বীমা সচেতনতা সৃষ্টিতে আমাদের করণীয়
পথিক: বাংলাদেশের মানুষ বীমা সচেতন নয়; এমন অভিযোগ আমরা প্রায় করে থাকি। কিন্তু কেন তারা সচেতন নয় এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা, পর্যালোচনা খুব কম লক্ষ্য করা যায়। বীমা ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ বীমার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কম-বেশি ওয়াকেফহাল।
কিন্তু বীমা ব্যবস্থার আওতায় সকল নাগরিককে আমরা সম্পৃক্ত করতে পারিনি। এ ব্যর্থতা মূলতঃ দেশের বীমাবিদদের ও বীমা ব্যবসায়ীদের। বীমা পেশার সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট সকলের ঐকবদ্ধ প্রয়াস বীমা শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারে এবং এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
তবে এ ক্ষেত্রে কিছু বাধা রয়েছে। বীমা শিল্পের বিকাশে মৌলিক বাধা সমূহ কি কি তা অবশ্যই প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে। প্রধান প্রধান বাধা দূর করার জন্য নীতি নির্ধারক তথা সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, বীমাবিদ, বীমা ব্যবসায়ী, বীমা কর্মী, সংবাদিক ও বীমা গ্রাহকের সমঝোতা ও সম্মলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
যেহেতু বীমা সকল মানুষের জন্য কল্যাণকর, সেহেতু, সমাজের সকল স্তরের মানুষের সম্পৃক্ততা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বীমা সেবাকে মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেবার জন্য প্রতিটি সমাজ সচেতন মানুষের সম্পৃক্ততা ও সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে এবং এ কারণেই বীমা সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী গ্রহণ প্রয়োজন।
আমাদের জাতীয় বীমা নীতিতে বীমার উপকারিতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতাকে বাংলাদেশে বীমা অনগ্রসরতার একটি প্রধান কারণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তির প্রয়োগহীনতা, দক্ষ নেতৃত্বের অভাবকে বাংলাদেশের বীমা শিল্পের অনগ্রসরতার অন্যান্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট বীমাবিদগণ।
প্রবিধান/বিধি প্রণয়নে দীর্ঘসূত্রতা এবং জটিলতার কারণে বাংলাদেশের বীমা শিল্প কাংখিত ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না বলে কেউ কেউ মনে করেন। বীমা সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রত্যেকে নিজ নিজ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হলে বর্তমানে বীমা শিল্পের অনেক সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে। আজকে আমরা সেদিকেই দৃষ্টি দেব।
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একনেক এর সভায় বীমার সুবিধা সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা আশা করি এই নির্দেশনার ফলে বীমা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল মহলে সচেতনতার সৃষ্টি হবে এবং সকলেই উপযুক্ত ভূমিকা রাখতে তৎপর হবেন।
বীমা সচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারকেই প্রথমে দৃষ্টি দিতে হবে, কেননা রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দেয়া মূলতঃ সরকারের কাজ। ঠিক একইভাবে সমাজের দুস্থ্য, অসহায়, মানুষের পাশে দাঁড়ানো সরকারের দায়িত্ব।
বীমা ব্যবস্থা যেহেতু মানুষের অসহায় অবস্থার একটি রক্ষাকবচ, সেহেতু বীমা ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে সরকার তার দায়িত্ব পালন করতে পারে। এজন্য সরকার একটি “জাতীয় বীমা নীতি” প্রনয়ন করেছে। বীমা নীতির অংশ হিসেবে সকল শ্রেণীর মানুষকে বীমা ব্যবস্থার সুফল সম্পর্কে এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।
প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও বীমা সম্পর্কে একটি নির্দেশিকা থাকা প্রয়োজন। বীমা ব্যবসা বর্তমানে অর্থ মন্ত্রনালয়ের অধীনে রাখা হয়েছে। কিন্তু বীমা ও ঝুঁকি সচেতনতা সৃষ্টির দায়িত্ব সকল মন্ত্রনালয়ের মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বীমা কোম্পানিকে দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হলে বীমা প্রতিষ্ঠান সমূহের সার্বিক উন্নয়ন প্রয়োজন।
বীমা নীতির আওতায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ও ভূমিকা বর্ণিত হয়েছে। এ যাবৎ বীমা নীতি বাস্তবায়নে কতদূর অগ্রগতি হয়েছে সে সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রতি ৬ মাস অন্তর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে পারে।
এছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব হবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে “ঝুঁকি সচেতনতা ও বীমা” বিষয়কে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কাজ হবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন হতে বীমা ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ধর্মীয় নেতাদেরকে অবহিত করা এবং গণসচেতনতা সৃষ্টিতে ইমাম, পুরোহিতদের উৎসাহিত করা।
শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষুদ্রবীমার প্রসারে শ্রম মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে Workmen’s Compensation Act এর অধীনে কারখানা মালিকদের জন্য বাধ্যতামূলক দায় বীমা বা গোষ্ঠী জীবন, স্বাস্থ্য ও দূর্ঘটনা বীমা চালু করা যেতে পারে।
প্রবাসীদের কল্যণে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, সামাজিক সংস্থা এবং এনজিও'দের মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে এবং ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতাদেরকে বীমার আওতায় নিয়ে আনার জন্য সচেতনতা ও উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালেয়ের কর্মসূচী থাকতে হবে।
স্বাস্থ্য বীমা চালু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যখাতে ভূমিকা রাখতে পারে এবং Social Health Insurance বা সামাজিক স্বাস্থ্য বীমা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
কৃষি বীমা ও পশু সম্পদ বীমার সঠিক বাস্তবায়নের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কৃষক, ক্ষুদ্য ব্যবসায়ী ও জমির মালিকদের সচেতন করা যেতে পারে।
এ ছাড়াও তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গণ সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গণমাধ্যমকে এবং আমাদের লোকজ সংস্কৃতির উপযুক্ত ব্যবহার করা যেতে পারে।
একটি উৎকৃষ্ট জাতীয় বীমা নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে এই নিয়ে গর্বের কোন সুযোগ নেই। কারণ বিগত বছর সমুহে এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি নেই। দেশের সকল নাগরিকদের নিকট বীমার সুফল পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব মূলতঃ সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন এভাবে জিডিপি'তে বীমার অবদান ক্রমান্বয়ে ৫% এ উন্নীত করা সম্ভব। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ বীমা সচেতনতা সৃষ্টিতে অত্যান্ত ফলপ্রসূ হবে বলে অধিকাংশ বীমা কর্মী মনে করেন।
আমাদের দেশে সরকার আসে, সরকার যায়, কিন্তু অতীতে বীমার উন্নয়নে কোন নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমান সরকার অনেক বীমা কোম্পানী প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদান করেছে। এ মেয়াদেও তারা বেশ কিছু বীমা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি প্রদান করেছেন।
কিন্তু শুধু মাত্র বীমা কোম্পানীর সংখ্যা বাড়লেই বীমার প্রচার ও প্রসার হবে এ ধারণা সত্য নয়। নতুন বীমা আইন ২০১০ চালুর মাধ্যমে দীর্ঘদিনের একটি প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। বীমা শিল্পের উন্নয়নের জন্য একটি যুগোপযোগী বীমা নীতির বাস্তবায়নের মাধ্যমে বীমা সচেতনতা সৃষ্টির কাজটি অত্যন্ত সহজ হবে।
গণ-মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির প্রধান কাজটি করতে হবে সরকারকে। এজন্য বীমা ব্যবসায় নিয়োজিত উদ্যোক্তা শ্রেণী, বীমা পেশাজীবী/ বীমাবিদ, শিক্ষাবিদ, বীমাগ্রাহক, অর্থনীতিবিদসহ সকল মহল থেকে এ ব্যাপারে পরামর্শ পেশ করতে হবে।
বীমা পেশাজীবীদের সংগঠন এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ যদি এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তবে জাতীয় বীমা নীতি বাস্তবায়ন সম্ভব। “বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন ২০১০” এ বীমা কর্তৃপক্ষের কার্যবলী ও দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম একটি দায়িত্ব হচ্ছে বীমা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেমিনার, ওয়ার্কশপ, সভা ইত্যদির আয়োজন করা। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামও এ বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী।
পূর্বের তুলনায় বর্তমানে বীমা সচেতনতা সৃষ্টির কাজটি অনেক সহজতর হবে বলে মনে হয়। বীমা সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য “বীমা দিবস” পালন অবশ্যই একটি প্রাথমিক ভালো উদ্যোগ কিন্তু সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের নিকট বীমা সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভাগ, জেলা, উপজেলা থেকে শুরু করে গ্রামঞ্চলেও প্রশাসন, বিদ্যায়তন, জন প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রতিবছর “ঝুঁকি সচেতনতা সপ্তাহ” ও “বীমা দিবস” পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বর্তমানে বীমা কোম্পানী সমূহ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ সমূহকে স্বাগত জানিয়েছে। দেশব্যাপী “ঝুঁকি সচেতনতা সপ্তাহ” ও “বীমা দিবস” পালনের মাধ্যমে বীমা শিল্পের অগ্রগতি সুনিশ্চিত করা সম্ভব।
এ ছাড়াও দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বীমা বিষয়ক পাঠ্যক্রম যথা “ঝুঁকি বিজ্ঞান”, “ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা”, “এ্যাকচুয়ারী” সহ জীবন বীমা, স্বাস্থ্যবীমা, সম্পত্তি বীমা, মোটর বীমা, কারিগরী বীমা, দায় বীমা বিষয়ক কোর্স সমূহ চালু করা প্রয়োজন।
বীমা প্রতিষ্ঠান সমুহে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। বীমা প্রতিষ্ঠান সমুহ থেকে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জন সম্পদের জন্য চাহিদা সৃষ্টি করা না হলে উপযুক্ত জনবল সৃষ্টি বা সরবরাহ ফলপ্রসূ হবে না।