গ্রাহকের দায় পরিশোধে সানলাইফের ঘাটতি কত!

নিজস্ব প্রতিবেদক: মেয়াদ শেষে বীমার টাকা না পেয়ে প্রতিদিনই বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করছেন সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের হাজারও গ্রাহক। দেশের কোথাও না কোথাও সানলাইফের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও দায়ের করছেন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা।

আর্থিক সংকটের কারণে কোম্পানিটি গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই সংকট চলছে গত কয়েক বছর ধরেই। এর মধ্যেই দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকরা।

গত সোমবার (৩০ অক্টোবর) বীমা কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকরা ঘোষণা দেন তাদের ১ কোটি ৫৪ লাখ ১৯ হাজার শেয়ার, যা মোট শেয়ারের ৩৮ শতাংশ বিক্রি করে দিচ্ছেন। আর তা কিনে নিচ্ছে দেশের শীর্ষ স্থানীয় নন-লাইফ বীমা কোম্পানির গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স।

সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির এমন ঘোষণার পর বীমা খাতে কোম্পানিটি বিক্রি নিয়ে চলছে নানান আলোচনা।  

তবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে গ্রাহকের দায় পরিশোধে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের কি পরিমাণ আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে বা কোম্পানিতে গ্রাহকের দায় পরিশোধে ঘাটতির পরিমাণ কত? সেই সাথে মালিকানা পরিবর্তনে গ্রাহকের হয়রানি বন্ধ হবে কিনা তা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে।

উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মালিকানা পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু তাতেও কোম্পানিটির গ্রাহক হয়রানি বন্ধ হয়নি।

এরপর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নানান অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয় পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। পরে দ্বিতীয় দফায় কোম্পানিটির মালিকানা পরিবর্তন করে নতুন বোর্ড গঠন করা হয়। কিন্তু কোম্পানিটির গ্রাহক হয়রানি বন্ধ হয়নি।

আইডিআরএ’র বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী সংস্থাটির দায়িত্ব গ্রহণের পর একটি লাইফ বীমা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বলেন, বীমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না এর কারণ- অতিরিক্ত ব্যয় ও মন্দ বিনিয়োগ।

একই ধরণের কথা বলেন বীমা মালিকদের সংগঠন বিআইএ’র প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন। অপর একটি লাইফ বীমা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন- কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করে না, তারা বিনিয়োগের টাকা আত্মসাৎ করে।

ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১ সালের সর্বশেষ একচ্যুয়ারিয়াল ভ্যালুয়েশন রিপোর্টে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের গ্রাহকের দায় দেখানো হয়েছে ১৭৮ কোটি ৪৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা। আর লাইফ ফান্ড দেখানো হয়েছে ১২৬ কোটি ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। এই হিসেবে কোম্পানিটির ঘাটতির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৫২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

অথচ গত ৩ আগস্টে আইডিআরএ’র এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে- ২০২১ সালে কোম্পানিটির প্রকৃত লাইফ ফান্ড ৯৩ কোটি ৭৪ লাখ ৯০ হাজার ৪০৩ টাকা। যদিও সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স আর্থিক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে লাইফ ফান্ড ১২৬ কোটি ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা।

লাইফ ফান্ড বৃদ্ধি করে দেখানোর বিষয়ে তদন্তে আরো বলা হয়েছে, ২০২১ সালে কোম্পানির অনিষ্পন্ন বীমা দাবির পরিমাণ ছিল ৩২ কোটি ৩০ লাখ ২০ হাজার ৩৪২ টাকা। তবে এই টাকা আর্থিক প্রতিবেদনের হিসাবে প্রভিশন না করায় লাইফ ফান্ড বেড়ে গেছে। মূলত কোম্পানিটির প্রকৃত লাইফ ফান্ড হবে ৯৩ কোটি ৭৪ লাখ ৯০ হাজার ৪০৩ টাকা।

এই হিসেবে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দায় পরিশোধে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৪ কোটি ৭০ লাখ ২৭ হাজার ৫৯৭ টাকা। এই দায় প্রতিবছরই বাড়ছে। তবে বর্তমানে কোম্পানিটির দায়ের পরিমাণ কত তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে ২০২১ সালের পরে আর কোনো ভ্যালুয়েশন করেনি সানলাইফ।

আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে ২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে লাইফ ফান্ড কমে গেছে ৯২ কোটি টাকা।

আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটি মোট প্রিমিয়াম আয় করে ১০৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে নীট প্রিমিয়াম আয় করে ৯৪২ কোটি টাকা। বিনিয়োগ থেকে আয় করেছে ১১৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।

অপর দিকে কোম্পানিটি মোট ব্যয় করেছে ১১৫৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে বীমা দাবি পরিশোধ করেছে ৫৩৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করেছে ৫৬৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। অন্যান্য খাতে ব্যয় করেছে ৪২ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং ডিভিডেন্ট দিতে ব্যয় করেছে ৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ৫৭ কোটি ৬৮ হাজার ৫৬৪ টাকা। সম্পদ দেখিয়েছে ১৭৬ কোটি ৪ লাখ ২০ হাজার ৪৮৪ টাকা।

২০২২ সালে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিনিয়োগ আছে ৫৩ কোটি ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৬২ টাকা।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে বীমা কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের বিষয়ে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

উল্লেখ্য, দেশের ১৭টি লাইফ বীমা কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক। ২০১৬ সালের জুনে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ সময়ে অতিরিক্ত ব্যয়ের টাকা পুনর্ভরণের অঙ্গীকার করে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো।

সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয় করে ৮৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তবে এই টাকা পুনর্ভরণ করতে পারেনি বীমা কোম্পানিটি।

সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের গ্রাহকদের দায়ের করা মামলা এবং গ্রাহকদের পাওনার দায় নেবে কিনা সে বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ফারাজনা চৌধুরীর সঙ্গে। তবে তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।