আইডিআরএ’র পরিদর্শন প্রতিবেদন

পুনর্বীমা করছে না ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স, চলছে ট্যারিফ রেট লঙ্ঘন-বাকী ব্যবসা

আবদুর রহমান আবির: আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকার পরও সাধারণ বীমা করপোরেশনে পুনর্বীমা করেনি ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ট্যারিফ রেট লঙ্ঘন করে কম হারে প্রিমিয়াম আরোপ এবং বাকীতে বীমা ব্যবসা করার তথ্যও পেয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন দল।

২০২৩ সালের ৯ আগস্ট ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয় সরেজমিনে পরিদর্শন করে এসব তথ্য পেয়েছে কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন দল। বীমা কোম্পানিটির বিভিন্ন রেজিস্ট্রার, অনুবিভাগ এবং নথি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গত ৫ মার্চ এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বীমা কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আইন ও বিধি-বিধান লঙ্ঘণের পাশাপাশি সরকারের পাওনা রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে। একইসঙ্গে পুনর্বীমা না করে বীমা গ্রাহকদের ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে দলনেতা করে ৩ সদস্যের এই পরিদর্শন দল গঠন করা হয় ২০২৩ সালের ১৬ মে। কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মুর্শেদুল মুসলিম ও মো. মোস্তাকিম আহমেদ পরিদর্শন দলটির সদস্য ছিলেন।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের খাতুনগঞ্জ শাখার মেরিন কার্গো শ্রেণীতে বীমা অংক ৫০ লাখ টাকার ওপরে এমন ১০টি কাভার নোট দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে যাচাই করেছে কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন দল। এতে দেখা যায়, ৮টি কাভার নোটের বিষয়েই সাধারণ বীমা করপোরেশনকে সেশন দেয়নি বীমা কোম্পানিটি।

অথচ সাধারণ বীমা করপোরেশনের সাথে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের পুনর্বীমা চুক্তি অনুসারে কোম্পানিটির মেরিন কার্গো শ্রেণীতে সর্বোচ্চ রিটেনশন ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৪০ লাখ টাকার ওপর বীমা অংকের সব পলিসির পুনর্বীমাযোগ্য অংশ সাধারণ বীমা করপোরেশনে পুনর্বীমা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

পরিদর্শক দলের মতে, চুক্তি অনুযায়ী পুনর্বীমা না করে সাধারণ বীমা করপোরেশনকে পুনর্বীমা প্রিমিয়াম থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। একইসাথে বিরাট ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয় বীমা গ্রাহকদের। ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের এই কার্যক্রম বীমা আইন ২০১০ এবং বীমা করপোরেশন আইন ২০১৯ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

সন্তোষজনকভাবে পুনর্বীমা ব্যবস্থাকার্য সম্পাদনে ব্যর্থ হলে বীমা কোম্পানির নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিলের বিধান রাখা হয়েছে বীমা আইন ২০১০ এর ধারা ১০(১)-এ। দশটি কারণ উল্লেখ করে এই ধারায় বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত এক বা একাধিক কারণে বীমাকারীর নিবন্ধন সম্পূর্ণরূপে বা বিশেষ কোন শ্রেণীর বা উপ-শ্রেণীর বীমা ব্যবসা স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে।

অপরদিকে বীমা করপোরেশন আইন ২০১৯ এর ১৭ নম্বর ধারার উপ-ধারা ১ এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত ও বীমা ব্যবসায়রত প্রত্যেক বীমাকারী সাধারণভাবে প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য শর্তে তার নিজস্ব ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পুনর্বীমা অংশের পুনর্বীমা করবে।

উপ-ধারা (২)-এ বলা হয়েছে, নন-লাইফ বীমা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে পুনর্বীমাযোগ্য অংশের ৫০% সাধারণ বীমা করপোরেশনের নিকট করতে হবে এবং অবশিষ্ট ৫০% উক্ত করপোরেশন অথবা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে অবস্থিত অন্য কোনো বীমাকারীর নিকট করা যাবে: তবে শর্ত থাকে যে, সরকার প্রয়োজনে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা উক্ত সীমা পুনর্নির্ধারণ করতে পারবে।

ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের খাতুনগঞ্জ ও চাপাইনবাবগঞ্জ শাখা কার্যালয় থেকে ইস্যুকৃত ১০টি কাভার নোট দৈবচয়নের ভিত্তিতে যাচাই করে ৮টিতেই বাকীতে বীমা ব্যবসার প্রমাণ পেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্ত দল। যা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের জারিকৃত সার্কুলার জেন-২৯/২০১১ এর সুস্পষ্ট লংঘন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটির খাতুনগঞ্জ শাখা কার্যালয় থেকে ইস্যুকৃত ৫টি কাভার নোটই বাকীতে ব্যবসা করেছে এবং চাপাইনবাবগঞ্জ শাখা থেকে ইস্যুকৃত ৫টি কাভার নোটের মধ্যে ৩টিতে বাকী ব্যবসা করা হয়েছে। এর মধ্যে চাপাইনবাবগঞ্জ শাখার একটি কাভার নোট ইস্যু করার ১ মাস পর প্রিমিয়ামের টাকা ব্যাংকে ক্রেডিট হয়েছে।

এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন দল বীমা কোম্পানিটির কাভার নোট পরীক্ষা করে ই-মানি রিসিপ্ট ইস্যুর বিষয়টি দেখে এবং মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে কিউআর কোড যাচাই করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ই-মানি রিসিপ্ট ইস্যুর সত্যতা খুঁজে পেয়েছে।

এ ছাড়াও ট্যারিফ রেট লঙ্ঘন করে নির্ধারিত হারের চেয়ে কম হারে প্রিমিয়াম আরোপ করেছে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স। যা বীমা আইন ২০১০ এর ১৭ ধারা এবং ৬০ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ২০১১ সালের ১৮ এপ্রিল কর্তৃপক্ষের ইস্যুকৃত এ সংক্রান্ত নির্দেশনার পরিপন্থী।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্যারিফ রেট বা প্রিমিয়াম হার লঙ্ঘন করা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয়ের দলিলাদি থেকে কোম্পানিটির খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ইস্যুকৃত ৩টি কাভার নোট পরীক্ষা করা হয়। এতে ট্যারিফ রেট লংঘনের সত্যতা পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে একটি কাভার নোটে দেখা গেছে, ট্যারিফ রেট ০.৪৩ শতাংশ হলেও ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম ধার্য্য করেছে ০.২০ শতাংশ। অর্থাৎ ০.২৩ শতাংশ কম প্রিমিয়াম আরোপ করা হয়েছে। তিনটি কাভার নোটের মাধ্যমে কোম্পানিটি ১৫ হাজার ৭৬৫ টাকার প্রিমিয়াম, ৪ হাজার ৪২২ টাকার ভ্যাট এবং স্ট্যাম্প বাবদ ৬০ টাকা কম নিয়েছে বলেও পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।  

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এ এম এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি এখন অফিসের বাইরে মিটিংয়ে আছি; কথা বলতে পারছি না। প্রয়োজনে এ বিষয়ে কোম্পানি সেক্রেটারির সাথে কথা বলতে পারেন।

ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সেক্রেটারি শেখ মোহাম্মদ আনোয়ার উদ্দিন বলেন, এ বিষয়ে আইডিআরএ থেকে আমাদেরকে কোন শুনানিতে ডাকা হয়নি। যখন তারা আমাদেরকে ডাকবে বা চিঠি দেবে তখন আমরা সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় বক্তব্য বা ব্যাখ্যা প্রদান করব। এখন এ বিষয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র পরিচালক ও মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম এ বিষয়ে বলেন, আমরা বীমা কোম্পানিটি পরিদর্শন করে কর্তৃপক্ষে প্রতিবেদন দাখিল করেছি। নিয়ম অনুসারে কর্তৃপক্ষ বীমা কোম্পানিটি ম্যানেজমেন্টকে ডেকে শুনানি করবে। শুনানিতে কোম্পানির বক্তব্য সন্তোষজনক না হলে অপরাধ অনুসারে কর্তৃপক্ষ জরিমানা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। তবে বিষয়টি সম্ভবত এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।