সাড়ে ৬ কোটি টাকা অবৈধ লেনদেনের জন্য সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের জরিমানা ১ লাখ টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক: আইডিআরএ’র নির্দেশ লঙ্ঘন করে এক একাউন্ট থেকে অন্য একাউন্টে সাড়ে ৬ কোটি টাকা স্থানান্তর করেছে বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স। এই অপরাধে কোম্পানিটিকে পৃথকভাব ৫০ হাজার টাকা করে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।

অথচ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ লঙ্ঘনের জন্য প্রতিটি অপরাধের জন্য অনধিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে বীমা আইনে। এছাড়া অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করে অর্থ আত্মাসাৎ করা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে অধিকতর তদন্ত করতে পারে কর্তৃপক্ষ।

তবে কোম্পানির প্রিমিয়াম সংগ্রহের সঠিক হিসাব না দেয়া; প্রধান কার্যালয়সহ ব্রাঞ্চগুলোর পুরনো ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ ও নতুন ব্যাংক একাউন্ট খোলা সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য না দেয়া, ব্যয়ের সাথে ব্যাংক স্টেটমেন্ট রিকনসিলেশন করে তথ্য না দেয়া এবং ব্যয় সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য না দেয়ায় প্রকৃত ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও আর্থিক লেনেদেনে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা তা চিহ্নিত করতে পারেনি বিশেষ নিরীক্ষক।

অডিটরের এসব আপত্তির সঠিক ব্যাখ্যা দিতে না পারলেও গুরুত্বপূর্ণ এসব তথ্য না দেয়ায় কোম্পানিকে সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু কোম্পানিটির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আবার অবৈধভাবে এক একাউন্ট থেকে অন্য একাউন্টে অর্থ স্থানান্তরের ফলে অর্থ পাচার বা অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে অধিকতর তদন্তেরও কোনো উদ্যোগ নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।  

সূত্র মতে, নন-লাইফ বীমা খাতে অবৈধ কমিশন, অতিরিক্ত ব্যয়, প্রিমিয়াম আয়ের তথ্য গোপন করে অর্থ আত্মসাৎ ও আর্থিক লেনদেনে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে ৬৪ নং সার্কুলার জারি করে আইডিআরএ। ওই ৬৪ নং সার্কুলার সঠিকভাবে পরিপালন করা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখাসহ ৯টি বিষয় খতিয়ে দেখতে ২০২১ সালের ১ জুন সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সে বিশেষ নিরীক্ষক হিসেবে খান ওয়াহাব সফিক রহমান এন্ড কোম্পানিকে নিয়োগ দেয়া হয়।

আইডিআরএ’র ৬৪ নং সার্কুলার অনুসারে প্রতিটি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি ৩টি নির্ধারিত ব্যাংক একাউন্টে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করতে পারবে। প্রিমিয়াম সংগ্রহের ৩টি ব্যাংক একাউন্ট থেকে পৃথক ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের একাউন্ট এবং ক্লেইম একাউন্টে প্রয়োজন অনুসারে টাকা স্থানান্তর করার নির্দেশনা রয়েছে সার্কুলারে। এই নির্দেশনার বাইরে অন্যভাবে অর্থ লেনদেন বা অর্থ স্থানান্তর অবৈধ।

অথচ সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অন্যান্য আয়ের জন্য পরিচালিত একাউন্ট থেকে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের একাউন্টে এবং অন্যান্য আয় ও লোনের জন্য পরিচালিত একাউন্ট থেকে দাবি পরিশোধের একাউন্টে সাড়ে ৬ কোটি টাকা স্থানান্তর করেছে বীমা প্রতিষ্ঠানটি।

এর মধ্যে অন্যান্য আয়ের জন্য পরিচালিত মেঘনা ব্যাংকের একাউন্ট থেকে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের জন্য পরিচালিত উত্তরা ব্যাংকের একাউন্টে স্থানান্তর করেছে ৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ও অন্যান্য আয় এবং লোনের জন্য পরিচালিত ব্যাংক একাউন্ট থেকে ক্লেইম একাউন্টে স্থানান্তর করেছে ১ কোটি ৫১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।  

অবৈধভাবে এ লেনদেন করার জন্য সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সকে ৫০ হাজার টাকা করে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। এছাড়া লাইসেন্সবিহীন এজেন্টকে কমিশন দেয়া, কর্মকর্তাদের প্রকৃত বিলের চেয়ে বেশি বিল দেয়া ও দাবি সংক্রান্ত অনিয়মের জন্য কোম্পানিটিকে জরিমানা করা হয়েছে আরো ২ লাখ টাকা।

বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের ৩১ জুলাইয়ের পর থেকে সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স ৩টি ব্যাংক একাউন্টে প্রিমিয়াম জমা করে। কিন্তু এর আগের ব্যাংক একাউন্টগুলো বন্ধ করার বিষয়ে বিশেষ নিরীক্ষককে কোনো তথ্য দেয়নি বীমা কোম্পানিটি।

আবার ব্রাঞ্চগুলোর ব্যয়ের জন্য প্রতিটি ব্রাঞ্চে একটি একাউন্ট খোলার নির্দেশনা দেয়া হয় ৬৪ নং সার্কুলারে। এক্ষেত্রে ব্রাঞ্চগুলোর জন্য পরিচালিত একাউন্টের তথ্য আইডিআরএ’কে জানাতে হবে। তবে সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স ব্রাঞ্চগুলোর ব্যাংক একাউন্টের তথ্য সময়মতো জানায়নি।

এছাড়া বেশিরভাগ ব্রাঞ্চ অফিসের কতটি ব্যাংক একাউন্ট নতুন করে খোলা হয়েছে, কতটি বন্ধ করা হয়েছে তার কোনো তথ্য দেয়নি সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি পূর্বের ব্যবহৃত ব্যাংক একাউন্টগুলোর মাধ্যমে শাখা অফিসগুলোর খরচ নির্বাহ করছে। কোম্পানিটি এসব ব্যাংক একাউন্টের স্টেটমেন্টও সরবরাহ করতে পারেনি। এ কারণে ব্রাঞ্চগুলোর লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারেনি বিশেষ নিরীক্ষক।

ব্যবস্থাপনা ব্যয় খতিয়ে দেখতে ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা ব্যাংক স্টেটমেন্ট রিকনসিলেশনের করে কোনো তথ্য দেয়নি সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স।

এ ছাড়াও ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হিসাব বিভাজন ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রদান করতে পারেনি সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স। শুধুমাত্র ২০১৯ ও ২০২০ সালের বার্ষিক ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হিসাব দাখিল করেছে। সেক্ষেত্রে ৪টি খাতে খরচের হার ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। যার কোন কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি বীমা কোম্পানিটি।

ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হিসাব বিভাজন সরবরাহ না করায় সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা ব্যয় কতটা বাড়ছে বা কমছে সে বিষয়ে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারেনি বিশেষ নিরীক্ষক।

বীমা খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধভাবে এক একাউন্ট থেকে অন্য একাউন্টে অর্থ স্থানান্তর, ব্যাংক স্টেটমেন্ট না দেয়া ও ব্যাংক স্টেটমেন্ট রিকনসিলেশন করে তথ্য না দেয়া গুরুতর অপরাধ। এ ধরণের অপরাধের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি অধিকতর তদন্ত করতে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। অন্যথায় বীমা খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে না।

তাদের মতে, বীমা আইনের ২৯ ধারা অনুসারে বিশেষ নিরীক্ষককে তথ্য না দিলে বীমা আইনে বা আইডিআরএ’র জরিমানা করার বিধান রয়েছে। তবে কোনো কোম্পানির ‍বিরুদ্ধে তথ্য না দেয়ার অভিযোগ উঠলে বীমা আইনের ৪৮ ধারা অনুসারে তদন্তের সুযোগ রাখা হয়েছে। এই ধারায় তথ্য না দেয়ার কোনো সুযোগ নাই। এক্ষেত্রে কোনো কোম্পানি তথ্য না দিলে আইডিআরএ অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমন জারি করতে পারে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। আবার তদন্তের প্রয়োজনে নথিপত্র জব্দ করতে পারে।

সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এসব বিষয়ে আইডিআরএ’র বক্তব্য জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষের পরিচালক ও মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, বীমা কোম্পানিগুলোতে যেসব অডিট হয় সেগুলোকে খুব গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়। অডিটে কোন আপত্তি আসলে সে বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় শুনানি করে আইনমাফিক যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়।

সকল অপরাধের বিচার করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোন অপরাধী পার পাবে না। তবে এক সাথে সব কিছু করা সম্ভব না; তাই পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বীমা খাতের যেকোন অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে আইডিআরএ অতিমাত্রায় তৎপর এবং অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে রয়েছে।

জাহাঙ্গীর আলম আরো বলেন, কিছু ক্ষেত্রে অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোরও সমস্যা রয়েছে। বীমা কোম্পানিগুলো কোন তথ্য না দিলে তা সাথে সাথেই আইডিআরএ’কে জানানো উচিত। তাহলে কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। জনবান্ধব বীমা খাত গড়ে তোলার লক্ষ্যে আইডিআরএ কাজ করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বিশেষ নিরীক্ষায় উত্থাপিত এসব আপত্তির বিষয়ে সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের বক্তব্য জানতে কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা এবং কোম্পানি সেক্রেটারির সাথে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পক্ষ থেকে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হয়। স্বশরীরে ও মোবাইল ফোনে যোগাযোগের পাশাপাশি ই-মেইলে লিখিতভাবেও বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তবে বারবার সময় দেয়ার পরও তারা কোনো বক্তব্য দেয়নি।