বীমা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কঠোর অবস্থানে আইডিআরএ
নিজস্ব প্রতিবেদক: বীমা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে লাইফ বীমার মেয়াদ উত্তীর্ণ দাবি পরিশোধ এবং নন-লাইফ বীমায় অবৈধ কমিশন প্রদান ও প্রিমিয়াম আয়ের তথ্য গোপনসহ একাধিক অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে। ইতোমধ্যে বীমা খাতের উন্নয়নে এবং অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং বীমা খাত সংশ্লিষ্ট সরকারি অন্যান্য দফতরগুলো কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
সূত্র মতে, ২০২২ সালের ১৪ জুন ড. এম মোশাররফ হোসেন পদত্যাগ করার পরই বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পূর্ণাঙ্গ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন সরকারের সাবেক সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী। ২০২২ সালের ১৬ জুন তিনি সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই দেশের বীমা খাতের উন্নয়ন এবং এ খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
প্রিমিয়াম আয়ের তথ্য গোপনের অভিযোগে একাধিক কোম্পানিতে তদন্ত, আর্থিক সক্ষমতা যাচাইয়ে মূলধন ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত তদন্ত, অতিরিক্ত ব্যয় বন্ধে লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিতে তদন্ত, বাধ্যতামূলক পুনর্বীমাকরণ নিশ্চিত করতে তদন্ত এবং অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে একাধিক বীমা কোম্পানিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে আইডিআরএ।
মূলধন ভেঙ্গে ফেলায় নতুন একটি লাইফ বীমা কোম্পানির পরিচালকদের সাসপেন্ড ও নিয়ম মাফিক মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ না দেয়ায় কোম্পানিটিতে প্রশাসক নিয়োগ এবং দুর্নীতির দায়ে আরেকটি নতুন লাইফ বীমা কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়াও শিক্ষা সনদের বৈধতা না থাকায় দু’টি কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর নিয়োগ না-মঞ্জুর, গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে দু’টি কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর নবায়ন নিয়োগ না-মঞ্জুরসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে বীমা খাতের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
একাধিক সূত্রের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সামনে রেখে বীমা খাতের উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এরমধ্যে লাইফ বীমা কোম্পানির গ্রাহকদের দাবি পরিশোধের বিষয়ে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে সরকারের বীমা খাত নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
বীমা খাতে স্বচ্ছতা আনতে ইতোমধ্যে আইডিআরএ’র জারি করা নির্দেশনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নন-লাইফ বীমা কোম্পানিতে নিয়মিত পরিদর্শন করছে আইডিআরএ গঠিত একাধিক তদন্ত দল। এসব তদন্ত দল অবৈধ কমিশন প্রদান ও প্রিমিয়াম আয়ের তথ্য গোপন করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে।
অপর দিকে বীমা কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা যাচাই করতে কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ ও মূলধন কি পরিমাণ আছে তা খতিয়ে দেখতে প্রথমবারের মতো তদন্ত শুরু করে আইডিআরএ। ইতোমধ্যে একাধিক বীমা কোম্পানিতে এ সংক্রান্ত তদন্ত করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। সেই সাথে জরিমানা এবং বিনিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম বের করতে প্রয়োজনীয় সকল নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দুর্নীতি ক্ষতিয়ে দেখতে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদাভাসিকে নিয়োগ করে আইডিআরএ। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্যে ভিত্তিতে দফায় দফায় কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। কিন্তু সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি সোনালী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ।
এই প্রেক্ষিতে বীমা কোম্পানিটির ১৮৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পরিচালনা পর্ষদ ৬ মাসের জন্য সাসপেন্ড করে প্রশাসক নিয়োগ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। একটি পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা এবং বীমা পলিসি ইস্যুসহ সোনালী লাইফের সকল কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রাশাসককে। বীমাকারী ও বীমা গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষার্থে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।
নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অবৈধ কমিশন প্রদান ও প্রিমিয়ামের অর্থ গোপন করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘ দিন থেকেই। এই অনিয়ম বন্ধে গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে অন্তত ১০টি বীমা কোম্পানিতে তদন্ত করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
এর মধ্যে যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রিমিয়াম গোপনের তথ্য উঠে আসে তাদেরকে জরিমানা করাসহ সেসব কোম্পানি কি পরিমাণ সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে তা তদন্ত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)’কে তদন্তের অনুরোধ জানায় আইডিআরএ।
এছাড়া লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দেয়ার বিষয়েও একাধিক তদন্ত করেছে সংস্থাটি। আবার লাইফ বীমা খাতের নতুন অনুমোদন পাওয়া বীমা কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা যাচাই এবং সেগুলোতে কঠোর নজর দারি করছে আইডিআরএ।
সূত্র মতে, নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর আর্থিক অনিয়ম বন্ধে জারি করা সার্কুলার নম্বর নন-লাইফ ৬৪/২০১৯ ও নন-লাইফ ৬৮/২০১৯ বাস্তবায়নে বারবার তাগাদা দিয়ে আসছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। একইসঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এ সংক্রান্ত অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত বীমা কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
এরইমধ্যে গ্রাহকদের বীমা দাবি যথাসময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছে আইডিআরএ। হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে পর্যবেক্ষক। এ ছাড়া বীমা কোম্পানিটিতে আইডিআরএ’র তদন্ত কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ না দেয়ায় প্রথমবারের মতো স্বদেশ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। বীমা আইন ২০১০ এর ৮০(৫) ধারা মোতাবেক এই প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়।
এর আগে বীমা কোম্পানিটির অতিরিক্ত ব্যয়, পরিশোধিত মূলধন ও মূলধন থেকে অর্জিত সুদের অর্থ খরচসহ বিভিন্ন অভিযোগে নতুন পলিসি বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ ১২ পরিচালককে অপসারণ করে আইডিআরএ।
এ ছাড়াও ব্যয় কমাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে কর্তৃপক্ষের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া কোম্পানির টাকায় বীমা কোম্পানির পরিচালক ও কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে। বীমা কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ও বিনিয়োগের এফডিআর বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। জিএডি সার্কুলার নম্বর- ১৭/২০২৪ জারি করে এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগ নবায়নের আবেদন না-মঞ্জুর করেছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। শিক্ষাগত যোগ্যতার বিদেশি সনদপত্রের সমতাকরণ ও ইবাইস ইউনিভার্সিটির দু’টি সনদের বৈধতার প্রত্যয়নপত্র দাখিল করতে না পারায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়াও বীমা খাতের উন্নয়ন এবং এ খাতের কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে বীমা আইনকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে গ্রাহক আস্থা বাড়াতে করপোরেট গভর্ন্যান্স, রেগুলেটরি স্যান্ডবক্স, এবং বীমা দাবি ব্যবস্থাপনায় নতুন গাইডলাইন জারি করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। সংশোধন আনা হয়েছে মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ প্রবিধানমালাতেও।
বীমা খাতের প্রসার বাড়াতে চালু করা হয়েছে ব্যাংকাস্যুরেন্স। এর মাধ্যমে বীমা খাতের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করা হয়েছে দেশের সকল তফসিলি ব্যাংক। বীমা কোম্পানির করপোরেট এজেন্ট হিসেবে বীমা পণ্য বিপণন ও বিক্রয় ব্যবসায় নিয়োজিত হতে পারবে এসব ব্যাংক। বিক্রি করতে পারবে লাইফ বীমার সকল পণ্য এবং নন-লাইফে স্বাস্থ্য বীমা, মোটর বীমা, শিক্ষা বীমা, কৃষি বীমা ও ভ্রমণ বীমা।