আর্থিক প্রতিবেদনে সাড়ে ৭ কোটি টাকার প্রিমিয়াম আয়ের হিসাব দেয়নি রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স

বিশেষ প্রতিবেদক: ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে সাড়ে ৭ কোটি টাকার প্রিমিয়াম আয়ের হিসাব দেয়নি রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স। অপরদিকে পুনর্বীমাকারীর কাছ থেকে ৩টি বীমা দাবি বাবদ রিকভারি নিয়েছে ১৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, তবে গ্রাহককে পরিশোধ করেছে ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

রিপাবিলক ইন্স্যুরেন্সের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন, কোম্পানিটির ব্যাংক একাউন্টে জমা করা প্রিমিয়ামের টাকা ও আর্থিক প্রতিবেদনে প্রদর্শিত প্রিমিয়াম আয়ের তথ্য পর্যালোচনা করা হয় ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম সংগ্রহের ব্যাংক একাউন্টগুলোতে ২০২০ সালে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রিমিয়াম ও ভ্যাট স্ট্যাম্প বাবদ জমা করেছে ৯০ কোটি ৬ লাখ ২২ হাজার ৬৪৭ টাকা। ব্যাংক একাউন্টগুলোতে গ্রাহকের জমা করা এই টাকা থেকে রিটার্ন করেছে ৩ কোটি ৬১ লাখ ৪২ হাজার ৮৩২ টাকা।

অর্থাৎ প্রিমিয়াম, ভ্যাট ও স্ট্যাম্প বাবদ ব্যাংক একাউন্টে প্রকৃত জমা হয় ৮৬ কোটি ৪৪ লাখ ৭৯ হাজার ৮১৫ টাকা।

অথচ বীমা কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, সরাসারি প্রিমিয়াম আয় ৭১ কোটি ৮২ লাখ ২৬ হাজার ৭৬৯ টাকা, ভ্যাট পরিশোধ করেছে ৬ কোটি ৯৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকা ৮১০ টাকা, স্ট্যাম্প ডিউটি পরিশোধ করেছে ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৬২৩ টাকা।  

এই হিসেবে আর্থিক প্রতিবেদনে সরাসারি প্রিমিয়াম ও ভ্যাট-স্ট্যাম্প বাবদ মোট প্রদর্শন করা হয়েছে ৭৮ কোটি ৮৫ লাখ ৮৮ হাজার ২০২ টাকা।

অর্থাৎ ৭ কোটি ৫৮ লাখ ৯১ হাজার ৬১৩ টাকার প্রিমিয়াম গোপন করেছে রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স।

আর্থিক প্রতিবেদনে প্রিমিয়াম ডিপোজিট খাতে ২০১৯ সালে ১ কোটি ৮৮ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩২ টাকা ও ২০২০ সালে ১ কোটি ৮৯ লাখ ১৫ হাজার ৫৫ টাকার তথ্য তুলে ধরেছে বীমা কোম্পানিটি।

তবে আইডিআরএ’র বিশেষ নিরীক্ষায় প্রিমিয়ামের টাকা গোপন করার কোনো তথ্য উঠে আসেনি। যদিও ব্যাংক একাউন্ট যথাযথভাবে সংরক্ষণ করছে কিনা তা যাচাই করতে বলা হয়েছিল বিশেষ নিরীক্ষককে।

বিশেষ নিরীক্ষক বীমা কোম্পানিটির ব্যাংক হিসাব যাচাই-বাছাই করে যেসব অনিয়মের চিত্র পেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- কোম্পানিটির ব্যাংক একাউন্ট থেকে আইন লঙ্ঘন করে ১০ হাজার টাকার ওপরে ৫টি লেনদেন করা হয়েছে। এই লেনদেনে কোম্পানির ব্যাংক একাউন্ট থেকে নগদ উত্তোলন করা হয় ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৯১৬ টাকা। আর রাজশাহীর একটি ব্রাঞ্চের কোনো ব্যাংক একাউন্ট নেই। ওই ব্রাঞ্চে কোম্পানির প্রধান কার্যালয় থেকে খরচ মেটানো হয়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২১ সালের ৩১ মে রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সে বিশেষ নিরীক্ষক হিসেবে দাশ চৌধুরী দত্ত এন্ড কোং- কে নিয়োগ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কোম্পানি পরিচালনা সংক্রান্ত ৯টি বিষয় খতিয়ে দেখতে বলা হয়। এর মধ্যে ৭ নং কাজের পরিধি ছিল- বীমাকারীর ব্যাংক হিসাবগুলোর আয়-ব্যয়ের তথ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় কোম্পানিটিতে ৪৬টি ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে। এর মধ্যে ৩টি ব্যাংক একাউন্টে প্রিমিয়াম জমা করা হয়। এছাড়াও কোম্পানিটি নন-লাইফ সার্কুলার ৬৪/২০১৯ অনুসারে যথাযথভাবেই ব্যাংক একাউন্টগুলো সংরক্ষণ করছে বলেও মতামত দেয় বিশেষ নিরীক্ষক।

রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের আরো যেসব অনিয়মের চিত্র বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় তার মধ্যে রয়েছে- এজেন্টদেরকে মোবাইল ফোনে খুঁজে না পাওয়া, ৩৫ জন এজেন্টের মধ্যে ১৭ জনের ব্যক্তিগত ফাইল না পাওয়া। ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালের মে পর্যন্ত ১১৫ জন নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ প্রদান। নতুন নিয়োগকৃত ১১৫ জনকে মোট ২ কোটি ৪০ লাখ ৭ হাজার টাকা বেতন প্রদান।

নিরীক্ষক তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেন- রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স পুনর্বীমা বাধ্যতামূলক ছিল এমন ৫৮টি পলিসির পুনর্বীমা করেনি। ২২০টি বীমা দাবি পরিশোধ করে যার মধ্যে ২১১টি পলিসির পুনর্বীমা করেনি। পুনর্বীমা ও দাবি পরিশোধ সংক্রান্ত অনিয়মের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয় নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ৭, ৭(১), ৭(২) ও ৭(৩) নং সংযুক্তিতে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেয়া পুনর্বীমা সংক্রান্ত সংযুক্তির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়- ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত সময়ে রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স ৩টি বীমা দাবি বাবদ পরিশোধ করেছে ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অথচ পুনর্বীমা রিকভারি নেয়া হয় ১৫ কোটি ৬৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা।

অর্থাৎ যে পরিমাণ বীমা দাবি নিষ্পত্তি করেছে তারে চেয়ে পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠান থেকে ৯ কোটি ৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা বেশি রিকভারি নিয়েছে রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স।

তবে পুনর্বীমা না করার বিষয়ে আপত্তি করা হলেও বীমা দাবির বিপরীতে পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেয়া রিকভারি ও দাবি নিষ্পত্তির এমন পার্থক্য নিয়ে কোনো আপত্তি করেনি বিশেষ নিরীক্ষক এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সংযুক্তিতে দেয়া তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘি ব্রাঞ্চে জনতা মেরিন সার্ভিস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের দাবি নিষ্পত্তি করা হয় ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এই বীমা দাবির রিকভারি নেয়া হয় ৭ কোটি ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বীমা করেছিল ৮ কোটি ৭০ লাখ টাকার। দাবি উত্থাপনও করেছিল ৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

এর আগে ২০২০ সালে জনতা মেরিন সার্ভিসকে দাবি পরিশোধ করা হয় ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। রিকভারি নেয়া হয় ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ পুনর্বীমা কোম্পানি থেকে রিকভারি বাবদ নেয়া টাকাই গ্রাহককে পরিশোধ করেছে। রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের নিজস্ব তহবিল থেকে কোনো টাকা পরিশোধ করেনি।

২০২০ সালে প্রীতি সোয়েটার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে বীমা পলিসির আওতায় পুনর্বীমা রিকভারি নেয়া হয় ৩ কোটি ৬৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা। তবে কত টাকা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, কত টাকা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে- তার তথ্য নেই বিশেষ নিরীক্ষকের তুলে ধরা সংযুক্তিতে। তবে জরিপ ফি বাবদ দাবি পরিশোধ দেখানো হয়েছে ২ লাখ টাকা।

২০২০ সালে রয়েল ফুটওয়্যারের পলিসির বিপরীতে দাবি পরিশোধ করা হয় ১ কোটি ৬০ লাখ ৮৫ হাজার। পুনর্বীমা রিকভারি নেয়া হয় ২ কোটি ৮০ লাখ ৮৬ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর শুনানী শেষে বিভিন্ন অনিয়মের জন্য রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে মোট ৯ লাখ টাকা জারিমানা করে আইডিআরএ। এর মধ্যে পুনর্বীমা না করার জন্য জরিমানা করা হয় ৩ লাখ টাকা।

যদিও আইন অনুসারে পুনর্বীমা না করার জন্য বীমা কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের বিধান রাখা হয়েছে।

এসব বিষয়ে রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের ডিএমডি ও কোম্পানি সেক্রেটারি সজন কুমার বসাক ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, নিরীক্ষার কোন বিষয়ে আমাদের কথা বলার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে কিছু জানার থাকলে তা নিরীক্ষকের কাছ থেকেই জেনে নিতে হবে।

তিনি বলেন, কোম্পানিতে বিশেষ নিরীক্ষা পরিচালনা করেছে আইডিআরএ। নিরীক্ষায় যেসব বিষয়ে আপত্তি এসেছে সেগুলোর বিষয়ে আমাদের ব্যাখ্যাও নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কয়েকটি আপত্তির ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় তারা আমাদের জরিমানাও করেছে।

আর্থিক প্রতিবেদনে সাড়ে ৭ কোটি টাকার প্রিমিয়াম আয়ের হিসাব না দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের হিসাব সঠিক রয়েছে। কোন গড়মিল থাকলে হিসাব মিলবে না। তবে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানের হিসাব যথাযথ কিনা তা যচাই করে পরে জানাবেন, বলেন সজন কুমার বসাক।

পরবর্তীতে একাধিকবার মোবাইল ফোনে এবং স্বশরীরে কোম্পানিতে গিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোম্পানি সেক্রেটারি সজন কুমার বসাককে পাওয়া যায়নি। পরে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের এসভিপি ও সিএফও মোহাম্মদ মুশফিকুর রহমানের সাথে।

তিনি বলেন, ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানের হিসাব যথাযথ কিনা তা যচাই করে দেখার সুযোগ হয়নি। তবে প্রাথমিকভাবে দেখে মনে হয়েছে- কো-ইন্স্যুরেন্স বাবদ পরিশোধিত প্রিমিয়াম ও মিসেলেনিয়াসহ মেরিন ইন্স্যুরেন্সের রিকভারেবল স্ট্যাম্পের অর্থ এই হিসাবে অন্তুর্ভুক্ত রয়েছে। যার কারণে গড়মিল মনে হচ্ছে। তবে কোম্পানির হিসাব সঠিক রয়েছে এবং এতে কোন গড়মিল নেই, বলেন মুশফিকুর রহমান।