ত ভাইস-চ্যান্সেলর না থাকায় উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ আইনের ২৯(১) ধারায় বর্ণিত বৈধ কোন কর্মকর্তা/কর্তৃপক্ষ নেই। আইনের মৌলিক প্রিন্সিপাল অনুযায়ী অবৈধ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গৃহীত ও সম্পাদিত কার্যক্রম শুরু থেকে নাল এন্ড ভয়েড অর্থাৎ বাতিল হিসেবে গণ্য হবে”।

এর আগে ২০২১ সালের ৩০ জুন বেস্ট লাইফ থেকে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে শহিদুল ইসলামের সনদ দু’টির সত্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে চিঠি পাঠানো হয়। এ প্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৫ জুলাই দারুল ইহসান ট্রাস্টের প্যাডে সনদ ২টির বিষয়ে মতামত পাঠানো হয়।

মতামতটি ছিল- “সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর উল্লেখিত প্রোগ্রামের সনদপত্র দুটি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ী নং ২১, রোড-৯/এ, ধানমন্ডি আ/এ, ঢাকা-১২০৯ থেকে ইস্যু করা হয়নি”।

চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, মো. শহিদুল ইসলামের সনদপত্র দু’টি বিশ্বিবদ্যালয়ের সংরক্ষিত রেকর্ডের সাথে যাচাই করে মতামত প্রদান করা হয়েছে। ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন দারুল ইহসান ট্রাস্টের সচিব, তবে সেখানে তার নাম উল্লেখ করা হয়নি।

এ প্রেক্ষিতে দারুল ইহসান ট্রাস্টের প্যাডে পাঠানো চিঠির সত্যতা যাচাই করতে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পক্ষ থেকে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে যোগাযোগ করা হয়। চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল দারুল ইহসান ট্রাস্টের সচিবের দায়িত্বপালনকারী মো. মাহবুব উল আলম ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, শহিদুল ইসলামের বিএ এবং এমএ শিক্ষাগত সনদের বিষয়ে ২০২১ সালের ১৫ জুলাই বেস্ট লাইফকে দেয়া চিঠিটি এখান (দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ধানমন্ডি ক্যাম্পাস) থেকে ইস্যু করা হয়েছে।

সানলাইফ ও বেস্ট লাইফের পাশাপাশি একই শিক্ষাগত সনদ দিয়েই শহিদুল ইসলাম চার্টাড লাইফেও মুখ্য নির্বাহীর চলতি দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সনদ দু’টির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও অদৃশ্য কারণে কোন ব্যবস্থা নেয়নি বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।

সর্বশেষ ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদের ২৫৫তম সভায় শহিদুল ইসলামকে কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চলতি বছরের ২ এপ্রিল এই নিয়োগ অনুমোদনের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থায় আবেদন জানান কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার।

ডেল্টা লাইফের মুখ্য নির্বাহী পদে শহিদুল ইসলামের নিয়োগ অনুমোদন পেতে অপর একটি আবেদনে সরকারের একজন মন্ত্রীর সুপারিশ নেয়া হয়। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা সুপারিশ সংশ্লিষ্ট আবেদনপত্রটি ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র হাতে এসেছে।

ওই আবেদনপত্রে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানের নামের একটি সিল ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেখানে হাতে লেখা হয়েছে- “বিহিত বিবেচনা ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জোর সুপারিশ করছি”। এতে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ৯ এপ্রিল ২০২৩।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পক্ষ থেকে শহিদুল ইসলামের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি অসুস্থ থাকায় কথা বলতে পারছেন না বলে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।

ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, মুখ্য নির্বাহী নিয়োগের জন্য আমরা সুইটেবল কাউকে পাইনি। তুলনামূলকভাবে শহিদুল ইসলামকে যোগ্য মনে হয়েছে। আমরা তাকে নিয়োগ দিয়েছি এবং সেই নিয়োগ অনুমোদনের জন্য আইডিআরএ’র কাছে আবেদন পাঠিয়েছি। এখন আইডিআরএ যাচাই-বাছাই করে যদি তাকে উপযুক্ত মনে করে তাহলে অনুমোদন দেবে; না হলে নতুন কাউকে আমাদের খুঁজে নিতে হবে।

দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক অনুমোদনপ্রাপ্ত ধানমন্ডি ক্যাম্পাস থেকে শহিদুল ইসলামের সনদপত্র দু’টি ইস্যু না করা এবং ইউজিসি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির মিরপুর ক্যাম্পাসকে অবৈধ ঘোষণা করাসহ বেস্ট লাইফে মুখ্য নির্বাহীর দায়িত্ব পালনকালে তার শিক্ষা সনদের বৈধতা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রশ্ন তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে হাফিজ আহমেদ মজুমদার বলেন, এমন কোন বিষয় আমার জানা নেই।

তিনি বলেন, আমরা শহিদুল ইসলামের শিক্ষা সনদ যাচাই করে দেখিনি। তবে তার কর্ম অভিজ্ঞতার বিষয়ে আমরা খোঁজ-খবর নিয়েছি। তিনি যেসব কাগজপত্র আমাদের কাছে দিয়েছেন আমরা তা গ্রহণ করেছি এবং আইডিআরএ’কে দিয়েছি। এখন আইডিআরএ যেটা করবে সেটাই।

শহিদুল ইসলামের নিয়োগ অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রীর সুপারিশ গ্রহণ করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার বলেন, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী আমরা আইডিআরএ’র কাছে আবেদন জানিয়েছি। তবে এই নিয়োগ অনুমোদনের জন্য আমরা কারো সুপারিশ নেইনি। এমন কোন বিষয় আমার জানাও নেই।