অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি ব্যক্তি-পরিবার-বীমা কোম্পানির, আর লাভ...

মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ:

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি বর্ণনাহীন। যা পূর্ব থেকে ধারণা করা যায় না আবার আগুন লাগার পর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করে কিছু করারও সুযোগ থাকে না। নিজে বাঁচার বা সবার সাথে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টাই তখন মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। নিয়তিই জানে কে বাঁচবে আর কে বাঁচবে না। এটাই বাস্তবতা।

বনানীর অগ্নিকাণ্ড দিনের বেলায় হওয়াতে সাধারণ মানুষ নিজেদের পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। তাছাড়া আশপাশের কর্মজীবী মানুষ, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এমনকি যে মানুষটি দুর্ঘটনা কবলিত স্থানে অবস্থান করছিল সেও তার অবস্থান প্রিয়জনকে জানাতে পেরেছিল। আমরা জানি না তাঁদের কতজন বাঁচতে পেরেছিল আর কতজনই বা মারা গেছেন। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য কতজন ইন্টারনেটের তার ধরে নামতে গিয়ে নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়েছেন। বিল্ডিংয়ে অবস্থানরত অনেকে আবার সাথে থেকে সঙ্গ দিয়েছেন যাতে তারা নিরাপদে নামতে পারেন। যদিও নিচ থেকে সকলেই তাদের নামতে নিষেধ করছিলেন। কে চায় বলুন এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে যেতে, বাঁচার যে আকুতি সার্বজনীন তা এই বনানী ট্রাজেডির খুব কাছ থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি।

আগুনের চেয়ে ধোঁয়ার শ্বাসকষ্ট থেকে বাঁচার জন্য কতজন আবেদন জানিয়েছেন, বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। কতজন যে ভয়ে ও শ্বাস-কষ্টে মৃত্যুবরণ করেছেন তার কোন পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। কেউ আবার গায়ে ব্যাগ জড়িয়েও মারা গেছেন। কি ভয়াবহ দৃশ্য ভাবা যায়?

আমাদের দেশে বর্তমানে একটা সংস্কৃতি চালু হয়েছে কোন দুর্ঘটনা ঘটলেই মিডিয়া আজকাল দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সরাসরি সম্প্রচার করে আমাদের উদ্ধার কাজ জানিয়ে দেয়, এটা আমাদের বড় প্রাপ্তি। সে সূত্রে উদ্ধার কাজে কোনো গাফিলতি রয়েছে কিনা তাও প্রত্যক্ষ করা যায়। ইচ্ছা করলে উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণও করা যায়। অনেক সময় দেখা যায় জনগণের অধিক অংশগ্রহণ ও অশৃংখলিত অবস্থানের কারণে উদ্ধার তৎপরতায় বিঘ্ন ঘটে।

দুর্ঘটনার প্রায় ঘণ্টা খানিকেরও বেশি সময় নিয়ে দমকল বাহিনি তাদের কার্যক্রম চালু করতে পেরেছিল, এটা যেমন সত্য তেমনি দমকল বাহিনির কিছু অকুতোভয় সৈনিক সব সময় যে নিজেদের জীবন বাজি রেখে কাজ করেন তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি। একজন উদ্ধার কর্মী নিজের পা ভেঙেও উদ্ধার কাজকে ত্বরান্বিত করেছেন। সত্যি এটি একটি বড় মহত্ব।

পুলিশ বাহিনি, নৌবাহিনি, সেনাবাহিনি ও বিমান বাহিনি সকলকেই সমান দক্ষতায় কাজ করতে দেখেছি। দেশের দুর্যোগে সকলেই একতাবদ্ধ হয়েছেন এটাই বড় প্রাপ্তি।

তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায় আমাদের সকল সক্ষমতা থাকতেও কেন আমাদের এতগুলো জীবন মৃত বলে ঘোষণা করতে হয়েছে। অনেকেই শুনেছি, এফআর টাওয়ারের ছাদ থেকে অন্য বিল্ডিংয়ের ছাদে গিয়ে নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছেন এবং একটা সময় পরে কোন অতি উৎসাহী গোষ্ঠি ছাদে তালা লাগালে আর কেউ এফআর টাওয়ার থেকে বের হতে পারেননি। কারা তালা লাগালো তা জনগনকে জানাতে হবে। ছাদে তালা থাকায় কতজনের প্রান যে আগুন কেঁড়ে নিয়েছে তা আল্লাহ্ পাকই ভালো জানেন।

যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন সরকারি মন্ত্রী, আমলা ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের বেশ তৎপরতা দেখা যায়। তাদের উপস্থিতি এবং কথাবার্তায় মনে হয় এই ধরনের দুর্ঘটনা এটাই প্রথম এবং এর সমাধান সময়ের ব্যাপার মাত্র। আসলে এই ধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা যে কত ঘটেছে তা হিসাবের বাইরে। আমরা কেবল বড় বড় ঘটনাগুলো যা শহরের ভিতরে ঘটে তা জানি এর বাইরে কত দুর্ঘটনা ঘটছে তা আমরা জানতেও পারি না, যদি তা মিডিয়া প্রকাশ না করে।

ঘটনা ঘটলে সকল বিভাগই পারলে তদন্ত করার আশ্বাস দেয়, এটা তার বিভাগের অর্ন্তভূক্ত কিনা তা বিবেচনার বিষয় নয়। ২৮ মার্চ বনানী ট্রাজিডির মতো আরও অনেক ট্রাজিডি দেখেছি যেমন রানা প্লাজা, তাজরিন ফ্যাশন যার কারণে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প হুমকির মুখে পড়েছিল। তখন অনেকে অনেক কথা বলেছিলেন কিন্তু আমরা কি সে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পেরেছি। তাই কথার নয়, কাজের মানুষ দরকার খুব বেশি।

আমরা নিমতলীর ঘটনা দেখেছি আবার চুড়িহাট্টা দেখলাম কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো কি করেছে বা করতে পেরেছে? আমরা শুধু ক্ষত স্থানে সাময়িক মলম লাগাতে পেরেছি ক্ষত সারাতে পারিনি।

স্ত্রী তার স্বামীর খোঁজে এসেছেন তার কান্নায় বাতাস ভারি হয়েছে। বাবা তার ছেলের ফোন পেয়ে উদ্ধারে এসেছেন, বন্ধুরা তাদের বন্ধুর জন্য এসেছেন, কত বোন তার ভাইয়ের খোঁজে এসেছেন, তারা তাদের স্বজনদের জীবিত পেয়েছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই, তবে তাদের আহাজারি আমাদের ব্যথিত করেছে আমাদের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। আমাদের সম্মানীত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সারাক্ষণ খবর রাখছেন, উন্নত ও বিনামূল্যে সেবা দেবার কথা বলেছেন এটা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে আমাদের বড় পাওনা।

অগ্নি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ব্যক্তি নিজে ও তার পরিবার, কোন প্রতিষ্ঠান থাকলে প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, ব্যাংক, বীমা কোম্পানীসমূহ। এই ধরনের দুই চারটা ঘটনা ব্যক্তি, ব্যাংক-বীমার দেউলিয়াত্বের জন্য যথেষ্ট। এদের বাইরে আর কারও হারাবার নেই; অন্যেরা কেবল এই ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ থেকে কিভাবে আয় করবে তা নিয়েই ব্যস্ত। যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায় তখন তার পরিবারকে মৃত ব্যক্তির লাশ নিতে মেডিকেল বিল, হিমঘর, সুরতহাল রিপোর্ট, প্রশাসন বিভিন্ন জায়গায় যার যা প্রাপ্য বাধ্যতামূলক পরিশোধ করে তবেই লাশ বাড়ি নিতে হয়। যদি কেউ মুত্যুবরণ না করেন তবে দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে সারা জীবন সংসারের লোকজনের দয়া দক্ষিণার উপর নির্ভর করে তাকে বাঁচতে হয়। এখানে ব্যক্তি অসহায়, নিয়তিই তার ভরসা।

যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন মালিকের ভূমিকা থাকুক বা না থাকুক প্রথম আক্রমণের স্বীকার হন তিনি। তার প্রতিষ্ঠান ধ্বংসে তিনি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন, সে দিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। এফআর টাওয়ারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম কিছু হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু যাদের তদারকি করার কথা, তাদের গাফিলতের কথা আমরা একবারও বলি না এবং তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়া করাই না। হায় নিয়তি !

ক্ষতিগ্রস্ত মালিককে তার কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির জন্য সার্টিফিকেট আনতে থানা বা দমকল বাহিনীর মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান থেকে তা সংগ্রহে যে কি পরিমাণ কষ্ট ভোগ করতে হয় তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই, তার পরেও হাদিয়া তো আছেই। মানুষের চরম দুর্যোগের সময়ও আমাদের সেবাখাতের এমন নমুনায় সত্যি বিস্মিত হতে হয়। আর এই সকল ডকুমেন্ট ছাড়া বীমা কোম্পানীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ও সম্ভব নয়। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা।

সিটি কর্পোরেশনে যাবেন নতুন ট্রেড লাইসেন্স করতে বা ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে তখন বুঝবেন আরও কিছু। চুড়িহাট্টায় ক্যামিকেলের দোকান/গোডাউন এর লাইসেন্স না দেয়ার কথা থাকলেও লাইসেন্স কেন ইস্যু করা হলো? কারা করলো? সেদিকে না গিয়ে মালিকদের লোভ আর ব্যবসায়ীদের ব্যবসার উপযুক্ত স্থান নির্বাচনকেই বিবেচনায় নিচ্ছি। যে কর্তৃপক্ষ ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করলেন তাদের ব্যাপারে আমরা কি কোন পদক্ষেপ নিয়েছি ?

রানা প্লাজার পর তাজরিন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় আমরা কার্যকর কি ব্যবস্থা নিতে পেরেছি? বনানীর এফআর টাওয়ার রাজউকের ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে কিভাবে ২৩ তলা করা হলো তা আজ প্রশ্ন উঠেছে কিন্তু এটা হার্ট আব দি টাউন। এর মধ্যে যেখানে এই ধরনের বিল্ডিং করতে ১০-১১টা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন লাগে, সেখানে এই ধরনের বিল্ডিং কারো তদারকি ছাড়া কিভাবে তৈরি হয় ? এত বড় বিল্ডিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে অগ্নি নির্বাপনের যথাযথ ব্যবস্থা, ফায়ার ফাইটিং এক্রটিনগুইসার, স্প্রিংগলার ও হাইড্রেন, সিস্টেম ইত্যাদি দেখার দায়িত্ব কাদের? আরও জানা যাচ্ছে এফআর টাওয়ার ভুল নকশায় তৈরি। ফায়ার ফাইটিং এর জন্য দমকল বাহিরি নোটিশ দিয়েই খালাশ। আবার ধোঁয়া নির্গমনের যথাযথ ব্যবস্থা নেই, নির্গমন সিঁড়িতে ত্রুটি। তাহলে যে ডেভেলপার কোম্পানি এটা তৈরি করলেন তাদের ব্যাপারে কি এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ আছে?

এখন সকলের মায়া কান্না বাতাস ভারি করছে, সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বলেছেন, বড় বড় ইমারত তৈরির নকশা, যথাযথ অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা সঠিক আছে কিনা খুঁটিয়ে দেখবেন। আমরা এর সাথে আরও বলবো অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র কার্যকর কিনা তা দয়া করে পরীক্ষা করবেন। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুর্ঘটনার সময় যন্ত্র কাজ করে না, তা যেন না হয়। সবচেয়ে বড় কথা বড় বড় বিল্ডিং-এ স্প্রিংগলার ও হাইড্রেন সিস্টেম কার্যকর কিনা এবং পানির সংস্থান আছে কিনা, না থাকলে কি করণীয় তা নিশ্চিত করবেন। আপনার যথাযথ উদ্যোগই শুধু নয়, বাস্তবায়নের সক্ষমতাই বড় বড় হাইরাইজ বিল্ডিং, গার্মেন্টস, মিল ও ফ্যাক্টরি বিরাট ক্ষতি থেকে বেঁচে যাবে। জান-মালের ক্ষতি কম হবে, নির্বিঘ্নে দেশের অর্থনীতি বাঁধাহীনভাবে এগিয়ে যাবে আর “স্বজনদের ফিরে পাবার আশাও পূরণ হলো না বলতে হবে না”।

এই কথা বলতে না বলতেই ৩০ মার্চ ভোরে আবার গুলশান-১ ডিসিসি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় দেড় শতাধিক দোকান ভস্মীভূত হয়েছে। এর পিছনে কি কাজ করছে, শক্ত হাতে দেখা দরকার। প্রায় দুই বছরের মধ্যে ব্যবসায়ীদের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই আবার বিপর্যয়। নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো এই বিপর্যয়ে অগ্নি দাবি দিতে দিতে দেউলিয়া হবার পর্যায়ে। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখবেন এবং কথায় নয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে ক্ষতি লাঘবে সাহায্য করবেন।

গুলশান-১ এবার আগুন লাগার পর প্রথম আলোর খবর, একজন ভুক্তভোগী আক্ষেপ করে বলছেন শুধু কথাই হয়, কাজ হয় না। আমরা কিভাবে বাঁচবো?

সরকারের সকল বিভাগ দুর্নীতিমুক্ত হয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। মুক্ত মনে মুক্ত হস্তে সহায়তার মাধ্যমে দেশ বিনির্মাণে কাজ করবে এটাই সাধারণ জনগন তাদের কাছে প্রত্যাশা করে।

লেখক: মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড