জুট টেক্সটাইল মিলসের বীমা দাবি: আইডিআরএ’র ভূমিকা নিয়ে কতিপয় প্রশ্ন
এ কে এম এহসানুল হক, এফসিআইআই: দীর্ঘ দেড় বছরের অধিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সম্প্রতি কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি খুলনা জুট টেক্সটাইল মিলসের অগ্নি বীমা দাবি নিষ্পত্তি করেছে।
সংক্ষেপে জুট টেক্সটাইল মিলসের বীমা দাবির ঘটনা নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
২০১৬ সালের ৪ মে সকালে খুলনা জুট টেক্সটাইল মিলসে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংগঠিত হয়। বীমা কোম্পানি কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স জরিপকারী সংস্থা বালটিক কন্ট্রোল বিডি ও দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সপেকশনকে দাবি অনুসন্ধান এবং ক্ষতি নিরূপনের জন্য নিয়োগ করে। কাগজপত্র ও কারখানা পরিদর্শন শেষে প্রথম যৌথ বীমা জরিপকারী ক্ষতির পরিমাণ ১২ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৬১৪ টাকা নির্ধারণ করে।
কিন্তু জুট টেক্সটাইল মিলস এ ব্যাপারে আপত্তি জানায় এবং ক্ষতির পরিমাণ অধিক দাবি করে এবং জরিপকারী নিরূপিত ক্ষতি বাবদ ১২ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৬১৪ টাকা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র কাছে দ্বিতীয় জরিপকারী নিয়োগের ব্যাপারে লিখিতভাবে আবেদন করে।
সেই আবেদনে সম্মতি জ্ঞাপন করে বীমা কর্তৃপক্ষ অগ্নিকাণ্ডের প্রায় দুই বছর পর দ্বিতীয় যৌথ জরিপকারী হিসেবে নিয়োগ পায় ইঞ্জিনিয়ার্স সার্ভে এসোসিয়েটস লিমিটেড ও মিডল্যান্ড সার্ভে এন্ড ইন্সপেকশন।
দ্বিতীয় যৌথ জরিপকারী ক্ষতির পরিমাণ ২৪ কোটি ৪৬ লাখ ৯৪৪ টাকা নির্ধারণ করে তাদের প্রতিবেদন ইস্যু করে। যা প্রথম যৌথ জরিপকারী বালটিক কন্ট্রোল বিডি ও দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সপেকশনকে নিরূপিত ক্ষতির টাকার প্রায় দ্বিগুণ।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় জরিপকারীর প্রতিবেদনের সত্যতা যাচাই-বাছাই বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সকে ক্ষতির দাবি পূরণ বাবদ ২৪ কোটি ৪৬ লাখ ৯৪৪ টাকা পরিশোধ করতে নির্দেশ প্রদান করে।
কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হলে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ তাদের অগ্নি বীমার লাইসেন্স বাতিল করে দেয়। একইসাথে প্রথম যৌথ জরিপকারী বালটিক কন্ট্রোল বিডি ও দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সপেকশনের লাইসেন্স বাতিল ঘোষণা করে।
দ্বিতীয় জরিপকারীর প্রতিবেদন সঠিক নয় বলে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স আপত্তি তুললেও আইডিআরএ’র কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি এবং তা আমলেও নেয়নি। কিন্তু প্রথম জরিপ প্রতিবেদনের তুলনায় দ্বিতীয় জরিপ প্রতিবেদনে দ্বিগুণ ক্ষয়-ক্ষতি গোটা বীমাখাতেই আলোচনার সৃষ্টি করে।
এ অবস্থায় কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নির্দেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদলতে রিট আবেদন দাখিল করে। উচ্চ আদালত রিট আবেদনটি গ্রহণ করে স্টে অর্ডার ইস্যু করে।
বিষয়টি ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’ দৃষ্টিগোচর হওয়ায় তারা জনস্বার্থে দ্বিতীয় জরিপকারী ইঞ্জিনিয়ার্স সার্ভে এসোসিয়েটস লিমিটেড ও মিডল্যান্ড সার্ভে এন্ড ইন্সপেকশনের প্রতিবেদনের সত্যতা যাচাই করার জন্য সরেজমিনে তদন্ত করতে আগ্রহী হয়। কোন সংবাদমাধ্যমের দ্বারা এই ধরণের অনুসন্ধান বাংলাদেশে বীমার ইতিহাসে সম্ভবত এটাই প্রথম। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি অবশ্যই কৃতিত্বের দাবিদার এবং প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সিরিজ আকারে প্রকাশ করা হয়। জুট টেক্সটাইল মিলস এবং ইঞ্জিনিয়ার্স সার্ভে এসোসিয়েটস লিমিটেড ও মিডল্যান্ড সার্ভে এন্ড ইন্সপেকশনের সকল অপকর্ম এবং জালিয়াতির পূর্ণ চিত্র প্রকাশিত হয়।
আদালতে শুনানির পর্যায়ে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র ওই প্রতিবেদন জালিয়াতির প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হয়। আদালত তা গ্রহণ করে।
বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে জুট টেক্সটাইল মিলস উচ্চ আদালতের কাছে দ্বিতীয় জরিপ প্রতিবেদন ডিসপুটেড তাই প্রথম জরিপকারী বালটিক কন্ট্রোল বিডি ও দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সপেকশনের নিরূপিত ক্ষতি বাবদ ১২ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৬১৪ টাকা পরিশোধের জন্য কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সকে আদেশ জারি করার জন্য আবেদন করে। জুট টেক্সটাইল মিলসের এ ধরণের আবেদন তাদের অপকর্ম ও জালিয়াতি স্বীকারের সামিল বলেই আমরা মনে করি।
জুট টেক্সটাইল মিলসের আবেদন বিবেচনা করে উচ্চ আদালত প্রথম জরিপকারীর ক্ষতি নিরূপনকে সঠিক সাব্যস্ত করে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে ৩ মাসের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেন। অন্যদিকে ৩ মাসের মধ্যে পরিশোধ না হলে বিলম্বিত সময়ের জন্য ১০ শতাংশ সুদসহ পরিশোধের নির্দেশ দেন। -এই হল ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণী।
এই বীমা দাবি নিষ্পত্তিকে ঘিরে কাতিপয় বিষয় সামনে উঠে এসেছে। যেমন-
# জুট টেক্সটাইল মিলসের জালিয়াতির সুস্পষ্ট প্রমাণ।
# দ্বিতীয় যৌথ জরিপকারী ইঞ্জিনিয়ার্স সার্ভে এসোসিয়েটস লিমিটেড ও মিডল্যান্ড সার্ভে এন্ড ইন্সপেকশনের জালিয়াতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগসাজস।
বীমার প্রচলিত ধারা অনুযায়ী “A claim is either fraudulent or not. It can’t be partly fraudulent or partly non-fraudulent.”
Moral hazard is usually responsible for fraudulent claim. But ‘Utmost Good Faith’, one of the important principles of insurance keeps a tight check on it.
অর্থাৎ জালিয়াতির অভিযোগ উঠলে বীমা গ্রাহককে টাকা পরিশোধের সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ ছিল। আইডিআরএ উচ্চ আদালতের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সকে নির্দেশ বা পরামর্শ দিতে পারত। কিন্তু তা করা হয় নাই। যা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে চরম অবহেলা ও অপেশাদারি মনোভাবেরই প্রকাশ।
অন্যদিকে দ্বিতীয় জরিপকারীর প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য না হলে কী করে আইডিআরএ দ্বিতীয় জরিপকারীর প্রতিবেদন অনুসারে কন্টিন্টোল ইন্স্যুরেন্সকে দাবি পরিশোধের নির্দেশ দিল তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আমরা যদি ধরে নেই দ্বিতীয় জরিপকারী আইডিআরএ’কে বিভ্রান্ত করেছে। তাহলেও দ্বিতীয় জরিপকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা। কিন্তু আমরা যতদূর জানি তা নেয়া হয় নাই।
আমরা মনে করি এ ধরণের কর্মকাণ্ডের কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের কোন আস্থা থাকবে না। যা বর্তমান সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নিয়েছে তার অন্তরায়।