বীমাখাতে সুশাসনের গুরুত্ব

শামছুল আলম: সুশাসন এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Good Governance শব্দটির Good এবং Governance এ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত, যার অর্থ হচ্ছে নির্ভুল দক্ষ ও কার্যকরী শাসন। সাধারণভাবে সুশাসন বলতে শাসন প্রক্রিয়া সুশৃংখল কাঠামোবদ্ধ একটি রূপ কে বুঝায় যা একটি আদর্শরূপে বাস্তবায়িত হয় এবং যেখানে রাষ্ট্র, জনগণের দায়িত্ব ও প্রশাসনের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারিত ও সম্পর্ক নিহিত।

আবার যদি অন্যভাবে বলা হয় তাহলে জনগণের মৌলিক অধিকার ও বাক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং গণতন্ত্রের সুফল আনয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে যা-যা দরকার তাই সুশাসন । সুশাসন কার্যকর ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে জনগণের অধিক সুবিধা দান করা সহ অধিক কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়। সুশাসনের পূর্বশর্তগুলো হল- মত প্রকাশের স্বাধীনতা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা ও নিরপেক্ষ আইন ব্যবস্থা।

সাধারণভাবে সুশাসন বলতে এমন এক আদর্শ শাসন ব্যবস্থাকে বুঝায় যা একটি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটায়। অন্যভাবে, সুশাসন বলতে এমন এক ধরণের শাসন ব্যবস্থাকে বোঝায় যা জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, প্রশাসনিক দক্ষতা, আইনের অনুশাসন, মানবাধিকার  ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়। সুশাসন আইনের শাসনেরই আরেক নাম।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৯৫ দ্বারা বীমা শিল্পকে জাতীয়করণ করে। এই আদেশ বাংলাদেশ বীমা (জাতীয়করণ) আদেশ ১৯৭২ হিসেবে বেশি পরিচিত। ১৯৮৪ সালে বীমা কর্পোরেশন আইন ১৯৭৩ এর সংশোধনী আনা হয়। এতে সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা কর্পোরেশনের পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানা খাতে বীমা কোম্পানি পরিচালনার ব্যবস্থা রাখা হয়। বীমা কর্পোরেশন (সংশোধনী) আইন ১৯৮৪, ব্যবসায় পরিচালনা এবং পুনঃবীমা সংক্রান্ত কয়েকটি বিধিনিষেধ সাপেক্ষে ব্যক্তিমালিকানা খাতে সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানি স্থাপনের অনুমতি দেয়। বেসরকারিকরণ নীতির ফলে ১৯৮৫ সাল থেকে বেসরকারি খাতে বেশকিছু বীমা কোম্পানি আত্মপ্রকাশ করেছে। সেই থেকে নন-লাইফ বীমা কোম্পানীগুলো দেশে বীমা শিল্পে অবদান রেখে চলেছে।

বিশ্বে বীমা শিল্পের গুরুত্ব থাকলেও আমাদের দেশে এখনো সেদিক থেকে বীমা শিল্প পিছিয়ে আছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দক্ষ জনশক্তি, সুশাসনের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে আমাদের দেশের বীমা শিল্পে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এখনো আমাদের দেশে বীমা শিল্পের শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেনি। এখানে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। আমি মনে করি বাংলাদেশে বীমা চাহিদার তুলনায় বীমা কোম্পানী অনেক বেশি। নেই কোন সুষ্ঠু তদারকি ও সঠিক অবকাঠামো। বাংলাদেশের বীমা শিল্পকে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে অবশ্যই অবকাঠামো ও জবাবদিহিতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সরকারকে আরোও নানামুখি উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশে সরকারী খাতে ১টি ও বেসরকারী খাতে ৪৬টি কোম্পানীসহ মোট ৪৭টি নন-লাইফ বীমা এবং সরকারী খাতে ১টি ও বেসরকারীখাতে ৩৩টি জীবন বীমাসহ মোট ৩৪টি কোম্পানী রয়েছে। অসম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বীমা ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে কোম্পানীগুলো। একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে বাংলাদেশে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীগুলো মার্কেট সচেতনার জন্য তেমন কোন উদ্যোগ নেয় না। কোম্পানীগুলো যদি ইন্স্যুরেন্স-এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে গ্রাহকদের মাঝে সচেতনামূলক প্রচার-প্রচারণা করলে বাজারে ইন্স্যুরেন্সের চাহিদা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।

কিছু দিন পূর্বে অবশ্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা (IDRA) বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে যা প্রশংসনীয়। সংস্থাটি যদি আরোও আগে এই উদ্যেগ গ্রহন করতো তাহলে বাজারে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা আসতো। যাহোক দেরিতে হলেও উদ্যোগ নেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয়। উদ্যোগ নেয়ার ফলে বাজারে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে যা লক্ষ্যনীয়। এখন আর আগের মতো কমিশন নিয়ে দর কষাকষি হয় না, এক কোম্পানীর ব্যবসা অন্য কোম্পানী ইস্যু করতে পারে না। দেরিতে হলেও স্বচ্ছতা ও সুফলতা আসতে শুরু করেছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীগুলো গ্রাহক সেবায় অনেকটা পিছিয়ে আছে। বীমা পলিসি ইস্যু করার পর গ্রাহকের সাথে যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক নিশ্চিত করা। কিন্তু পলিসি ইস্যু করার পর আর যোগাযোগ করে না, দেখা যাচ্ছে পলিসির রিনিউয়াল (Renewal) সময় আসলে আবার তারা যোগাযোগ শুরু করে, এই যোগাযোগটা সবসময় রাখা উচিত, তাহলে গ্রাহকের মাঝে অনেকটা উৎসাহ বৃদ্ধি সহ ইন্স্যুরেন্সের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয় এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

বীমা শিল্পকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হলে অবশ্যই দক্ষ জনবল থাকতে হবে। আমি মনে করি এই শিল্পে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। দক্ষ জনশক্তি না থাকলে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বীমা শিল্পে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার মত তেমন সুযোগ সুবিধা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। যে কয়টি আছে তাও জনবল তৈরির জন্য পর্যাপ্ত নয়। এই পেশায় দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে হলে সরকারীভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন- সরকারী/ বেসরকারী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইন্স্যুরেন্সের উপর পাঠ্য বই আকারে শিক্ষা দানের ব্যবস্থা গ্রহন করা, বীমা পেশার উপর পর্যাপ্ত ট্রেনিং ব্যবস্থা, প্রতিটি কোম্পানীতে খন্ডকালিন ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। তাহলে হয়তো বীমা শিল্পের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি অগ্রনী ভুমিকা পালন করতে পারে।  প্রতিষ্ঠানটি যদিও সুশাসন ও বীমা শিল্পের দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে বীমা শিল্পের উপর বিষয়ওয়ারী বিভিন্ন মেয়াদে ট্রেনিং দিয়ে আসছে যা প্রসশংণীয়। আমি মনে করি প্রতিষ্ঠানটি আরোও ব্যাপক আকারে উদ্যোগ নেয়া দরকার।   

বীমা পেশায় অনেক মেধাবীরা আসতে চায় না। না আসার পেছনে কারণও আছে। তা হলো উপযুক্ত পরিবেশের অভাব। আছে বেতন বৈষম্যসহ নানাবিধ সুযোগ সুবিধার অভাব।  বীমা পেশায় নিয়োজিত আছেন তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নেই। খুবই নিম্নমানের জীবন যাপন করছে এই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। মাসিক সম্মানীসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা খুবই কম, বাড়তি নেই কোন সুযোগ সুবিধা। কয়েকটি কোম্পানীতে কিছু সুযোগ সুবিধা থাকলেও বেশির ভাগ কোম্পানীতে নেই বললেই চলে।

একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ব্যাংকে নিয়োজিত কর্মকর্তার তুলনায় বীমা পেশার কর্মকর্তাদের বেতন তুলনামূলকভাবে কয়েকগুণ কম সে সাথে সুযোগ সুবিধাও কম। যদি এই রকম বৈষম্য থাকে তাহলে বীমা শিল্পে সুশাসন আশা করা যায় না। দক্ষ জনবল ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই কর্মকর্তা/ কর্মচারীদের দেশের প্রচলিত আইন ও সরকারীভাবে সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে এই শিল্পে সুশাসন নিশ্চিত হবে।

পাশাপাশি বীমা শিল্পে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে যেটি সর্ব প্রথম প্রয়োজন তাহলো কোম্পানীগুলোর পরিচালকবৃন্দের উদার মনোভাব থাকতে হবে। তাদেরকে একটি প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বর্তমানে বীমা ব্যবসা খুবই কঠিন সময় অতিবাহিত করছে। বাজারে প্রতিযোগিতা ও প্রতিকুলতার মাঝে এই শিল্প টিকে রয়েছে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই বীমা পরিচালকবৃন্দের সদিচ্ছা থাকতে হবে। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে। তবে আগের তুলনায় অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরে আসতে শুরু করেছে যা বীমা শিল্পের জন্য অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) দূরদর্শি ও বিচক্ষন তদারকির কারণে বীমা শিল্পে শৃঙ্খলা ও সুশাসনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

বীমা শিল্পকে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌছে দেয়ার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন সংগঠন ও কোম্পানীগুলো । বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার বীমা শিল্পের সুশাসন ও শৃঙ্খলা ফেরাতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। সরকার জাতীয় বীমা নীতি ২০১৪ ঘোষনা করেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ মার্চ জাতীয় বীমা দিবস ঘোষনা করেছেন। দিবসটিকে কেন্দ্র করে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো উৎসাহ উদ্দীপনার সহিত দিবসটি পালন করেন এবং বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করে থাকেন। এই প্রসংসনীয় কাজের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানাই বীমা শিল্পকে আধুনিকায়নের ও নানামুখী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। আশা করি ভবিষ্যতে বীমা শিল্প আরো নতুন নতুন উদ্ভাবনী সৃজনশীল নানামুখী পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে বীমা শিল্পের সুশাসন নিশ্চিত হবে।

পরিশেষে বলব অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। বর্তমান বিশ্বায়ন গ্লোবালাইজেশনের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিছু দিন পূর্বেও বীমা নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা নেতিবাচক ধারনা থাকলেও নানা মুখী পদক্ষেপের কারণে তা জনগণের মধ্যে ইতিবাচক ধারনা তৈরী হতে শুরু করেছে। এখন আর আগের মত এনালগ পদ্ধতিতে পলিসি তৈরী হচ্ছে না। এখন সব কিছু ডিজিটাল প্রযুক্তিতে হচ্ছে। অনেক কোম্পানী কম্পিউটাররাইজ পদ্ধতিতে গ্রাহকদের সেবা প্রদান করে আসছে। সুশাসনের কারণেই এইগুলো হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে আরো এগিয়ে যাবে এই বিশাল খাতটি।

গ্রাহক সেবার মান আগের তুলনায় অনেক ভালো। সময় মত গ্রাহকদের বীমা দাবী পরিশোধ করা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম থাকলেও অনেকটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে সুশাসনের কারণে। সুশাসন না থাকলে এত কিছু সম্ভব হতো না। তাই আবারো বলব ভবিষ্যত সুরক্ষার জন্য বীমার বিকল্প নেই। মূল বিষয় হচ্ছে একটি দক্ষ ও যোগ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে বছর শেষে ব্যবসায়িক ও আর্থিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা। একই সঙ্গে গ্রাহকদের পাওনা যাতে ঠিকমতো পরিশোধ করা হয়, সেদিকেও বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। বীমা শিল্পে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে সকল নাগরিকের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। সম্মিলিত উদ্যোগে সুশাসন ফিরে আসতে পারে বীমা শিল্পে। পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ খাতে দক্ষ  জনবল বাড়াতে হবে। 

লেখক: ডেপুটি ম্যানেজার (অবলিখন), ইষ্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।